ঢাকা     শনিবার   ০৬ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ২২ ১৪৩১

মাতৃভাষা শিক্ষার মাধ্যম হওয়া উচিত: প্রধানমন্ত্রী

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:০২, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪   আপডেট: ১৮:৩৮, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
মাতৃভাষা শিক্ষার মাধ্যম হওয়া উচিত: প্রধানমন্ত্রী

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে মহান শহিদ দিবসের অনুষ্ঠান বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

কর্মক্ষেত্রের প্রয়োজনে বিদেশি ভাষা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা থাকলেও মাতৃভাষা শিক্ষার মাধ্যম হওয়া উচিত বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘মাতৃভাষায় শিক্ষা নিতে পারলে সেই শিক্ষাটা গ্রহণ করা, জানা-বোঝা অনেক সহজ হয়।’

বুধবার (২১ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে রাজধানীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে মহান শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত চার দিনব্যাপী আয়োজনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের শিক্ষার জন্য মাতৃভাষাটা হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মাতৃভাষায় শিক্ষা নিতে পারলে সেই শিক্ষাটা গ্রহণ করা, জানা-বোঝা অনেক সহজ হয়।’

‘কর্মক্ষেত্র যেহেতু এখন সারা বিশ্ব, তাই সারা বিশ্বটা এখন বলতে গেলে এত কাছে চলে এসেছে যে, একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। সেখানে আমাদের কর্মক্ষেত্রে অনেক ভাষা শেখার প্রয়োজন আছে। কিন্তু, আমি দেখেছি আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা অনেক মেধাবী। তাদের জন্য দুটি-তিনটি ভাষা শেখা অনেক কষ্টের কিছু না। অনেকে মাতৃভাষাসহ দুই-তিনটি ভাষায় কথা বলতে পারে।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের শিক্ষার মাধ্যমটা মাতৃভাষায় হওয়া উচিত। পাশাপাশি অন্যান্য ভাষা শিক্ষার সুযোগটাও থাকতে হবে। কারণ, পৃথিবীর সব দেশেই এটা থাকে।’     

‘কিন্তু, দুর্ভাগ্যের বিষয় আমাদের সমাজে দেখা যাচ্ছে, স্কুলে পড়াবে; কিন্তু কিন্ডারগার্টেন শুনলে খুব খুশি হয়, সেখানে পড়াতে হবে। অথচ, আমাদের প্রাইমারি শিক্ষার স্কুল বিল্ডিংগুলো নতুনভাবে করে দিচ্ছি, শিক্ষকদের ভালো ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে, শিক্ষার ভালো ব্যবস্থা আছে। সেটা রেখে ওই নামের পেছনে ছোটা এবং তার জন্য পয়সা খরচ করতে চায়। এটাও আরেকটা বিষয়। সাথে সাথে আবার কোনো পরিবার বিদেশে থেকে এমন হয়ে যায় যে, নিজের মাতৃভাষাটাকে পরিত্যাগ করতে পারলেই যেন বেঁচে যায়।’

বাংলা ভাষার অধিকার কেড়ে নেওয়া এবং ভাষা বিকৃত করার আঘাতটা বারবার এসেছে, উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, আন্দোলন-সংগ্রাম করে ভাষাকে রক্ষা করতে হয়েছে।

এ সময় সমাজে প্রচলিত কিছু মানসিকতার সমালোচনা করে করে শেখ হাসিনা বলেন, কিছু কিছু পরিবার হঠাৎ করে টাকা-পয়সার মালিক হয়ে গেছে। এখন ইংরেজি পারে বলে খুবই দক্ষ হয়ে গেলো! বলা হচ্ছে, স্মার্ট হয়ে গেলো। কিন্তু, স্মার্ট হতে হলে যে একটা ভাষা শিখতে হবে, এটা আমি বিশ্বাস করি না। 

প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যের শুরুতে ভাষা আন্দোলনের শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকারটুকু কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। যখন একটি বিজাতীয় ভাষা আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, তখন এ দেশের মানুষ কিন্তু তা মেনে নেয়নি। প্রকৃতপক্ষে, ১৯৪৮ সালেই আমাদের ভাষা আন্দোলন শুরু, যা ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রক্ত দিয়ে রক্তের অক্ষরে আমাদের শহিদরা বলে গিয়েছিল, মায়ের ভাষায় কথা বলতে চাই। আর এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখনকার আইন বিভাগের ছাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উদ্যোগ নেন, ছাত্র সংগঠন গড়ে তোলেন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। এবং বেশ কয়েকটি প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন নিয়েই ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলা হয়। জাতির পিতার উদ্যোগ ও তার নেতৃত্বেই ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়েই কিন্তু আমরা আমাদের স্বাধীনাতা পেয়েছি। স্বাধীন জাতি হিসেবে আত্মমর্যাদা পেয়েছি।’

‘দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশেই হচ্ছে একটি জাতি রাষ্ট্র, একটি ভাষার রাষ্ট্র। কাজেই সেই মর্যাদাটা আমরা অর্জন করেছি আমাদের মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে।’ 

১৯৭৫ সালের পর বাঙালি সংস্কৃতিটা অনেকটা হারিয়ে যেতে বসে, উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যেসব প্রতিষ্ঠানের নাম বাংলায় দেওয়া হয়েছিল, তা পরিবর্তন করে একটা ভিন্ন ভাষা নিয়ে আসার চেষ্টা চালানো হয়। সেখান থেকে ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। সেই সময়ে মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রবাসী সালাম ও রফিকসহ আরো কিছু প্রবাসী ‘ভালোবাসি মাতৃভাষা’ নামে একটা সংগঠন করে জাতিসংঘে একটা প্রস্তাব দিয়েছিলেন—২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস করা যায় কি না। একটি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেওয়ার জন্য আমাদের জানালে আমরা সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নিই। এ কারণে ২১ ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে আজ স্বীকৃতি পেয়েছে। এটা আমাদের জন্য গৌরবের।’ 

ভাষা সংরক্ষণ ও গবেষণার জন্য আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট করার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

‘সারাবিশ্বে ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। সেগুলো যাতে হারিয়ে না যায়, সেগুলো সংরক্ষণ করা, গবেষণা করা... জীবন-জীবিকার জন্য অনেক ভাষা হয়ত শিখতে হয়। কিন্তু, মাতৃভাষাটাকে সংরক্ষণা করা, এটা প্রত্যেক জাতির একটা কর্তব্য বলে মনে করি। সেই লক্ষ্য নিয়ে আমরা একটা সিদ্ধান্ত নিলাম, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট গড়ে তুলব। আজকে সেই ইনস্টিটিউট এখন ইউনেস্কো কর্তৃক দুই ক্যাটাগরিতে আমরা কিন্তু উন্নীত হতে পেরেছি।’

বক্তব্যের আগে মুজিব শতবর্ষ জাদুঘর ও আর্কাইভের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী ও জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনা।

সেই কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যার নেতৃত্বে ভাংলা ভাষার মর্যাদা পেয়েছি, একটি রাষ্ট্র পেয়েছি, তার জীবনের কার্যক্রমগুলো সংরক্ষণের জন্য যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেজন্য আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটকে ধন্যবাদ জানাই।’

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছিল, অভিযোগ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের ইতিহাস জানতে হবে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, আমাদের দেশে ইতিহাস বিকৃত করা হয়। পঁচাত্তরের পর ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। এখন আর সেই দিন নেই। ইতিহাস কেউ মুছে ফেলতে পারে না। ইতিহাস আপন গতিতে চলে। ইতিহাস কিন্তু সময়মতো উদ্ভাসিত হয়। দেশের মানুষ কিন্তু এটা জানতে পেরেছে।’

‘আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করেছি। আমরা বীরের জাতি। সেই বিজয় নিয়ে যদি মাথা উঁচু করে চলতেই না পারি, তাহলে কীসের বিজয় আমরা নিয়ে আসলাম। পঁচাত্তরের পর এমন একটা সময় এসেছিল, আমরা যে বিজয়ী জাতি, সেটা বলতেই ভুলে গিয়েছিল বা সেই ইতিহাসটা বিকৃত করা হয়েছিল। তেমনই ভাষা আন্দোলন... ১৯৪৮ সাল থেকে যে ভাষা আন্দোলন, সেই ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস কিন্তু বিকৃত করে দেওয়া হয়েছিলো। এখন মানুষ জানতে পারছে, দেখতে পাচ্ছে।’

প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে অনুবাদের ওপর গুরুত্ব দেন এবং সঠিকভাবে অনুবাদ করতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান। 

তিনি বলেন, ‘আমাদের মাতৃভাষাকে রক্ষা করা, চর্চা করা এবং মাতৃভাষাকে আরো শক্তিশালী করে আমাদের শিল্প, কলা, সাহিত্য সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়ে বাঙালি জাতি যে ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে, তা মানুষের সামনে তুলে ধরা আমাদের সকলের কর্তব্য।’ 

এ সময় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট ও বাংলা একাডেমিকে একসঙ্গে সাজ করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, তাহলে আমরা শিল্প-সাহিত্য, কলাসহ বিভিন্ন বিষয়ে অধিক পরিমাণে জানতে পারব।

তিনি বলেন, ‘জাতির পিতা জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়ে বাংলাকে আন্তর্জাতিক মর্যাদা দেন। আমিও যতবার ভাষণ দিয়েছি, বাংলা ভাষায় ভাষণ দিয়েছি। সেটা অনুবাদ করে বিভিন্ন ভাষায় দিয়েছি। আমরা বিজয়ী জাতি, আমাদের একটি ভাষা আছে। আমাদের সংস্কৃতি আছে, সেটা সারা বিশ্ব জানুক।’ 

শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন—প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী রুমানা আলী, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খান, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. হাকিম আরিফ প্রমুখ।

পারভেজ/রফিক

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়