ঢাকা     শনিবার   ০৬ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ২২ ১৪৩১

বিরোধী দলের কার্যকর অংশগ্রহণের অভাবে জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ঘাটতি রয়ে গেছে: টিআইবি

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২১:১০, ১ অক্টোবর ২০২৩   আপডেট: ২১:১১, ১ অক্টোবর ২০২৩
বিরোধী দলের কার্যকর অংশগ্রহণের অভাবে জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ঘাটতি রয়ে গেছে: টিআইবি

জাতীয় সংসদ অধিবেশন (ফাইল ফটো)

একাদশ জাতীয় সংসদে সরকারি দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা, প্রকৃত বিরোধী দল না থাকা এবং প্রধান বিরোধী দলের কার্যকর অংশগ্রহণের অভাবে জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ঘাটতি রয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

‘পার্লামেন্টওয়াচ; একাদশ জাতীয় সংসদ; ১ম হতে ২২তম অধিবেশন (জানুয়ারি, ২০১৯—এপ্রিল, ২০২৩)‘ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে রোববার (১ অক্টোবর) আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ মন্তব্য করা হয়। জাতীয় সংসদের কাছে প্রত্যাশিত ভূমিকা নিশ্চিতে গবেষণা প্রতিবেদনে ১৩ দফা সুপারিশ করা হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা—নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মুহাম্মদ বদিউজ্জামান। প্রতিবেদনটি উপস্থাপনা করেন টিআইবি’র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট রাবেয়া আক্তার কনিকা এবং মোহাম্মদ আব্দুল হান্নান সাখিদার। 

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, একাদশ জাতীয় সংসদে ক্ষমতাসীন জোটভুক্ত দল হিসেবে সংসদীয় কার্যক্রমে প্রধান বিরোধী দল দ্বৈত ভূমিকা পালন করেছে এবং সংসদকে কার্যকর করে তুলতে বিরোধী দলের শক্তিশালী ভূমিকা পালনে ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। সরকারি দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিপরীতে প্রধান বিরোধী দলের অবস্থান ছিল প্রান্তিক এবং সরকারকে জবাবদিহি করার ক্ষেত্রেও তাদের ভূমিকা ছিল সার্বিকভাবে গৌণ। ক্ষেত্র বিশেষে প্রধান বিরোধী দলের সদস্যদের বক্তব্যে অন্যান্য বিরোধী দলের পর্যালোচনা ও সমালোচনা প্রাধান্য পেয়েছে, যা প্রধান বিরোধী দলের দ্বৈত ভূমিকা ও পরিচয়কে আরও প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। 

 সংসদীয় কার্যক্রমে বিষয়ভিত্তিক, প্রাসঙ্গিক ও গঠনমূলক আলোচনার পরিবর্তে সরকার ও দলীয় অর্জনের প্রশংসা এবং প্রতিপক্ষ দলের প্রতি আক্রমণাত্মক সমালোচনার প্রাধান্য পেয়েছে। 

একাদশ জাতীয় সংসদে বিভিন্ন কার্যক্রমে ৭৪৪ ঘণ্টা ১৩ মিনিট সময় ব্যয় হয়েছে, যার মধ্যে জনপ্রতিনিধিত্ব ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা কার্যক্রম মোট সময়ের ২৬.৬% (১৯০ ঘণ্টা, ২৬ মিনিট), রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আলোচনা মোট সময়ের ২৫.৭% (১৯১ ঘণ্টা, ২৩ মিনিট), বাজেট আলোচনায় ১৪২ ঘণ্টা ৩০ মিনিট (১৯.২%), আইন প্রণয়ন কার্যক্রমে ১২৪ ঘণ্টা ১৮ মিনিট (১৬.৭%) এবং কিছু বিশেষ কার্যক্রমে ৯ ঘণ্টা ১৭ মিনিট (১.২%) সময় ব্যয় হয়েছে। 

রাষ্ট্রপতির ভাষণে প্রায় চার-পঞ্চমাংশ সময় সরকারের অর্জন বিষয়ক আলোচনাই প্রাধান্য পেয়েছে। রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর ধন্যবাদ প্রস্তাব আলোচনায় সরকার দলীয় সদস্যরা সর্বোচ্চ সময় ব্যয় করেছেন প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা এবং সরকারের বিভিন্ন অর্জনের প্রশংসায়। 

প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্বে ৪৮.৭% প্রশ্নকর্তা প্রশ্নের বাইরে অন্যান্য আলোচনা (প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা, দলের প্রশংসা, অন্য দলের সমালোচনা ইত্যাদি) করেন, যা প্রশ্ন উত্থাপনে মোট ব্যয়িত সময়ের প্রায় ৮০%। একইভাবে, মন্ত্রীদের প্রশ্নোত্তর পর্বে ৫৬.৭% প্রশ্নকর্তা প্রশ্নের বাইরে প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা, দলের প্রশংসা, অন্য দলের সমালোচনা করেন, যা প্রশ্ন উত্থাপনে মোট ব্যয়িত সময়ের প্রায় ৬৫%। অন্যদিকে, উত্তর প্রদানের প্রায় ৩৯.৮ শতাংশ ব্যয় হয়েছে উত্তরবহির্ভূত আলোচনায়। 

সাধারণ আলোচনায় এককভাবে বঙ্গবন্ধু সংশ্লিষ্ট আলোচনাতেই প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি সময় ব্যয় হয়েছে, যা শতাংশের হিসেবে ৪৫.১%। বিষয়ভিত্তিক আলোচনা করতে গিয়ে সদস্যরা আত্মপ্রশংসা ও অন্যদলের সমালোচনায় ব্যয় করে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সময়। 

 জনপ্রতিনিধিত্বমূলক কার্যক্রমসমূহে তুলনামূলক কম গুরুত্ব প্রদান (কার্যক্রম স্থগিত রাখা, চলমান জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ অনালোচিত থাকা ইত্যাদি) করা হয়েছে এবং সার্বিকভাবে বিগত সংসদগুলোর চেয়ে (নবম ও দশম সংসদ) ব্যয়িত সময় ও অংশগ্রহণের হার হ্রাস পেয়েছে। আইন প্রণয়ন বা বিল পাসের ক্ষেত্রে পূর্বের সংসদগুলোর চেয়ে গড় সময় বৃদ্ধি পেলেও সদস্যদের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও গঠনমূলক বিতর্কের ঘাটতি সুস্পষ্ট ছিল। আইন প্রণয়নে সরকারি দলের অধিকাংশ সদস্যের অংশগ্রহণ শুধু বিলের পক্ষে ভোট দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। আইন প্রণয়ন কার্যক্রমে ব্যয়িত সময় প্রায় ১৬.৭ শতাংশ। এখানে উল্লেখ্য, ২০১৯-২০ এ যুক্তরাজ্যে এই হার ছিল প্রায় ৪৯.৩ শতাংশ এবং ২০১৮-১৯ এ ভারতের ১৭তম লোকসভায় এই হার ছিল ৪৫.০ শতাংশ। 

বাজেট কার্যক্রমে ৮০.১ শতাংশ সময় ব্যয় হয় বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায়, ১৫.৮ শতাংশ সময় ব্যয় হয় মঞ্জুরি দাবির ওপর আলোচনায় এবং ৪.১ শতাংশ সময় ব্যয় হয় বাজেট উপস্থাপনে। বাজেট আলোচনায় ৩৫.৭ শতাংশ সময় ব্যয় হয় বাজেট সংক্রান্ত আলোচনায় এবং বাকি সময় ব্যয় হয় অন্যান্য আলোচনা, দলের প্রশংসা এবং অন্য দলের সমালোচনায়। 

গবেষণায় দেখা যায়, সংসদীয় কার্যক্রমে সদস্যদের অনুপস্থিতি, যথাযথ গুরুত্ব সহকারে অংশগ্রহণ না করা, প্রতিপক্ষের মতামত প্রকাশে বিঘ্ন ঘটনো ও মতামত গ্রহণ না করার প্রবণতার কারণে কার্যক্রমসমূহের কার্যকারিতা হ্রাস পেয়েছে। স্থায়ী কমিটিগুলোর নিয়মিত বৈঠকের ঘাটতি, বিশেষত করে দেশের জরুরি পরিস্থিতিতেও সংশ্লিষ্ট কমিটিসমূহের বৈঠক করার প্রতি গুরুত্বহীনতাও পরিলক্ষিত হয়েছে।

বিধি অনুযায়ী প্রত্যেক কমিটির প্রতি মাসে ন্যূনতম ১টি করে সভা করার নিয়ম থাকলেও, কোনো কমিটিই সে নিয়ম পালন করেনি। ন্যূনতম নির্ধারিত সভার ৬৬.১ শতাংশই হয়নি। করোনাকালে (মার্চ, ২০২০—আগস্ট, ২০২১) একটিও সভা করেনি অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। করোনাকালে প্রথম ১৮ মাসের ১৩ মাসই কোনো সভা করেনি স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। এছাড়া, সংসদে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে গৃহীত পদক্ষেপ, অর্জিত লক্ষ্য, চ্যালেঞ্জসমূহ নিয়ে সুনির্দিষ্ট আলোচনার ঘাটতি ছিল। পাশাপাশি, সংসদ সদস্যদের একে অপরের প্রতি এবং সার্বিকভাবে সুশীলসমাজের প্রতি আচরণের ক্ষেত্রে বিধিবহির্ভূত আচরণ লক্ষ করা যায়।

সুশীলসমাজের প্রতিনিধি ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কোনো কোনো নারী সদস্যের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক এবং আপত্তিকর শব্দের ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। বিরোধী দলের তুলনায় সরকারি দলের সদস্যদের ক্ষেত্রে এই ব্যত্যয় অধিকমাত্রায় পরিলক্ষিত হয়েছে। সদস্যদের অসংসদীয় ভাষা ব্যবহার বন্ধে সদস্যদের সতর্ক করা বা শব্দ এক্সপাঞ্জ করার ক্ষেত্রে স্পিকারকে নীরব ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে। 

এছাড়া, সংসদে ও কমিটিতে সদস্যদের উপস্থিতি, সংসদীয় কার্যক্রমের বিবরণী, সংসদ সদস্যদের সম্পদের হালনাগাদ তথ্য, সংসদীয় কার্যক্রমের কার্যবিবরণী ইত্যাদি স্বপ্রণোদিতভাবে উন্মুক্ত করার উদ্যোগেরও ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। 

গবেষণায় দেখা যায়, কোরাম সঙ্কটে মোট ৫৪ ঘণ্টা ৩৮ মিনিট ব্যয় হয়, যা সংসদ কার্যক্রমের মোট ব্যয়িত সময়ের ৬.৫%। কার্যদিবস প্রতি গড়ে ১৪ মিনিট ০৮ সেকেন্ড ব্যয় হয়। ৮৪% কার্যদিবসে নিধার্রিত সময় হতে বিলম্বে অধিবেশন শুরু হয় এবং ১০০% কার্যদিবসে বিরতির পর নিধার্রিত সময় হতে বিলম্বে অধিবেশন শুরু হয়। 

সংসদ পরিচালনার প্রতি মিনিটের গড় অর্থমূল্য প্রায় ২ লাখ ৭২ হাজার ৩৬৪ টাকা। এ হিসাবে কোরাম সঙ্কটে ব্যয়িত সময়ের প্রাক্কলিত অর্থমূল্য প্রায় ৮৯ কোটি ২৮ লক্ষ ৮ হাজার ৭৭৯ টাকা। 

উল্লেখ্য, গবেষণায় গুণবাচক ও পরিমাণবাচক উভয় ধরনের তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে। সরাসরি সম্প্রচারিত সংসদ কার্যক্রমের রেকর্ড এবং মুখ্য তথ্যদাতাদের (সংসদ সদস্য, সরকারি কর্মকর্তা এবং গবেষক) সাক্ষাৎকার গ্রহণ, সংসদ কর্তৃক প্রকাশিত অধিবেশনের সংক্ষিপ্ত কার্যবিবরণী ও কমিটি প্রতিবেদন, সরকারি গেজেট, প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদন, বই ও প্রবন্ধ এবং সংবাদপত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। একই সঙ্গে, জানুয়ারি, ২০১৯ — এপ্রিল, ২০২৩ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ১ম থেকে ২২তম সংসদ অধিবেশনের প্রায় ৭৪৪ ঘণ্টা রেকর্ডিংয়ের অনুলিপি ও নথিপত্র হতে সুনির্দিষ্ট নির্দেশক ও বিষয়বস্তুভিত্তিক ডাটাবেজ প্রস্তুত করে গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রণয়ন করেছে টিআইবি। 

নঈমুদ্দীন/রফিক

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়