মেরিটাইম শিক্ষার সঙ্গে সুনীল অর্থনীতির নিবিড় সম্পর্ক: নৌ প্রতিমন্ত্রী

নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে মেরিটাইম শিক্ষা ও সুনীল অর্থনীতির নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। সমুদ্রে বাংলাদেশের অধিকার, আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমা, সমুদ্র আইন, সমুদ্রে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অঞ্চল, রাজনৈতিক সমুদ্রসীমা; সমুদ্রের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা লাভের জন্য মেরিটাইম শিক্ষার কোনও বিকল্প নেই।

বুধবার (৫ জুন) রাজধানীর বিয়াম ফাউন্ডেশনে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় আয়োজিত ‘বাংলাদেশের মেরিটাইম শিক্ষাব্যবস্থা ও সুনীল অর্থনীতি’ শীর্ষক সেমিনারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

এ সময় প্রতিমন্ত্রী বলেন, প্রশিক্ষিত ক্যাডেটরা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জাহাজ ও জাহাজসংশ্লিষ্ট চাকরি এবং সমুদ্রগামী জাহাজে চাকরির পাশাপাশি জাহাজ নির্মাণ ও মেরামত, বন্দর ব্যবস্থাপনা; বন্দর পরিচালনা ও প্রশিক্ষকসহ বিভিন্ন শোর জবের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশি সি-ফেয়ারারদের চাহিদার প্রেক্ষিতে ২০২১ সালে পাবনা, বরিশাল, সিলেট এবং রংপুর চারটি মেরিন একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এভাবে দেশের প্রতিটি বিভাগে মেরিন একাডেমি প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা রয়েছে। মেরিটাইম সেক্টরের বিপুল সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর লক্ষ্যে নাবিকদের (রেটিং) প্রশিক্ষণের জন্য দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম, রাজশাহী ও মেহেরপুর জেলায় নতুন চারটি ন্যাশনাল মেরিটাইম ইন্সটিটিউট স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মেরিনারদের উচ্চতর শিক্ষা অর্জনের জন্য ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চট্টগ্রামে বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি) প্রতিষ্ঠা করেন ও বিএসসির জন্য ১৯টি জাহাজ সংগ্রহ করেন। দেশের নৌপরিবহন ও মেরিটাইম খাতে বিদেশি নাবিকের স্থলে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত আন্তর্জাতিক মানের দেশি নাবিক তৈরির লক্ষ্যে জাতির পিতা মেরিন একাডেমির মানোন্নয়নের জন্য ব্রিটিশ কারিগরি সহায়তায় বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি উন্নয়ন পরিকল্পনা, ১৯৭৩ শীর্ষক প্রকল্প গ্রহণ করেন। ১৯৭২ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি, চট্টগ্রাম থেকে মোট ৫ হাজার ৩৬৬ জন ক্যাডেট প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। নারীর ক্ষমতায়নের অংশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় এই একাডেমির ৪৮তম ব্যাচ থেকে নারী ক্যাডেট ভর্তি করা হচ্ছে এবং প্রশিক্ষিত নারী ক্যাডেটগণ সুনামের সঙ্গে বিভিন্ন সমুদ্রগামী জাহাজে কর্মরত রয়েছেন। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের সময় ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশি জাহাজে দু’জন নারী ক্যাডেট ছিলেন। তারা সেসময় সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন, যা অন্য নারী ক্যাডেটদের কাছে অনুকরণীয়।

খালিদ মাহমুদ চৌধুরী আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার পরিচালনার সময় মিয়ানমার এবং ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা জয় করেন। এর ফলে ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল ও চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৪৫ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহিসোপানের তলদেশে সব ধরনের প্রাণিজ-অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রে বিরোধপূর্ণ ১৭টি ব্লকের ১২টি পেয়েছে বাংলাদেশ এবং ভারতের কাছ থেকে দাবিকৃত ১০টি ব্লকের সবগুলোই পেয়েছে বাংলাদেশ। এসব ব্লক থেকে প্রায় ৪০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সুনীল অর্থনীতির চারটি ক্ষেত্র যেমন- তেল ও গ্যাস উত্তোলন, মৎস্য আহরণ, বন্দর সম্প্রসারণ এবং পর্যটন খাতে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করলে বছরে বাংলাদেশের পক্ষে ২.৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করা সম্ভব। বাংলাদেশ বর্তমানে উপকূল থেকে মাত্র ৩৫-৪০ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে মৎস্য আহরণ করে থাকে। বঙ্গোপসাগরে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া, শামুক-ঝিনুক এবং বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক ও জৈব গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ রয়েছে। মৎস্যসম্পদ ছাড়াও সামুদ্রিক প্রাণী, সামুদ্রিক আগাছা, লতা-গুল্মতেও ভরপুর বঙ্গোপসাগর। আগাছা প্রক্রিয়াজাত করে বিভিন্ন রোগের ওষুধ তৈরি করা যায়। ‘স্পিরুলিনা’ নামক আগাছা চীন, জাপান, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মানুষ খাদ্য হিসেবে খেয়ে থাকেন। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে সামুদ্রিক খাদ্যপণ্য রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। বঙ্গোপসাগরের তলদেশে ১৩টি স্থানে ইউরেনিয়াম ও থোরিয়াম সমৃদ্ধ বালুর সন্ধান পাওয়া গেছে। এ ছাড়া, বঙ্গোপসাগরে ইলমেনাইট, টাইটেনিয়াম অক্সাইড, রুটাইল, জিরকন, ম্যাগনেটাইট, কোবাল্টসহ অত্যন্ত মূল্যবান খনিজের সন্ধান পাওয়া গেছে। এসব সম্পদ সঠিক উপায়ে উত্তোলন করতে পারলে হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব হবে।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সমুদ্রকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। বাংলাদেশও অফশোর এবং অনশোরে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করছে, যা হবে ক্লিন ও গ্রিন এনার্জি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুনীল অর্থনীতির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। এর বিপুল সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে প্রণয়ন করা হয়েছে ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ (ডেল্টা প্লান ২১০০)। সুনীল অর্থনীতিকে কাজে লাগাতে বন্দরগুলো সম্প্রসারণ ও আপগ্রেডেশন করা হয়েছে। সমুদ্র সম্পদ আহরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য প্রয়োজন যথাযথ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ। বাংলাদেশকে উন্নত বিশ্বের কাতারে উন্নীত করতে হলে সকল সেক্টরের পাশাপাশি মেরিটাইম সেক্টরকেও সমৃদ্ধ করতে হবে। বাংলাদেশে মেরিটাইম শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল তৈরি করে সমুদ্র সম্পদকে যথাযথ আহরণ ও ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। 

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোস্তফা কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব দেলোয়ারা বেগম। বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান ড. এ কে এম মতিউর রহমান মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।