‘মুসলিম দেশগুলো ঐক্যবদ্ধ না হলে ফিলিস্তিন মুক্ত করা সম্ভব নয়’
‘মুসলিম দেশগুলো ঐক্যবদ্ধ না হলে ফিলিস্তিন মুক্ত করা সম্ভব নয়। মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি না হওয়ার পেছনে কারণ হলো, দেশগুলোতে ইসলামপন্থি সরকার না থাকা। যদি দেশগুলোতে ইসলামপন্থি সরকার থাকত, তাহলে মুসলমানরা একতাবদ্ধ হওয়ার সুযোগ লাভ করত।’
শুক্রবার (১ নভেম্বর) ফিলিস্তিন-লেবাননে ইসরায়েলের অব্যাহত হামলার প্রতিবাদে আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। আল-কুদস কমিটি বাংলাদেশের উদ্যোগে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) মিলনায়তনে ‘মহান নেতা ইসমাঈল হানিয়া, সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ ও ইয়াহিয়া ইবরাহীম হাসান আস সিনওয়ারসহ শীর্ষ নেতাদের শাহাদাত ও গাজা-ফিলিস্তিনকেন্দ্রিক প্রতিরোধ অক্ষের অর্জন’ শীর্ষক এ আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের চেয়ারম্যান ও আল কুদস কমিটি বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক ড. শাহ্ কাউসার মুস্তাফা আবুলউলায়ীর সভাপতিত্বে সভায় আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইরানের আল মুস্তফা (সা.) আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলেমিন শাহাবুদ্দীন মাশায়েখী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সিনিয়র প্রফেসর ড. কেএম সাইফুল ইসলাম খান, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব অধ্যাপক ড. আহমদ আব্দুল কাদের, সাংবাদিক অধ্যক্ষ মুহাম্মাদ শওকাত হোসেন, ইসলামী শিক্ষা উন্নয়ন পরিষদ বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যক্ষ ড. এ কে এম মাহবুবুর রহমান। আলোচনা সভায় প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক জামাল উদ্দিন বারী।
হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলেমিন শাহাবুদ্দীন মাশায়েখী বলেন, ৭০ বছরের অধিক সময় ধরে জায়নবাদী ইসরায়েল ফিলিস্তিনের জনসাধারণের ওপর নির্যাতন চালিয়ে আসছে এবং তাদের ভূখণ্ড জবরদখল করে যাচ্ছে। আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে পরাজয়ের পর প্রথমে মিশর ও জর্ডান এবং এর পর আরব বিশ্বের দেশগুলো ইসরায়েলমুখী হয়ে পড়ে। কিন্তু, গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের আক্রমণের পর পরিস্থিতি সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হয়ে যায়। যেখানে আরব বিশ্ব মাত্র কয়েক দিনে পরাজিত হয়েছিল, সেখানে ফিলিস্তিনের যোদ্ধারা মাসের পর মাস তাদের প্রতিরোধ সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। ফিলিস্তিনের পাশে লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুথি, ইরাকের প্রতিরোধ যোদ্ধারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করছে। ইরান সরাসরি ইসরায়েলের সামরিক স্থাপনাগুলোতে আক্রমণের মাধ্যমে ইসরায়েলকে কোণঠাসা করে ফেলেছে। এসব আক্রমণে ইসরায়েলের সামরিক শক্তি ও তাদের তথাকথিত শক্তিশালী এয়ার ডিফেন্সের দুর্বলতা স্পষ্টভাবে ধরা পড়ছে। প্রতিরোধ যোদ্ধাদের মোকাবিলায় ইসরায়েলের অর্থনীতিতে চরম ধস নেমেছে। প্রবৃদ্ধির হার নিম্নগামী হয়ে পড়েছে। সামরিক ব্যয় মেটাতে তাদের অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আতঙ্কে ইহুদিরা ইসরায়েল ত্যাগ করে অন্য দেশে চলে যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, কিছু কিছু দেশ মৌখিকভাবে ফিলিস্তিনকে সমর্থন করার কথা বলে ইসরায়েলের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। ইসরায়েল ও তার দোসরদের নিজেদের ভূমি ব্যবহার করতে দিয়ে ফিলিস্তিন ও প্রতিরোধ আন্দোলনের জন্য সংগ্রামরত দেশগুলোতে আক্রমণের সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে। এরকম কপটতা পরিহার করে যদি সত্যিকার অর্থে মুসলমানরা একতাবদ্ধ হয়ে জায়নবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে, তাহলেই মুসলমানরা সফল হতে পারে।
ড. আহমদ আব্দুল কাদের বলেন, গত বছরের অক্টোবর মাসের আগে আরব বিশ্বের পরিস্থিতি এমন হয়ে পড়েছিল যে, কতিপয় আরব দেশ ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়ার চিন্তা করতে থাকে। কিন্তু, অক্টোবর মাসের যুদ্ধ সব হিসাবনিকাশকে বদলে দেয়। আরব দেশগুলো নিজেদের পরিকল্পনা থেকে দূরে সরে আসতে বাধ্য হয়।
তিনি বলেন, মুসলিম দেশগুলো ঐক্যবদ্ধ না হলে ফিলিস্তিন মুক্ত করা সম্ভব নয়। মুসলমানদের ঐক্য সৃষ্টি না হওয়ার পেছনে কারণ হলো দেশগুলোতে ইসলামপন্থি সরকার না থাকা। যদি দেশগুলোতে ইসলামপন্থি সরকার থাকত, তাহলে মুসলমানরা একতাবদ্ধ হওয়ার সুযোগ লাভ করত।
তিনি ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের উদাহরণ টেনে বলেন, ইরানে বিপ্লব হওয়ার কারণেই তাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছে মজলুম ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়ানোর।
অধ্যাপক ড. শাহ্ কাউসার মুস্তাফা আবুলউলায়ী বলেন, মুসলিম বিশ্বে বর্তমানে যে সংকট বিরাজ করছে, তা মোকাবিলায় মুসলমানদের ঐক্যের বিকল্প নেই। মুসলিম দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমেই কেবল দানবীয় ইহুদিবাদী আগ্রাসনকে প্রতিহত করা সম্ভব। ন্যাটোর মতো মুসলিম দেশগুলোর একটি সামরিক জোট গঠন করা এখন সময়ের দাবি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো অর্থনৈতিক জোট গঠন করে মুসলিম দেশসমূহ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারে।
অধ্যক্ষ ড. এ কে এম মাহবুবুর রহমান বলেন, ইমাম খোমেনি (রহ.) মুসলমানদের দুর্বলতার অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন যে, মুসলমানরা তাদের শত্রু-মিত্র চিনতে পারে না। আর যারা চিনতে পারে, তারা শাসনক্ষমতাকে আঁকড়ে থাকার লোভে ইসলামের শত্রুদেরকে সহযোগিতা করে। তাই, আমাদের প্রয়োজন শত্রু-মিত্রকে চেনা। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে ফিলিস্তিন প্রসঙ্গ আসা দরকার, যাতে তরুণ প্রজন্ম এ বিষয়ে জানতে পারে, সচেতন হতে পারে।
প্রফেসর ড. কে এম সাইফুল ইসলাম খান বলেন, মুসলমানরা নিজেদের কর্মের দ্বারাই নিজেদের পরিচয় হারিয়ে ফেলেছে। মহান আল্লাহ বলেন, তোমরাই বিজয়ী হবে, যদি তোমরা মুমিন হও। অথচ, আমাদের ইমান দুর্বল হয়ে গেছে। আমরা বস্তুগত বিষয় নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছি যে, মূল বিষয় ছেড়ে অন্য বিষয়ে মত্ত হয়ে পড়েছি। ইয়েমেনের অর্থনীতি দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও সে দেশের জনগণ ইমানের বলে বলীয়ান হয়ে ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়িয়েছে। অথচ, আরববিশ্ব নীরব। আল্লাহ আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন একতাবদ্ধ হওয়ার জন্য, কিন্তু আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। এর পেছনে ইসরায়েলের ষড়যন্ত্রও সবার কাছে স্পষ্ট। আর আল্লাহ তাআলার আদেশের বিপরীতে গিয়ে সফল হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই।
সাংবাদিক জামাল উদ্দিন বারী বলেন, ইসরায়েলি আগ্রাসনে গত ১৩ মাসে মুসলমানদের পূণ্যভূমি ফিলিস্তিনের গাজা শহরকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয়েছে। নির্বিচার হত্যা করা হয়েছে প্রায় ৪৫ হাজার ফিলিস্তিনিকে। এদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। ইসরায়েলি বোমায় লক্ষাধিক ফিলিস্তিনি আহত হয়েছেন। গাজা উপত্যকার ২০ লাখের বেশি মানুষকে উদ্বাস্তু বানানোর পাশাপাশি চরম খাদ্য সংকট, দুর্ভিক্ষ ও মানবেতর জীবনে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। সেখানে ইরান ছাড়া আর কোনো আরব দেশকে সামরিক-অর্থনৈতিক সহায়তা নিয়ে ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়াতে দেখা যাচ্ছে না। এ এক বিস্ময়কর বাস্তবতা। বিশ্ব জনমত ফিলিস্তিনিদের পক্ষে থাকলেও আরব শাসকরা এখনো ইঙ্গ-মার্কিনিদের কৃত্রিম দোস্তি ত্যাগ করে আল আকসা ও আরব ফিলিস্তিনিদের রক্ষায় দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে পারেনি।
আলোচনা সভার শুরুতেই ফিলিস্তিনের ওপর এক প্রামাণ্যচিত্র দেখোনো হয়। সভা শেষে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রেস ক্লাবের সামনে থেকে একটি প্রতিবাদ মিছিল বের হয়ে তা জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে গিয়ে শেষ হয়।
হাসান/রফিক