নতুন প্রত্যাশার নবযাত্রা বাংলাদেশের
কুয়াশায় আচ্ছন্ন দিগন্তে লালিমা ছড়াতে ছড়াতে সূর্য অস্তাচলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয়ে গেল বিদায়ের আয়োজন। সাঁঝ গড়িয়ে মধ্যরাত হতেই মহাকালের আবর্তে বিলীন হয়ে গেল ২০২৪ সাল। শুরু হলো নতুন বছর ২০২৫। মধ্যরাতে বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশও নতুন আশা নিয়ে বরণ করেছে ২০২৫ সালকে।
এবারের নতুন বছর এসেছে গত প্রায় দেড় যুগের মধ্যে অন্যরকম আবেগ, প্রত্যাশা আর উচ্ছ্বাস নিয়ে। আগামীর দিনগুলোতে অনিশ্চয়তা কেটে গিয়ে শুভময়তা ছড়িয়ে যাবে পৃথিবীময়, এ আশায় বুক বাঁধছে মানুষ। বিশেষ করে দেশের আপামর তরুণ-জনতা একটি নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে। বলা হচ্ছে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের কাজ চলছে। আগামী বছরের প্রথম সূর্যোদয় হবে এই প্রত্যাশা নিয়েই। বিদায়ী বছরের ব্যর্থতাকে সরিয়ে রেখে শুরু হয়েছে নতুন বছরে নতুনভাবে পথচলা।
সাহিত্যিক ও দার্শনিক উমবের্তো একো’র ফ্যাসিজমকে ‘চিরন্তন’ বলে আখ্যায়িত করেছিল। তিনি বলেছিলেন মুসোলিনি, হিটলাররা বিদায় হলেও ফ্যাসিজম বিলুপ্ত হয়নি। তার ভাষায় ‘একটি উন্নত গণতান্ত্রিক সমাজেও কোনো না কোনো উপায়ে ফ্যাসিজমের কোনো না কোনো উপাদান থাকতে পারে। এসব দেশে উন্নত মানের গণতন্ত্রের চর্চা হয়। কিন্তু বৈশিষ্ট্যগতভাবে এসব দেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় বিপুল পরিমাণে ফ্যাসিজমের চর্চা চলে।’ বাংলাদেশে শেখ হাসিনার টানা প্রায় ১৬ বছরের শাসনামলে তথাকথিত নির্বাচিত গণতন্ত্রের নামে কার্যকর ছিল একনায়কতন্ত্র।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০২৪ সালে শেখ হাসিনার সরকার পতনের মধ্য দিয়ে দেশে নতুন করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হতে যাচ্ছে। আজ ২০২৫ সালের প্রথমদিনটি ফ্যাসিস্ট শাসক মুক্ত প্রিয় বাংলাদেশের ১৫০তম দিনও বটে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে বিভিন্ন সেক্টরে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারসহ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করেছে। নতুন সরকারের কাছে বাংলাদেশ প্রত্যাশা করে- দুর্নীতিমুক্ত, জঙ্গি, সন্ত্রাসবাদ থেকে নিরাপদ থাকবে সমাজ। বিনাশ হবে অগণতান্ত্রিক অপশক্তি, জঙ্গিবাদ, ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা ও অপরাজনীতি। দেশবাসী প্রত্যাশা করে সম্প্রীতি ও সমঝোতার সংস্কৃতি রচনায় রাজনৈতিক দলগুলো অগ্রসর হবে। নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার ক্ষেত্রে সম্মিলিতভাবে সবাই কাজ করবে একযোগে। নতুন বছরে, নতুন করে আশায় বুক বেঁধেছে বাংলাদেশ। নতুন স্বপ্ন দেখে শান্তি, স্বস্তি, কল্যাণ ও সমৃদ্ধির।
২০২৪ এর সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ঘটনা দেশব্যাপী ছাত্র-জনতার সফল গণঅভ্যুত্থান। যার ফলে, বিগত ১৫ বছরের আওয়ামী লীগ শাসনের অবসান ঘটে। বিদায় নিতে বাধ্য হয় শেখ হাসিনার সরকার। এ সময়ে সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটে। যার ফলে বিভিন্ন স্থানে সাময়িক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপে সার্বিক পরিস্থিতির ক্রমশ উন্নতি হচ্ছে। নতুন বছরে এই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকার প্রত্যাশা সবার।
ইংরেজি নববর্ষ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস পৃথক বাণীতে দেশবাসীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন।
নববর্ষ উপলক্ষে দেওয়া বাণীতে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘‘সময়ের চিরায়ত আবর্তনে খ্রিষ্টীয় নববর্ষ আমাদের মাঝে সমাগত। আমাদের ব্যবহারিক জীবনে খ্রিষ্টীয় বর্ষপঞ্জিকা বহুল ব্যবহৃত। খ্রিস্টাব্দ তাই জাতীয় জীবনে এবং প্রাত্যহিক জীবনযাত্রায় অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ।’’
রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘‘জুলাই-আগস্টের ছাত্র-শ্রমিক-জনতার অভ্যুত্থান পরবর্তী বর্তমান প্রেক্ষাপটে নতুন বছর আমাদের মাঝে বয়ে এনেছে এক নতুন সুযোগ ও সম্ভাবনা। বিরাজমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতিতে আমি আশা করি, সচ্ছল সমাজ ও রাষ্ট্র দুস্থ, অসহায় ও পশ্চাদপদ মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসবে। নববর্ষ উদযাপন একজনের আনন্দ যেন অন্যদের বিষাদের কারণ না হয় আমরা সেদিকেও খেয়াল রাখব।’’
তিনি আশা প্রকাশ করেন, ‘‘নতুন বছরে আমরা দুর্নীতি ও বৈষম্যহীন এক সমাজ, সাম্য ও ন্যায়ভিত্তিক মানবিক রাষ্ট্র, গণতান্ত্রিক ও কল্যাণমুখী এক ‘নতুন বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে সঠিক পথের দিশা পাব।’’
সাহাবুদ্দিন বলেন, ‘‘জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের আত্মত্যাগ, আকাঙ্ক্ষা ও চেতনার পথ ধরে বাংলাদেশ অমিত সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে যাক নতুন বছরে,’’ এ প্রত্যাশা করি।
রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘‘২০২৫-সবার জীবনে বয়ে আনুক নতুন স্পন্দন, নতুন আশা, নতুন সম্ভাবনা ও সাফল্য।’’
নতুন বছর উপলক্ষে দেওয়া বাণীতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘‘নতুনের আগমনী বার্তা আমাদের উদ্বেলিত করে, নব উদ্যমে সুন্দর আগামীর পথচলার জন্য অনুপ্রেরণা যোগায়। নতুন বছরের এই মাহেন্দ্রক্ষণে সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে নতুন সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে উন্নতির নতুন শিখরে আরোহণে অঙ্গীকারবদ্ধ বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।’’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘‘ছাত্র-শ্রমিক-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার লাখো শহীদের রক্ত ও গত জুলাই-আগস্ট মাসে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে অর্জিত স্বাধীনতাকে সর্বদা সমুন্নত রাখার অঙ্গীকার করছে। আমরা দেশকে ভালোবাসবো, দেশের মানুষের সার্বিক কল্যাণে সর্বশক্তি নিয়োগ করবো এবং যেকোনো সন্ত্রাসবাদকে প্রতিহত করবো।’’
নতুন বছরে মানুষে-মানুষে সম্প্রীতি, সৌহার্দ ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন আরও জোরদার হোক এই কামনা করে তিনি বলেন, ‘‘খ্রিষ্টীয় নতুন বছর ২০২৫ সবার জীবনে বয়ে আনুক অনাবিল সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি।’’
ঢাকা/এসবি