ঢাকা     বুধবার   ১৫ জানুয়ারি ২০২৫ ||  মাঘ ১ ১৪৩১

সাকরাইন উৎসব: ঘুড়ির দখলে পুরান ঢাকার আকাশ

লিমন ইসলাম, জবি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৪৪, ১৪ জানুয়ারি ২০২৫   আপডেট: ১৯:৫৪, ১৪ জানুয়ারি ২০২৫
সাকরাইন উৎসব: ঘুড়ির দখলে পুরান ঢাকার আকাশ

বাসার ছাদে ঘুড়ি ওড়াচ্ছেন পুরান ঢাকার কিশোর-তরুণরা

পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী উৎসব সাকরাইন। এদিন বাতাসে উড়তে থাকা রঙিন ঘুড়ির দখলে থাকে গোটা পুরান ঢাকার আকাশ। পরিণত হয় এক জীবন্ত উৎসবে।

এবারের সাকরাইন উপলক্ষেও ঘুড়ি আর আতশবাজির ঝলকে মেতে উঠেছে হাজারো মানুষ। তবে অন্যান্য বছর থেকে এবারের চিত্র কিছুটা ভিন্ন। উৎসবের আমেজ কম। বিগত বছরগুলোর মতো জাঁকজমক নেই। কমেছে ঘুড়ি-নাটাই-সুতার বেচাকেনাও।

মঙ্গলবার (১৪ জানুয়ারি) পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার, নারিন্দা, দয়াগঞ্জ, ধূপখোলা ঘুরে সাকরাইন উৎসব উপলক্ষে তেমন আমেজ লক্ষ্য করা যায়নি। তবে দোকানে দোকানে আগের মতোই নানা রঙের, নানা আকারের ঘুড়ি, নাটাই, সুতা দেখা গেছে, নেই বিকিকিনির ভিড়।

অন্যান্য বছর উৎসবের আগে থেকেই ছাদে ছাদে কিশোর-তরুণদের ঘুড়ি ওড়াতে দেখা গেলেও এবার তেমনটা চোখে পড়েনি। গতকাল সোমবারও (১৩ জানুয়ারি) সাকরাইনের প্রস্তুতি নিতে দেখা যায়নি পুরান ঢাকায়।

সাকরাইন বা পিঠাপুলির দিন মূলত পৌষসংক্রান্তি উপলক্ষে পালিত একটি লোকজ উৎসব। কিন্তু এ উৎসবের রঙ, রীতি ও পরম্পরা পুরান ঢাকাবাসীর জীবনে এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। এদিনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দৃশ্য হচ্ছে ঘুড়ি কাটাকাটির খেলা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে এ খেলা।

সাকরাইন উৎসবের দিন পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বাসাবাড়ির ছাদ সাজানো হয়েছে বাহারি রঙের আলোকসজ্জায়। ছাদের ওপর শিশুদের মেলা, আছে বড়রাও। তাদের সবার হাতে নাটাই ও ঘুড়ি। বাড়িতে বাড়িতে বানানো হয়েছে পিঠা। কিছু কিছু বাড়ির ছাদে আয়োজন করা হয়েছে ডিজে পার্টির। ঘুড়ি ওড়ানোর সময় ঘুড়ি কেটে গেলে চিৎকার আর হাসাহাসি। বন্ধু-বান্ধব আর আত্মীয়-স্বজন মিলে সে এক অন্যরকম উল্লাস। এ যেন এক মেলবন্ধন।

বাসার ছাদে ঘুড়ি উড়াচ্ছিলেন অষ্টম শ্রেণীতে পড়ুয়া সবুজ। বিকাল পর্যন্ত সে তিনটি ঘুড়ি কেটেছে। অন্যরাও তার ঘুড়ি কেটেছে কয়েকবার। এবারের ঘুড়ি উৎসবের জন্য সে ১০টি ঘুড়ি কিনেছে। তার সবচেয়ে পছন্দের ঘুড়ি ‘পতেঙ্গা’।

ছেলে-মেয়েদের ঘুড়ি উড়ানোর আবদারে ধূপখোলা মাঠে এসেছেন শফিক আহমেদ। তিনি পুরান ঢাকার স্থানীয় বাসিন্দা। কাজের ফাঁকে সময় বের করে তিনি সন্তানদের নিয়ে মাঠে এসেছেন।

তিনি বলেন, “ছোটবেলায় সাকরাইন উৎসবে আমিও ঘুড়ি উড়াতাম। ঘুড়ি কাটাকাটিতে সবচেয়ে মজা। এখন কাজের চাপে ব্যস্ত হয়ে উঠেছি। ছেলে-মেয়েদের আবদারে ওদের এখানে নিয়ে আসা।”

পুরান বিভিন্ন গলির দোকানগুলোতে ঘুড়ি পাওয়া গেলেও। ঘুড়ির সবচেয়ে বেশি বেচাকেনা হয় শাঁখারীবাজারে। দোকানগুলোতে সাজানো রয়েছে নানা রং, আকৃতি ও নকশার ঘুড়ি-নাটাই-সুতা। ক্রেতারা আসছেন দেখছেন। আর পছন্দ হলেই দামাদামি করে কিনছেন। কিন্তু দোকানিরা বলছেন, বিগত বছরের তুলনায় এবার বিক্রি কম হচ্ছে। 

শাঁখারী বাজারের বিক্রেতারা জানান, চারবুয়া বা কাউটা, টানা চোখ, গোল চোখ, মৌসুমী, লাভ, লাইলাসহ বিভিন্ন ধরনের ঘুড়ি এসেছে। পাঁচ টাকা থেকে ৫০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায় এ ঘুড়িগুলো। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের সুতা ও নাটাই রয়েছে। আকৃতিভেদে নাটাইয়ের দামেও রয়েছে ভিন্নতা। সর্বনিম্ন ১০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৮০০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে।

তারা আরো জানান, মোটা-চিকনভেদে বিক্রি হচ্ছে নানা রংয়ের সুতা। সর্বনিম্ন ৭০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১ হাজার টাকা দামের সুতাও আছে। এসব সাজিয়ে রাখলেও তেমন বিক্রি না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেন তারা।

শাঁখারী বাজারের গোপাল স্টোরের মালিক সুজিত কর বলেন, “আগের তুলনায় এবার বিক্রি কম। কয়েক হাজার ঘুড়ি অর্ডার দিয়েছিলাম। যা এসেছে তার অর্ধেকও বিক্রি হয়নি। আগের মতো ছেলেরা সাকরাইনে ঘুড়ি উড়ায় না। এরা গান বাজায়, বাজি ফুটায়। এবার সেটাও কম।”

তিনি আরও বলেন, “সাকরাইনের সঙ্গে পঞ্জিকার একটা পার্থক্য তৈরি হয়েছে। বাংলা ও ইংরেজি পঞ্জিকার একদিন আগে বা পরে হয় সাকরাইন। এ দ্বিধার কারণেই এবার সাকরাইনের আমেজ কম।”

ঢাকাবাসী সংগঠনের সভাপতি শুকুর সালেক বলেন, “সাকরাইন মূলত একটি পারিবারিক উৎসব। সবাই পরিবারের সঙ্গে পিঠাপুলি আর ঘুড়ি উড়িয়ে এ উৎসব পালন করেন। কিন্তু ডিজে পার্টির নামে উচ্চ স্বরে গান বাজানো, এটা আমাদের কালচার না। মুড়ি, খই, বাতাসা, মিষ্টি খাওয়া, একে অপরকে দাওয়াত দেওয়া, এগুলোই আমাদের উৎসবের অনুষঙ্গ। সাকরাইনের নামে অপসংস্কৃতি সামাজিকভাবে প্রতিরোধ করতে হবে।”

প্রায় ২ হাজার বছর আগে চীনে প্রথম ঘুড়ির উৎপত্তি। ইউরোপ বা আমেরিকায় ঘুড়ি ওড়ানোর রেওয়াজ থাকলেও মূলত চীন, জাপান, কোরিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ভারত আর বাংলাদেশের মতো এশিয়ার দেশগুলোতেই এ খেলার জনপ্রিয়তা বেশি।

ঢাকা/মেহেদী


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়