ঢাকা     শনিবার   ০৬ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ২২ ১৪৩১

ব্রাহমা গরু কি বাংলাদেশে নিষিদ্ধ?

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৫০, ৩ জুলাই ২০২৪   আপডেট: ১৬:৫৩, ৩ জুলাই ২০২৪
ব্রাহমা গরু কি বাংলাদেশে নিষিদ্ধ?

ব্রাহমা গরু/ ফাইল ছবি

গণমাধ্যম থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্রায় সর্বত্র ব্রাহমা জাতের গরু দেশে অবৈধ বা নিষিদ্ধ বলে এক ধরনের প্রচার লক্ষ্য করা যায়। যদিও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ বিষয়ে সরকারিভাবে সুস্পষ্ট নির্দেশনা নেই। এমনকি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আমদানিনীতিতে ব্রাহমা জাতের গরুর সীমেন আমদানিতেও বাধা নেই বলে জানান তারা।   
 
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আমদানিনীতি আদেশ ২০২১-২৪-এর ৩৪ ধারায় গবাদিপশুর হিমায়িত সীমেন (এইচএস হেডিং ০৫.১১ এর অধীন শ্রেণিবিন্যাসযোগ্য) আমদানি বিষয়ে এর ক-উপধারায় দেখা যাচ্ছে, (ক) গবাদিপশুর হিমায়িত সীমেন ও এমব্রায়ো, ফ্রিজিয়ান, ফ্রিজিয়ান ক্রস, শাহিওয়াল, শাহিওয়াল ক্রস, ফ্রিজিয়ান-শাহিওয়াল ক্রস, এএফএস, এএফএস ক্রস জাতের গবাদি পশুর হিমায়িত সীমেন (ডিপ ফ্রোজেন সীমেন) ব্যাতীত অন্যান্য গরুর সীমেন আমদানি নিষিদ্ধ। তবে শর্ত থাকে যে, ফ্রিজিয়ান, ফ্রিজিয়ান ক্রস, শাহিওয়াল, শাহিওয়াল ক্রস, ফ্রিজিয়ান-শাহিওয়াল ক্রস, এএফএস, এএফএস ক্রস, ব্রাহমা, মুরাহ, নিলিরাভি এবং Mediterannean মহিষের জাতের গবাদি পশুর হিমায়িত সীমেন (ডিপ ফ্রোজেন সীমেন), এমব্রায়ো আমদানি করা যাবে। অর্থাৎ এই নীতি আদেশে ব্রাহমা জাতের গরুর সীমেন আমদানিতে বাধা নেই। 

২০১৬ সালে করা বেসরকারি পর্যায়ে গবাদিপশুর কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রম পরিচালনার সংশোধিত নীতিমালাতে সীমেন আমদানি ও ব্যবহারে শর্ত জুড়ে দেওয়া থাকলেও কোথাও উল্লেখ করা হয়নি বাংলাদেশে ব্রাহমা গরু নিষিদ্ধ বা ব্রাহমার সীমেন ব্যবহার নিষিদ্ধ। ২০০৭ সালের জাতীয় প্রাণিসম্পদ নীতিমালাতেও ব্রাহমাকে নিরুৎসাহিত করার মতো কিছু নেই।

২০১৩ সালের জুলাইয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অধীনে বিফ ক্যাটল ডেভেলপমেন্ট নামে প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। ওই সময়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মো. আইনুল হক ওই প্রকল্পের মধ্যবর্তী মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বাংলাদেশে ব্রাহমা জাতের গরুর লালন-পালন কতোটা বা কেন দরকার এ প্রসঙ্গে লেখেন, বাংলাদেশে ইতোপূর্বে একটি টেকসই, লাভজনক এবং অধিক মাংস উৎপাদনকারী গরুর কোনও জাত না থাকায় চাহিদার তুলনায় প্রাণিজ আমিষের উৎপাদন অত্যক্ত কম ছিল। ইতোমধ্যে দেশ মাংসে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। এখন প্রয়োজন এর ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রাখা। একটি দেশীয় গরুর প্রাপ্ত বয়সে মাংস উৎপাদন ক্ষমতা গড়ে মাত্র ৭০-৮০ কেজি, সেখানে ব্রাহমা জাতের একটি প্রাপ্তবয়স্ক (২০-২৪ মাস) গরুর মাংস উৎপাদন ক্ষমতা গড়ে ৭০০-৮০০ কেজি বা কোনও কোনও ক্ষেত্রে আরও বেশি। তাই, মাঠ পর্যায়ের কৃষক/খামারিদের মধ্যে ব্রাহমা জাতের গবাদিপশু পালনে আগ্রহ ও উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হয়েছে। এই প্রকল্পটি পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হলে ২-৩ বছর বয়সে একটি গরুর ওজন প্রায় ২৭ মণ বা ১ মেট্রিক টন পর্যন্ত হতে পারে। সঠিক মাত্রায় খাদ্য প্রদান করলে বাংলাদেশে একটি ব্রাহমা জাতের বাছুর দৈনিক গড়ে ৯০০-১০০০ গ্রাম পর্যন্ত ওজন বৃদ্ধি পায়।

ওই প্রকল্প মূল্যায়নের ৭ম অধ্যায়ে করা সুপারিশের ৪ নম্বর পয়েন্টে বলা হয়, বাণিজ্যিক ব্রাহমা খামার স্থাপন ও পরিচালনার জন্য আগ্রহী খামারিকে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতাসহ ফেসিলিটেটরের ভূমিকা পালন করতে হবে। আর ৮ নম্বর পয়েন্টে ব্রাহমা জাতের গরু লালন-পালনকে এগিয়ে নেওয়ার সুপারিশ করে বলা হয়, বাংলাদেশের আবহাওয়ায় টেকসই ও উপযোগী, এর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি এবং খামারিদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে বিধায় প্রকল্প এলাকা ছাড়াও রিজিওলান ব্রিডিং পলিসির আলোকে রিজিওনভিত্তিক এ কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা যেতে পারে।

এই মূল্যায়ন কমিটিতে ছিলেন ওই সময়ের পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, প্রাণিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সহকারী প্রধান গাজী শরিফুল হাসান, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিকল্পনা সেল প্রধান মো. আবুল বাশার, পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ আইএমইডির উপ-পরিচালক আফরোজা আকতার চৌধুরী, প্রকল্প পরিচালক এসএমএ সামাদসহ কয়েকটি বিভাগের প্রতিনিধিগণ। 

ব্রাহমা জাতের গরুর বিষয়ে বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শাহ ইমরানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, বাংলাদেশের কোনো আইন ও নীতিমালার কোথাও ব্রাহমা জাতের গরু লালন পালন, সীমেন আমদানি ও বিধি মেনে ব্যবহারেও বাধা দেওয়া হয়নি। তিনি দাবি করেন, এই জাতটির আদি নিবাস যেহেতু ভারতীয় উপমহাদেশ তাই বাংলাদেশের আবহাওয়ার জন্য বেশ উপযোগী। এমনকি, ফ্রিজিয়ান জাতের গরু পালতে যেখানে তুলনামূলক ঠান্ডা আবহাওয়া তৈরিতে খামারিকে ফ্যান-এসি চালাতে হয়, সেখানে ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাতেও স্বাভাবিক থাকে ব্রাহমা।

এ প্রসঙ্গে বিফ ক্যাটল ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের পরিচালক এসএমএ সামাদ জানান, তারও জানা নেই নতুন কোনো আইন করে ব্রাহমাকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছে কি না। তবে তিনি মনে করেন, কী পরিমাণ খাবার খেয়ে কী পরিমাণ ওজন হবে, সেই রেট ব্রাহমার অনেক ভালো। মাংসে চর্বির পরিমাণও তুলনামূলক কম। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের কম পুঁজির খামারি বা গৃহস্থ বাড়িতে খুব সহজেই এই জাতের গরুর লালন-পালন করে কম মূল্যে বাজারে মাংসের চাহিদা মেটানো সম্ভব।

তাহলে ব্রাহমার লালন-পালন ও বাজারজাতকরণ নিয়ে কেন এতো বিতর্ক? এ প্রসঙ্গে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মোহাম্মদ রেয়াজুল হক বলেন, বাংলাদেশের কোনো আইন-নীতিমালার কোথাও ব্রাহমা নিষিদ্ধ বলা নেই। তারপরও আমরা শখের বসে ছাড়া বাণিজ্যিক পরিসরে এই জাতের গরু লালন পালনের অনুমতি দিই না। যদিও মাংস উৎপাদনের জন্য এই জাতের গরুর খ্যাতি রয়েছে। 

কেন অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না? এ প্রশ্নে তিনি বলেন, দুধে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে এত দিনের চেষ্টায় দেশি জাতের সঙ্গে ফ্রিজিয়ান, হলস্টিয়ানের ক্রস করে অনেক বেশি দুধ উৎপাদনের জাতের সম্প্রসারণ করা হয়েছে। ব্রাহমার দুধ খুবই কম হয়। দুই তিন লিটারের মধ্যেই থাকে। এখন যদি ব্রাহমার সীমেন ব্যবহার বাড়িয়ে দেওয়া হয় তাহলে অসতর্কতাবশত দুধের জাতের গাভীতে এটি কোনও কারণে চলে গেলে দুধের লাইনটি নষ্ট হয়ে যাবে। 

দেশে একদিকে গরুর মাংসের দাম বেড়ে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে, সেখানে ব্রাহমার মতো মাংস উৎপাদনকারী জাতের গরু বাংলাদেশের নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। এটা কতোটা যৌক্তিক এমন প্রশ্নে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যানিমেল সায়েন্স ও ভেটেরিনারি মেডিসিন অনুষদের ডিন ড. অধ্যাপক কেবিএম সাইফুল ইসলাম জানান, ব্রাহমা বাংলাদেশে নিষিদ্ধ এমন তথ্য তার কাছে নেই। তবে, মাংস উৎপাদন করতে গিয়ে দুধের গরুর উৎপাদনশীলতা নষ্ট হয়ে যাবে, এমন যুক্তিতে বিভিন্ন সভা-সেমিনারে ব্রাহমা জাতের গরু নিরুৎসাহিত করতে দেখা গেছে। 

দেশের মানুষকে তুলনামূলক কম মূল্যে গরুর মাংস দিতে চাইলে ব্রাহমার মতো মাংস উৎপাদনকারী জাতের গরুর লালন-পালনে জোর দেওয়া উচিত বলে মনে করেন কেবিএম সাইফুল ইসলাম। তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, সেটা করতে গিয়ে এরই মধ্যে দুধ উৎপাদনের সফলতা যেন নষ্ট হয়ে না যায়। কীভাবে খামারিদের উৎসাহিত করা হবে, কীভাবে এমন জাতের গরুর সীমেন মাঠ পর্যায়ে সরবরাহ করা হবে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট নীতিমালা দরকার । 

ব্রাহমা সম্পর্কে তিনি বলেন, এই জাতটি বাংলাদেশের আবহাওয়ার সঙ্গে বেশি উপযোগী। এটি ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো উচ্চ তাপমাত্রাতেই স্বাভাবিক আচরণ করে। মাংসের দাম কমাতে চাইলে এমন জাতের গরুর বিকল্প নেই। শুধু গরু নয়, ছাগলের এমন মাংস উৎপাদনকারী জাতের সম্প্রসারণ করা দরকার বলেও মনে করেন তিনি। 

এমএ/এনএইচ

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়