ঢাকা     বুধবার   ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ১০ ১৪৩১

আগুনঝরা উল্লাসের ‘দাগ’ জাতীয় সংসদে

আসাদ আল মাহমুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৩২, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪  
আগুনঝরা উল্লাসের ‘দাগ’ জাতীয় সংসদে

সময়ের ঘড়ি থেমে নেই, ঘুরছে তো ঘুরছে।  প্রতি সেকেন্ড-মিনিটের সঙ্গে মিশে থাকে মানুষের সুখ-দুখের দিনলিপি। বিদায় নিচ্ছে খ্রিষ্টীয় ২০২৪ সাল, আসছে ২০২৫।

বিদীয় ২০২৪ সাল দ্রোহের বছর, এক নতুন জাগরণের বছর। বৈষম্যহীন দেশ গড়ার নবযাত্রা শুরু করেছে বাংলাদেশ।

২০২৪ সালের শুরু থেকে দেশে জনৈতিক উত্তাপ, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিক্ষোভের মুখে ক্ষমতার পালাবদল ছিল সবচেয়ে বেশি আলোচনায়। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ঘটে সেই পালাবদল।

আরো পড়ুন:

গত ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারতে পলায়নের মধ্য দিয়ে পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের। 

ছাত্র–জনতার বিক্ষোভের মুখে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে দেশত্যাগের পর (দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বা কেপিআই-কী পয়েন্ট ইনস্টলেশন) জাতীয় সংসদ ভবনে ঢুকে পড়েন হাজার হাজার উল্লসিত মানুষ। তাদের মধ্যে কেউ কেউ জাতীয় সংসদ ভবন থেকে সোফা, সাউন্ড বক্স, কম্পিউটার, নগদ অর্থ, দাপ্তরিক কাগজপত্রসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যায়। ভাঙচুর করা হয় বিভিন্ন কক্ষের আসবাবপত্র। 
সংসদ ভবনে লুটপাট ও ভাঙচুরে ক্ষতি হয় রাষ্ট্রের কয়েক কোটি টাকা। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পলায়নের চার মাস পরও স্বাভাবিক হয়নি সংসদ সচিবালয়ের দাপ্তরিক কর্ম।

সংসদ ভবন
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পলায়নের চার মাস পরও স্বাভাবিক হয়নি সংসদ সচিবালয়ের দাপ্তরিক কাজকর্ম। গত ৫ আগস্ট জাতীয় সংসদ সচিবালয়ে ব্যাপক ভাঙচুর হয়। সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে জাতীয় সংসদ ভবনের।

জাতীয় সংসদ সচিবালয়ে রয়েছেন প্রায় ১ হাজার ১৫০ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী। ৫ আগস্ট এমপি-মন্ত্রী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বসার চেয়ার-টেবিলও ভেঙে ফেলা হয়, তার কিছু কিছু উল্লাসিত জনতা হাতে হাতে নিয়েও যায়। এ সময় তারা প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর, বিরোধীদলীয় সংসদ নেতা, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, চিফ হুইপ, হুইপদের কক্ষসহ ৯ তলা ভবনের অধিকাংশ কক্ষ ভাঙচুর করে।

ল্যাপটপ, কম্পিউটার, টিভি, ফ্রিজসহ মূল্যবান কাগজপত্র এখনও উধাও। সেদিন অধিকাংশ দরজা ও জানালা ভাঙা হয়। সংসদে থাকা কয়েকশ কম্পিউটার ও ল্যাপটপ আর পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নানা অজুহাত দেখিয়ে ঠিকমতো অফিস করছেন না। আবার অনেকে অফিস করলেও সংসদ বিলুপ্ত-পরবর্তী রুটিন কার্যক্রম তারা চালিয়ে নিতে পারছেন না। 

জাতীয় সংসদের অতিরিক্ত সচিব জেবুন্নেসা করিম রাইজিংবিডি ডটকমকে বলেন, “সংসদ ভবন থেকে দাপ্তরিক ও ব্যক্তিগত মোট ৯০ লাখ টাকা হারিয়ে গেছে।” 

কিন্তু সংসদের একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, ৩৫০ জন সংসদ সদস্যের দপ্তর ছিল। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর, বিরোধীদলীয় সংসদ নেতা, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, চিফ হুইপ, হুইপ, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীদের কক্ষ রয়েছে। ৯০ লাখ টাকা হারানোর কথা বলা হলেও এর পরিমাণ অনেক বেশি হবে।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত
৬ আগস্ট জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধান, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের বৈঠকের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত করা হয়।

সংসদ ভেঙে দেওয়ার আগে আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিভাগের সচিব (রুটিন দায়িত্ব) ড. হাফিজ আহমেদ চৌধুরী একটি সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করেন। এতে বলা হয়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ৭ জানুয়ারি, ২০২৪ তারিখে অনুষ্ঠিত হয়। ৩০ জানুয়ারি, ২০২৪ তারিখে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট, ২০২৪ তারিখে রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র প্রদান করে দেশ ত্যাগ করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশত্যাগ করায় রাষ্ট্রপতির পক্ষে তার সঙ্গে পরামর্শ গ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। তাই সাংবিধানিক সংকট মোকাবিলা, জনস্বার্থ, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক জীবন যাতে বিপদের সম্মুখীন না হয়, সে জন্য রাষ্ট্রপতি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৮ (৩) অনুচ্ছেদের অধীন তার বিচক্ষণতা (ডিসক্রিশনারি পাওয়ার) বা সহজাত ক্ষমতা প্রয়োগ করে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভেঙে দিতে পারেন। জনস্বার্থে, রাষ্ট্রপতি অনুচ্ছেদ ৩-এ বর্ণিত অবস্থাধীনে সমীচীন বিবেচনায় সেহেতু রুলস অব বিজনেস ১৯৯৬-এর শিডিউল ফোরের ব্যতিক্রম সদয় অনুমোদনপূর্বক দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়ার লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি বিজ্ঞপ্তি জারি করতে পারেন।

২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট পাস
গত  ৩০ জুন ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা ঘাটতির লক্ষ্য রেখেই জাতীয় সংসদে পাস হয় ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট। সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ছিল ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। আর মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ ভাগে নামানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বাজেটে কিছু নীতি সংশোধনের প্রস্তাব করেন। পরে সংসদ সদস্যদের কণ্ঠভোটে পাস হয় বাজেট।
অর্থমন্ত্রী গত ৬ জুন জাতীয় সংসদে ‘টেকসই উন্নয়নের পরিক্রমায় স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নযাত্রা’ স্লোগানে বাজেটটি পেশ উত্থাপন করেছিলেন। 

বিল পাস
ইউনিয়ন পরিষদে প্রশাসক নিয়োগের বিধান রেখে আইনের সংশোধনী পাস হয়েছে। ১ জুলাই জাতীয় সংসদে ‘স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) (সংশোধন) বিল–২০২৪’ পাস হয়। স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম বিলটি পাসের জন্য সংসদে তোলেন। বিলের ওপর আনা জনমত যাচাই, বাছাই কমিটিতে প্রেরণ ও সংশোধনী প্রস্তাবগুলো নিষ্পত্তি শেষে বিলটি কণ্ঠভোটে পাস হয়।

গ্রাম আদালতের জরিমানার সীমা ৭৫ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত করার বিধান রেখে গ্রাম আদালত (সংশোধন) বিল-২০২৪ জাতীয় সংসদে পাস হয়। ৭ মে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বিলটি পাসের প্রস্তাব উত্থাপন করলে তা কণ্ঠভোটে পাস হয়।

ব্যাংকের পাশাপাশি অ-ব্যাংক পরিশোধ সেবাদানকারীদের আইনি কাঠামোর মধ্যে আনতে ‘পরিশোধ ও নিষ্পত্তি ব্যবস্থা বিল-২০২৪’ সংসদে পাস হয়। ২ জুলাই অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বিলটি পাসের জন্য সংসদে উত্থাপন করেন। বিলের ওপর আনা জনমত যাচাই-বাছাই কমিটিতে পাঠানো ও সংশোধনী প্রস্তাবগুলোর নিষ্পত্তি শেষে বিলটি কণ্ঠভোটে পাস হয়।

ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (সংশোধন) বিল-২০২৪ জাতীয় সংসদে পাস হয় ২ জুলাই। বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বিলটি সংসদে পাসের প্রস্তাব করলে কণ্ঠভোটে তা পাস হয়। 

জাতীয় সংসদে অফশোর ব্যাংকিং আইন পাস হয় ৫ মার্চ। অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ‘অফশোর ব্যাংকিং বিল-২০২৪’ পাসের প্রস্তাব উত্থাপন করলে তা কণ্ঠভোটে পাস হয়। এর আগে বিলটি জনমত যাচাই-বাছাই কমিটিতে পাঠানোর ও সংশোধনের প্রস্তাবগুলো নিষ্পত্তি করেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী।

জাতীয় সংসদ ভবন পৃথিবীর দৃষ্টিনন্দন ভবনের একটি। রাজধানী ঢাকার শেরেবাংলা নগরে জাতীয় সংসদ ভবন এলাকার আয়তন ২১৫ একর। ভবনটির নকশা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত স্থপতি লুই আই কান। সংসদ ভবন এলাকাকে প্রধান ভবন, দক্ষিণ প্লাজা ও প্রেসিডেন্সিয়াল প্লাজা- এই তিন অংশে ভাগ করা হয়েছে। 

সংসদ ভবনের পেছন দিকে ক্রিসেন্ট লেক নামে একটি নান্দনিক জলাধার আছে। সংসদের মূল ভবনের পাশাপাশি রয়েছে উন্মুক্ত সবুজ পরিসর ও সংসদ সদস্যদের কার্যালয়। সংসদ ভবন চত্বরে আছে খেজুরবাগান মাঠ ও টানেল।
১৯৬১ সালে ৯ তলা এই ভবনটি নির্মাণকাজ শুরু হয়। ইতিহাসের বিভিন্ন চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ১৯৮২ সালের ২৮ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ ভবনের উদ্বোধন করা হয়।

ঢাকা/এএএম/রাসেল

সম্পর্কিত বিষয়:


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়