২৫ ক্যাডারের আলোচনা সভা
‘সিভিল সার্ভিসে শাসকের ভূমিকায় প্রশাসন ক্যাডার’
সিভিল সার্ভিসে শাসকের ভূমিকায় রয়েছে প্রশাসন ক্যাডার। এই ক্যাডার (প্রশাসন) সিভিল সার্ভিসের বাকি সব (২৫টি) ক্যাডারকে শাসন করছে, বঞ্চিত করছে। প্রশাসন ক্যাডারের বাড়তি সুযোগ-সুবিধা আন্তক্যাডার বৈষম্যও বাড়িয়েছে।
‘জনবান্ধব সিভিল সার্ভিস বিনির্মাণে করণীয়: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বক্তব্যে এসব অভিযোগ উঠে এসেছে। এই পরিস্থিতির অবসান দাবি করেছেন অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা।
শুক্রবার (৩ জানুয়ারি) সকালে রাজধানীর খামারবাড়ির কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশে (কেআইবি) ওই আলোচনা সভার আয়োজন করে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ। এতে বিভিন্ন ক্যাডারের আট হাজারের মতো কর্মকর্তা উপস্থিত হন। সভায় ১৫টির বেশি ক্যাডারের ১৯ জন কর্মকর্তা বক্তব্য দেন।
এই আলোচনা সভা থেকে মূলত যেসব দাবি উঠে এসেছে, সেগুলো হলো ক্যাডার যার মন্ত্রণালয় তার হতে হবে, উপসচিব পদে কোটাপদ্ধতি বাতিল করতে হবে এবং সব ক্যাডারের সমতা নিশ্চিত করতে হবে।
আলোচনা সভায় উপসচিব পদে কোটাপদ্ধতি বাতিল করে সব ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে পরীক্ষার ভিত্তিতে নিয়োগের দাবি করা হয়েছে। আলোচনায় উঠে আসে, উপসচিব পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি ক্যাডারের (প্রশাসন) জন্য ৫০ শতাংশ কোটা রাখা এবং বাকি ২৫টি ক্যাডারের জন্য ৫০ শতাংশ রাখার যে প্রস্তাব জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন করতে যাচ্ছে, তা অগ্রহণযোগ্য।
একইভাবে সিভিল সার্ভিস থেকে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারকে বাদ দেওয়ার প্রস্তাবটিও অগ্রহণযোগ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে সভায়।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের সমন্বয়ক কৃষিবিদ মো. আরিফ হোসেন। তিনি বলেন, “সরকারের পক্ষ থেকে অনুরোধ থাকায় এই মুহূর্তে বৃহৎ কর্মসূচি থেকে তারা বিরত থাকবেন। তবে আগামী এক মাস ছাত্র-জনতার সঙ্গে মতবিনিময় সভা করবেন।”
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের চূড়ান্ত সুপারিশে ২৫ ক্যাডারের মতামতের প্রতিফলন দেখতে চান বলেও উল্লেখ করেন আরিফ হোসেন। সে পর্যন্ত সবাইকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়ে আরিফ হোসেন বলেন, “রাষ্ট্রের দায়িত্বভার হাতে থাকায় সেটির অপব্যবহার করে সামান্য অপরাধে ঢালাওভাবে সাময়িক বরখাস্ত শুরু করা হয়েছে। এ বিষয়ে উপদেষ্টাদের সঙ্গে দেখা করে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে অনুরোধ করা হবে। আর এ ধারা অব্যাহত থাকলে চাকরিবিধি অনুসরণ করে বৃহৎ কর্মসূচি ঘোষণা দেওয়া হবে।”
আলোচনা সভায় স্বাগত বক্তব্য দেন আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের সমন্বয়ক মুহম্মদ মফিজুর রহমান। সমতা নিশ্চিতের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, “২০১৫ সালের পে-স্কেল বলেছে, প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ শ্রেণি দিয়ে কাউকে ডিফাইন (সংজ্ঞায়িত) করা হবে না। অথচ আমরা দেখলাম, কেবলমাত্র উপসচিবদের জন্য ৩০ লাখ টাকা ঋণ…। যদি বলতেন, এই গ্রেড থেকে ওপরের লোকেরা পাবে (ঋণ), সমস্যা ছিল না। যদি বলেন যে এত টাকা নাই; কেউ পাবে না।...আমরা এই বিষয়গুলোর সমাধান চাই।”
২৫টি ক্যাডার বৈষম্যের শিকার বলে উল্লেখ করেন বিসিএস সমবায় অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কাজী মেসবাহ উদ্দিন আহমেদ। ২৭ বছরের চাকরিজীবনে তিনি একটিও বিদেশে প্রশিক্ষণের সুযোগ পাননি। মেসবাহ উদ্দিন বলেন, “আমার ট্রেনিংগুলো (প্রশিক্ষণ) মন্ত্রণালয়ের অফিসার (কর্মকর্তা) নিয়ে যায়। সে (ওই কর্মকর্তা) ট্রেনিংয়ের পরে আবার চলে যায় প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে। প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যে ট্রেনিং প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার জন্য এসেছিল, সেটা গ্রহণ করে সে চলে যায় সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে।” এটা বৈষম্য উল্লেখ করে তা দূর করার দাবি জানান তিনি।
সিভিল সার্ভিসে একটি ক্যাডার বাকি ক্যাডারগুলোকে বঞ্চিত করছে বলে মনে করেন বিসিএস পরিবার পরিকল্পনা অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. আবুল কাশেম। তিনি বলেন, “সিভিল সার্ভিসের মধ্যে একটি ক্যাডার শাসকের ভূমিকায় রয়েছে। সমতায়, মর্যাদায়, সম্মানে-সব জায়গায় তারা ২৫ ক্যাডারকে বঞ্চিত করেছে। সেই ক্যাডার গত ১৭ বছরে বৈষম্য তৈরি করেছে। বিপ্লবের পর সেই একটি ক্যাডারের লোকদের প্রশাসক হিসেবে জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব বসানো হয়েছে। বিপ্লবের পর সংস্কারের দায়িত্বও সেই একটি ক্যাডারকে দেওয়া হয়েছে। যারা বৈষম্য তৈরি করল, তাদের দিয়েই বৈষম্য নিরসনের দায়িত্ব দেওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি।
শিক্ষা ক্যাডার সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার বলে অভিযোগ করেন বিসিএস জেনারেল এডুকেশন অ্যাসোসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অধ্যাপক মো. সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, “বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে ক্যাডার সার্ভিসের একটা মর্যাদার অবস্থান আছে। সেই ক্যাডারে শিক্ষা আছে বলেই এখনো মেধাবীরা শিক্ষাতে আসেন এবং তারা আপ্রাণ চেষ্টা করেন এ দেশের সাধারণ জনগণকে শত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সার্ভিস দেওয়ার জন্য।” শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে ক্যাডারবহির্ভূত করার প্রস্তাবকে অদূরদর্শিতা বলে মনে করেন সিরাজুল ইসলাম।
ক্যাডার সার্ভিস থেকে স্বাস্থ্য খাতকে বের করে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণযোগ্য নয় উল্লেখ করে বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক মোহাম্মদ নেয়ামত হোসেন বলেন, “ক্যাডার সার্ভিস থাকার ফলে (চিকিৎসকদের) মন্ত্রণালয়ে যাওয়ার যে সুযোগ ছিল, সেই রাস্তা বন্ধ করার চেষ্টা চলছে।”
তিনি বলেন, “আগামী এক দশক স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নের ভার (মন্ত্রণালয় থেকে সর্বনিম্ন পর্যায় পর্যন্ত) স্বাস্থ্য ক্যাডারের হাতে তুলে দেওয়া হলে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভালো করবে।”
আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য দেন রেলওয়ে অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এফ এম মহিউদ্দিন, বিসিএস কৃষি ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক মো. সাহিনুল ইসলাম, বিসিএস পোস্টাল অ্যাসোসিয়েশনের কোষাধ্যক্ষ মো. আবদুল হামিদ, গণপূর্ত অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. জামিলুর রহমান, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহে আরেফীন প্রমুখ।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের সমন্বয়ক ফারহানা আক্তার ও মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন।
ঢাকা/এএএম/এসবি