বিক্ষোভ-সংঘর্ষে উদ্বিগ্ন মানুষ, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে সরকার
যাত্রাবাড়ীর ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে হামলা চালিয়ে জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়া হচ্ছে
কয়েক দিন ধরে ঢাকার বিভিন্ন কলেজে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনার জেরে বিক্ষোভ-সংঘর্ষে রাজধানীতে জনজীবনে অস্বস্তি বিরাজ করছে। এসব ঘটনায় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘‘এ ধরনের সংঘাতের পেছনে কোনো ধরনের ইন্ধন থাকলে তা কঠোর হাতে দমন করা হবে।’’ এছাড়া চলমান পরিস্থিতি কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বলেও সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে দুই উপদেষ্টা যা বললেন
দেশে পরিকল্পিতভাবে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা চলছে। সেটি না হলে একদিনে এতগুলো ঘটনা কোনোভাবেই কাকতালীয় নয় বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম।
রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব কথা বলেন তিনি। ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশের দুর্বলতা স্বীকার করে সবাইকে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি বর্জন করে সভা-সমাবেশের আহ্বান জানান। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি ঐক্যের আহ্বান জানান নাহিদ।
তিনি বলেন, ‘‘অনেকগুলো ঘটনা আজ (২৫ নভেম্বর) ঘটেছে। এর মধ্যে দেখা গেছে-ভোররাত থেকে ঢাকায় বাস, মাইক্রোবাসে করে কিছু সাধারণ মানুষকে নিয়ে আসা হয়েছে ঋণ দেওয়ার নাম করে। অহিংস গণঅভ্যুত্থানের নামে একটি প্ল্যাটফরম পুরো মিথ্যা প্রচারণা করে মানুষকে নিয়ে এসেছে। ওই প্ল্যাটফরমের আহ্বায়ককে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।’’
তিনি বলেন, ‘‘পরিকল্পিতভাবে অস্থিরতা তৈরি করার চেষ্টা চলছে। বড় কোনো পরিকল্পনা না থাকলে একদিনে এতগুলো ঘটনা কাকতালীয় না। আমরা মনে করছি, এখানে নানা পক্ষের পরিকল্পনা আছে। সরকার সফলভাবে প্রশাসনিক কার্যক্রম করুক, এটা হয়তো অনেকেই চাইছে না। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার নানাভাবে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে।’’
উপদেষ্টা নাহিদ বলেন, ‘‘পুলিশে একটা বড় পরিবর্তন এসেছে। প্রশাসনে স্থবিরতা কাটানোর জন্য আমরা একটা বড় পরিকল্পনা করছি। এগুলো নস্যাৎ করতে আমাদের এসব ঘটনায় ব্যস্ত রাখতে অ্যাটেনশন এদিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কিনা এটা আমাদের সন্দেহ হচ্ছে। আমরা এটা ইনভেস্টিগেট করছি, এই ঘটনার সঙ্গে দেশে কিংবা দেশের বাইরে কারা জড়িত।’’
রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘যেহেতু একটা অভ্যুত্থান পরবর্তী পরিস্থিতিতে আমরা আছি। সবার ভেতরে একটা বিপ্লবী চেতনা আছে, সেটা যেন আমরা ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করি। আমরা যেন সবার মধ্যে সচেতনতা তৈরি করি। এখানে রাজনৈতিক দলগুলো সবার ভূমিকা নেয়ার আছে। আমরা মনে করি, গণঅভ্যুত্থানে আমাদের মধ্যে যেরকম ঐক্য ছিল, বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারের অংশীদারিত্ব সবারই আছে।’’
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশের দুর্বলতা স্বীকার করে উপদেষ্টা নাহিদ বলেন, যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পুলিশের দুর্বলতা ছিল। দুর্বলতা ছিল বলেই এটি সংঘর্ষের দিকে গেছে, এটা আমরা স্বীকার করছি। কিন্তু পুলিশ তো একটা পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। যেখানে এত শিক্ষার্থী যখন নেমে এসেছে, তাদের মুখোমুখি হলে অবস্থা আরও খারাপের দিকে যেত। প্রাথমিকভাবে পুলিশ বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছে কিন্তু তারা শিক্ষার্থীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়নি। পরবর্তীতে সেনাবাহিনী ও পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে।’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘পুলিশের দুর্বলতা থাকলে সেটা আমরা আইডেন্টিফাই করার চেষ্টা করছি। পুলিশকে আরও বেশি সক্রিয় করার জন্য একটা বড় ধরনের রদবদল করা হয়েছে। এটা চলমান থাকবে। যারা যেসব জায়গায় ব্যর্থ হচ্ছে তাদের আমরা পরিবর্তন করবো।’’
নাহিদ বলেন, ‘‘প্রথম আলো নিয়ে একটি উত্তেজনা দেখতে পাচ্ছি কয়েকদিন ধরে। গতকালও এরকম উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল অফিসের সামনে। রাজশাহীতে তাদের অফিসে ভাঙচুর হয়েছে এবং চট্টগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ হয়েছে। কোনো গণমাধ্যম বা পত্রিকার বিরুদ্ধে যদি জনগণের কোনো অংশের অভিযোগ থাকে, ক্ষোভ থাকে, তারা সেটি প্রকাশ করতে পারে। তবে সেটি অবশ্যই শান্তিপূর্ণভাবে হতে হবে। কোনো পত্রিকা অফিসে ভাঙচুর করা, পত্রিকা বন্ধের জন্য চাপ প্রয়োগ করা-আমরা সমর্থন করি না। এই ধরনের ঘটনা পরে ঘটলে টলারেট করা হবে না।’’
পুলিশের বাধা টপকে হামলা হয়েছে: আসিফ
পুলিশের বাধা টপকে গিয়ে শিক্ষার্থীরা ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে হামলা করেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।
তিনি বলেন, ‘‘পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যাত্রাবাড়ী অংশে তাদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু বাধা টপকে তারা চলে যায়। আমাদের জানানো হয়েছে, শেষ পর্যন্ত পুলিশ ও সেনাবাহিনী ঘটনা দমানোর চেষ্টা করে। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে।’’
তিনি বলেন, ‘‘হতাহতের বিষয়ে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া চলমান আছে। এই ধরনের ঘটনাকে অবশ্যই টলারেট করা হবে না। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে যারা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অনেক কিছু শোনা যাচ্ছে, তদন্ত করে আমরা ব্যবস্থা নেব।’’
হাসপাতালে ৭৩
যাত্রাবাড়ীর কাজলায় তিন কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে অনেক শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৩৩ জন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে এবং ৪০ জন ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেন।
ঢামেক পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ (পরিদর্শক) মোহাম্মদ ফারুক বলেন, ‘‘সংঘর্ষে আহত হয়ে এ পর্যন্ত ৩৩ জন শিক্ষার্থী ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে এসেছেন। তাদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।’’
এদিকে, সংঘর্ষে আহত হয়ে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছেন ৪০ জন। তারা সবাই কবি নজরুল ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থী বলে জানা গেছে।
ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজে দায়িত্বরত (জরুরি বিভাগে) ডা. মো. রাশেদুল হাসান বিষয়টি জানিয়েছেন।
সংঘর্ষে কোনো শিক্ষার্থী নিহত হয়নি
সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল কলেজ এবং ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধাওয়া ও পাল্টা ধাওয়া এবং সংঘর্ষের ঘটনায় কেউ নিহত হয়নি বলে জানিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)।সোমবার (২৫ নভেম্বর) সন্ধ্যায় ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান এ তথ্য জানিয়েছেন।
এদিকে তিন শিক্ষার্থী নিহতের খবর গুজব বলে জানিয়েছেন মোল্লা কলেজের ইংরেজি ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক আব্দুল্লাহ আল মানিক।
উদ্বিগ্ন মানুষ, জনজীবনে ভীতি
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় আটকে পড়ে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে অনেক মানুষকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বিবিসিকে বলেন, ‘‘কেউ বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন আবার কেউ ভুল বুঝাবুঝির সূত্র ধরে অস্থিরতায় জড়িয়ে পড়ছেন।’’
“সব মিলিয়ে মানুষের ভোগান্তির ঘটনা বাড়ছে। শহরের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় এগুলো হচ্ছে। আর এগুলোর সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া। মানুষকে খোঁজ নিয়ে ঘর থেকে বের হতে হচ্ছে যে তিনি ঠিকমতো গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবেন কি না।”
শিক্ষার্থীদের শান্ত থাকার আহ্বান সরকারের
শিক্ষার্থীদের কোনো ধরনের সংঘর্ষে না জড়িয়ে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছে সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ ধরনের সংঘাতের পেছনে কোনো ধরনের ইন্ধন থাকলে তা কঠোর হাতে দমন করা হবে।
রাজধানীতে কয়েকটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় সোমবার (২৫ নভেম্বর) প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘‘সম্প্রতি বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে সংঘাত-সংঘর্ষ হয়েছে, সরকার তার প্রতি নজর রাখছে। আমরা ছাত্র-ছাত্রীদের কোনো ধরনের সংঘর্ষে না জড়িয়ে শান্ত থাকার আহ্বান জানাচ্ছি।’’
ঢাকা/এসবি