ঢাকা     শনিবার   ০৫ অক্টোবর ২০২৪ ||  আশ্বিন ২০ ১৪৩১

১৫ আগস্টের সঙ্গে জিয়া ওতপ্রোতভাবে জড়িত : প্রধানমন্ত্রী

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:০৪, ১৬ আগস্ট ২০২৩   আপডেট: ২১:৪১, ১৬ আগস্ট ২০২৩
১৫ আগস্টের সঙ্গে জিয়া ওতপ্রোতভাবে জড়িত : প্রধানমন্ত্রী

ফাইল ছবি

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ওতপ্রোতভাবে জড়িত মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, একসঙ্গে উঠাবসা করেছে, খাওয়া-দাওয়া করেছে তারাই বেঈমানি করেছে।

বুধবার (১৭ আগস্ট) রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত স্মরণ সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে এ মন্তব্য করেন তিনি।  

প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা আমাদের বাড়িতে উঠাবসা করেছে খাওয়া-দাওয়া করেছে তারাই বেঈমানি করেছে এতে কোনও সন্দেহ নেই। মোশতাক নিজে ক্ষমতায় বসে জিয়াউর রহমানকে বানালো সেনাপ্রধান। এই ঘটনার সঙ্গে জিয়াউর রহমান ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

তিনি বলেন, মীরজাফর বেঈমানি করে তিন মাসও ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। একই ঘটনা বাংলাদেশে ঘটেছে। মোশতাকের বিদায় আর জিয়াউর রহমান নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা দিয়ে ক্ষমতায় বসেন। একদিকে সেনাপ্রধান আবার রাষ্ট্রপতি। এই দুই পদ সংবিধান লঙ্ঘন করে সেনাআইন লঙ্ঘন করে। মার্শাল ল’ জারি করে। ইনডেমনিটি দিয়ে খুনিদের বিচারের পথ বন্ধ করে দিয়ে তাদের পুরস্কৃত করে। উর্দি পরে ক্ষমতায় বসা এরপর আবার নিজেকে রাজনৈতিক ব্যক্তি বানানোর চেষ্টা। ‘হ্যাঁ’ ‘না’ ভোট দিয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। সেনাপ্রধান থেকে নিজেকে যেমন রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেছে, আবার একটি নির্বাচনও করেছে সেই আর্মি রুলস ও সংবিধান লঙ্ঘন করে। কারণ তখন তো মার্শাল ল’ জারি, সংবিধান তো নেই। সংবিধান তো শেষ।  

‘একটা নির্বাচনী প্রহসন দিয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করে। ভোট কারচুপি আর ভোট চুরির কালচার তখন থেকেই শুরু। এরপর দল গঠন। ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট বিলিয়ে কিছু লোক অথবা কাউকে অত্যাচার করে বিএনপি নামে রাজনৈতিক দল করে। আর সেই দল নিয়েই জাতীয় সংসদ নির্বাচন… সেই নির্বাচনও জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে করেছিল।’

তৎকালীন সময়ের বর্ণনা করতে গিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, তখন জনগণের কথা বলার কোনও অধিকারও ছিল না। মার্শাল ল’ জারি, প্রতিরাতে কারফিউ। স্বাভাবিক চলাফেরার অধিকার পর্যন্ত মানুষের ছিল না। বাংলাদেশের মানুষ কথা বলার অধিকার হারিয়েছিল। মত প্রকাশের কোনও স্বাধীনতা ছিল না। রেডিও, টেলিভিশন, হাতেগোনা কয়েকটি পত্রিকা তাদের নিয়ন্ত্রণে। সমস্ত বাংলাদেশ যেন একটি কারাগারে পরিণত।

‘ক্ষমতায় এসেই সেনাবাহিনীর হাজার হাজার সৈনিক, অফিসারকে হত্যা করেছে জিয়াউর রহমান। একটা ক্যু হয়েছে তার বিরুদ্ধে, সঙ্গে সঙ্গে তাদের বিচারও করেনি। ফাঁসি দিয়েছে। সবাইকে যে জেলে নিয়েছে তা নয়, অনেককে ফায়ার স্কোয়াডে নিয়ে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করেছে। বিমানবাহিনীর ৬’শর ওপর অফিসারকে হত্যা করেছে। সেনাবাহিনীর দুই হাজার মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে হত্যা করেছে। এভাবেই দেশ চলছিল। দেশের মানুষের না ছিল ভোটের অধিকার, না ছিল কথা বলার অধিকার, না ছিল আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার।’

স্বাধীনতাবিরোধী প্রতিষ্ঠিত করেছে জিয়া-এরশাদ-খালেদা

জিয়াউর রহমানের হাত ধরে দেশের স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের উত্থানের বর্ণনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জামায়াতের উত্থান জিয়াউর রহমানের হাত দিয়ে। কারণ জামায়াত, এরা ছিল যুদ্ধাপরাধী। যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এদেশের গণহত্যা চালায়, মেয়েদের ধরে ধরে সেনাক্যাম্পে নিয়ে পাশবিক অত্যাচার করে; সারা দেশে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে। সমস্ত গ্রামের মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে, লুটপাট করে জামায়াতে ইসলামীর লোকজনই ছিল এদের দোসর। এদের দ্বারাই রাজাকার বাহিনী, আলবদর বাহিনী। এরাই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পথ দেখিয়ে গ্রামে গ্রামে নিয়ে যায়। মা-বোনদের ধরে ধরে তাদের হাতে তুলে দেয়।

তিনি বলেন, জাতির পিতা আমাদের যে সংবিধান দিয়েছিলেন সেই সংবিধানে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা যেমন তিনি করেছিলেন, তেমনি তাদের কোনও ভোটের অধিকারও ছিল না, তাদের দল করবার অধিকারও ছিল না। তাদের অনেকে পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে পাকিস্তানেও চলে গিয়েছিল। আর যারা দেশে ছিল তারা সকলেই তখন আন্ডারগ্রাউন্ডে সর্বহারা পার্টি, পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি; বিভিন্ন যে আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টি ছিল সেসব দলের সঙ্গে ভিড়ে যায়। আর সেই সময় ছাত্রলীগ ভেঙে জাসদের সৃষ্টি হয়। জাসদের সঙ্গে এরাই যুক্ত হয়ে যায়।

‘জাতির পিতা যতদিন বেঁচে ছিলেন, জাসদের বড় বড় মিটিংয়ে টাকা-পয়সার অভাব হত না। জাতির পিতাকে হত্যার পর তাদের গুরুত্ব কমে গেল। তখন তাদের লোকও নেই, অর্থও নেই। কারণ তখন রাজাকাররা সুযোগ পেয়ে গেছে। জিয়াউর রহমান সংবিধানে মার্শাল অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে ১২ ধারা যুক্ত করে দেয় এবং ৩৮-এ যে অংশে ভোটের অধিকার ছিল না, সেটা সংশোধন করে দেয়। ভোট কারচুপির মাধ্যমে যে সংসদ গঠন করে, সেই সংসদে এই আইন পাশ করে। স্বাধীনতাবিরোধী সেই শাহা আজিজ যে পাকিস্তানের প্রতিনিধি হয়ে জাতিসংঘে যায়, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তাকেই প্রধানমন্ত্রী বানায় জিয়াউর রহমান। আর সে তো রাষ্ট্রপতি।’

তিনি বলেন, জয়পুরহাটের আব্দুল আলিশ, যে একদিনে দেড়শ মানুষকে হত্যা করেছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের সেই আব্দুল আলিশসহ সব রাজাকারদের মন্ত্রী-উপদেষ্টা বানায় জিয়া। নানাভাবে লাখো শহিদের পতাকা তুলে দেয় যুদ্ধাপরাধীদের হাতে। তারপর খুনিদের বিচার হবে না। আজকে যখন কারও আপনজন কেউ মারা যায়, তখন যখন আমার কাছে বিচার চায়; তখন আমার কাছে এই প্রশ্নটা জাগে, আমরা যারা আমাদের তো কোনও অধিকার ছিল না বিচার চাওয়ার। আমরা তো মামলাও করতে পারিনি। মামলা করার অধিকারও ছিল না। জিয়াউর রহমান সংবিধান লঙ্ঘন করে সেই সুযোগ বন্ধ করে দিয়ে গেছে। আইন করে দিয়ে গেছে, যাতে বিচার না হয়। খুনিদের পুরস্কৃত করেছে। তাদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়েছে। খুনিদের তারা মদদ দিয়েছে, অর্থ দিয়েছে।

এরশাদ সরকারের সময় বঙ্গবন্ধুর খুনিরা রাজনৈতিক দল করার সুযোগ পায় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এরশাদ ক্ষমতায় এসে খুনি ফারুক, রশিদ তাদের রাজনৈতিক দল করার শক্তি দেয়। আর মঈনুল হোসেন ইত্তেফাকে বসে পাশা, হুদা এদের নিয়ে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল হিসেবে একটা রাজনৈতিক দলও গঠন করে। খুনিদের নিয়ে তার দল গঠন। আর এরশাদ এসে ’৮৮ সালে যে নির্বাচন করেছিল, তাতে ফারুককে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হওয়ার সুযোগ করে দেয়। এই ফারুক কিন্তু অবৈধ অস্ত্রসহ ধরা পড়েছিল। তাকেই আবার এরশাদ রাজনীতি করার সুযোগ দেয়।

‘এর একধাপ উপরে যায় খালেদা জিয়া। ১৯৯১ সালে কোনও দল ক্ষমতায় আসার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান সাহাবুদ্দিন আহমেদ আমাকে ডেকে বলেছিলেন যে, জামায়াত এবং জাতীয় পার্টি আপনাকে সমর্থন দেবে আপনি সরকার গঠন করতে পারেন। আমি ওনাকে বিনয়ের সঙ্গে বলেছিলাম, এইভাবে সরকার গঠন করতে চাই না। উনি বলেছিলেন, আপনি তো বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হবেন। আমি বলেছিলাম, ওরকম প্রধানমন্ত্রীর লোভ আমার নেই। আমি যখন সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাইনি আমি সরকার গঠন করবো না, আপনি অন্য কাউকে ডাকেন তারা করবে। তখন খালেদা জিয়া জামায়াতের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসেন ৯১ সালে।’

১৫ আগস্ট মিথ্যা জন্মদিন খালেদা জিয়ার বিকৃত মানসিকতা

প্রধানমন্ত্রী বলেন,  ’৯১ তে ক্ষমতায় এসেই খালেদা জিয়ার আসল রূপ বের হলো। ১৫ আগস্ট যে দিনে আমরা শোক পালন করি, সেই দিন হয়ে গেলো তার জন্মদিন। একটা মিথ্যা জন্মদিন। কারণ সে কোনোভাবেই প্রমাণ করতে পারবে না যে তার জন্ম ১৫ আগস্ট। এতোগুলো মানুষ যেখানে নির্মমভাবে হত্যা হয়েছে সেটাকে সে উৎসব হিসেবে নিল। দুর্ভাগ্য যে তার অনেক পা চাটা দল বড় বড় কেক বানিয়ে নিয়ে সেখানে যেত। এই ধরনের ন্যক্কারজনক কাজ আমরা দেখেছি।

‘হত্যার দিনটাকে সে উৎসব হিসেবে পালন করতো। কতো বড় বিকৃত মানসিকতা থাকলে এরকম করতে পারে আপনারা চিন্তা করে দেখেন। তাদের কাছ থেকে আবার নির্বাচনের কথা, মানবাধিকারের কথা আমাদের শুনতে হয়। আমাদের মানবিকতা কোথায় ছিলো, যেখানে আমার মা-বাবার হত্যার বিচার চাওয়ার অধিকার আমার ছিল না। একটা মামলা করার অধিকারও আমাদের ছিল না। আমাদের আওয়ামী লীগের অগণিত নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে। তাদের আপনজনও তো লাশের সন্ধানও পায় না।’

তিনি বলেন, ১৫ আগস্ট আমাদের জাতীয় জীবনে কতো বড় ক্ষত চিহ্ন রেখে গেছে, যে মুক্তিযুদ্ধের জন্য এদেশের লাখো মানুষ জীবন দিয়েছে সেই মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত আদর্শ সমস্ত চেতনা সবকিছুই পরিবর্তন করে ফেলেছিল। স্বাধীন জাতি হিসেবে আমরা যে মর্যাদা পেয়েছিলাম, সেটাও হারিয়ে ফেলে খুনের জাতি হিসেবে পরিচিত হতে হতো। এটা ছিলো জাতির জন্য সবচেয়ে দুর্ভাগ্য।

‘অর্থনৈতিক অবস্থা কী হলো? বাংলাদেশের মানুষের একবেলা খাবার জোটে না, পরনে ছিন্ন কাপড়। বিদেশ থেকে পুরনো কাপড় এনে পরায়। রোগে চিকিৎসা পায় না। বেকারত্ব। মানুষের জীবনে কোনও আশা-ভরসা নেই, অন্ধকারে পড়েছিলো এদেশের মানুষ। আর ওই ক্ষমতা দখলকারীরা মুষ্টিমেয় লোকেরা অর্থ লুটপাট করেছে আর ভোগ বিলাসে দিন কাটিয়েছে।’

আলোচনা সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। আরও বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি, সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম কামাল হোসেন, কার্যনির্বাহী সদস্য তারানা হালিম, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. হুমায়ুন কবির, উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম মান্নান কচি প্রমুখ।

আলোচনা সভাটি আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক আব্দুস সোবহান গোলাপ ও উপপ্রচার ও প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক আব্দুল আউয়াল শামীম যৌথভাবে সঞ্চালনা করেন।

পারভেজ/এনএইচ


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়