ঈদের ছুটির ‘ফাঁকা’ সড়কে কেন এত মৃত্যু

প্রতীকী ছবি।
ঈদুল ফিতরের টানা ছুটি ঘিরে রাজধানী থেকে শহর-গ্রামে উৎসবের আবহের মধ্যে একের পর এক সড়ক দুর্ঘটনায় উল্লেখযোগ্য প্রাণহানির ঘটনা আবার সামনে আনছে জানা-শোনা পরিসরেরই সেই কারণগুলো, যেগুলোর বাস্তবায়নের তাগিদ রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে।
অবশ্য হাইওয়ে পুলিশ বলছে, ঈদের আগে থেকেই তারা সড়ক নিরাপত্তায় প্রস্তুতি নিয়ে কাজ করে গেছে। যদিও মৃত্যুর মিছিল থামানো যায়নি।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে কয়েকবার দেশ ফুঁসে উঠলেও আজও সেই ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। অদক্ষ চালকের হাতে যাচ্ছে গাড়ির স্টিয়ারিং। সড়ক নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণে নেই কাঠামোগত প্রতিষ্ঠান বা দপ্তর-সংস্থা। মহাসড়কে থামানো যায়নি ইজিবাইক, থ্রি-হুইলার, নসিমন-করিমনের মতো ছোট ছোট বাহন। অপেক্ষাকৃত সরু সড়কে যানবাহনের আধিক্য, বিপজ্জনক সড়ক-বাঁক চিহ্নিত না করা, প্রয়োজনমতো গতিরোধকের অভাব তো রয়েছেই। এসব কারণে ঈদের ছুটিতে অপেক্ষাকৃত ফাঁকা সড়ক-মহাসড়কে বেদনাদায়ক মৃত্যুর মিছিল দেখল দেশ।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চুনতি জাঙ্গালিয়া এলাকায় ঈদের ছুটির মধ্যে ৪৮ ঘণ্টায় ত্রিশজনের বেশি মানুষের মৃত্যু ঈদের উৎসবে যেন অব্যবস্থাপনা ও উদাসীনতার কলঙ্ক লেপে দিয়ে গেল দেশে। সেখানে পৃথক তিন দুর্ঘটনায় এক পরিবারের ১১ জন, আরেক পরিবারের পাঁচজন মারা গেছেন। সর্বশেষ শুক্রবার ওই ১১ জনের একজন তানিয়া ইসলাম প্রেমী নামে তরুণী চট্টগ্রামে চিকিৎসাধীন অবস্থায় না ফেরার দেশে চলে গেছেন।
চট্টগ্রাম থেকে ৭৫ কিলোমিটার দূরে লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি জাঙ্গালিয়ার ওপর দিয়ে যাওয়া মহাসড়কটি কেন প্রাণঘাতী? সেই কারণ অজানা নয়। গাড়ি চালক, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, ওই এলাকার উঁচু-নিচু সড়কে বাঁকগুলো খুব বিপদজনক। ঈদের ছুটির মৌসুমে দেশের অন্যান্য জেলা থেকে আসা চালকরা মহাসড়কে ওই জায়গায় দুর্ঘটনার শিকার হন; কারণ সেখানে রাস্তাটি সরু ও বিপদ সংকেত যথাযথভাবে লেখা নেই।
পাহাড়ি ঢাল এবং টার্নিং নিয়ে এগোনো মহাসড়কটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠার আরেকটি কারণের কথা বলেছেন লোহাগাড়া হাইওয়ে থানার এসআই মো. আব্দুল মতিন। তার কথায়, কক্সবাজার থেকে আসা লবণের গাড়ি থেকে লবণের পানি পড়ে রাস্তা পিচ্ছিল হয়ে থাকে।
চুনতি জাঙ্গালিয়া মহাসড়কের অংশটি আঁকাবাাঁকা, ফলে এখানে এখানে গতিরোধ থাকলে ভালো হতো বলে মনে করেন ফায়ার সার্ভিসের লোহাগাড়া স্টেশনের লিডার রাখাল চন্দ্র রুদ্র।
৩ এপ্রিল যশোর-বেনাপোল রোডের পুলেরহাটে মোটরসাইকেলে স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে খুলনার বাসায় ফেরার পথে লোকাল বাসের থাকায় প্রাণ যায় পরিবারটির তিনজনের। পুলেরহাট বাজারের ওপর সড়কটি তখন মোটামুখি ফাঁকাই ছিল। অথচ বাসটি পেছন থেকে মোটরসাইকেলে ধাক্কা দেয়। এর দায় আসলে কার? বাসচালক ক্লান্ত ছিলেন, বাসে ত্রুটি ছিল নাকি তাড়াহুড়ায় এই দুর্ঘটনা? বাসের চালক পালিয়ে যাওয়ায় এসবের হয়তো উত্তর মেলেনি। তবে যে কারণেই হোক, সেটি অজানা কারণ নয়।
শুধু চট্টগ্রাম বা যশোর নয়; ঈদের ছুটির মধ্যে অনেক জেলায় ফাঁকা সড়ক-মহাসড়কে ঘটেছে দুর্ঘটনা, হতাহতের সংখ্যাও কম নয়। রাইজিংবিডি ডটকমের তথ্য অনুযায়ী, শুধু ঈদের দিন (৩১ মার্চ) আট জেলায় সড়কে ঝরে যায় ১৬টি প্রাণ। অথচ সড়ক-মহাসড়কে সেদিন গাড়ি ছিল খুবই কম। সব মিলে ঈদের ছুটি শেষে হিসাব করলে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা হয়তো শত ছাড়িয়ে যাবে।
ঈদের ছুটি ঘিরে সড়ক-মহাসড়কের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে রাইজিংবিডি ডটকম কথা বলে হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক দেলওয়ার হোসেন মিয়ার সঙ্গে।
তিনি বলেন, সড়ক-মহাসড়কে যেন দুর্ঘটনা না ঘটে, পুলিশের পক্ষ থেকে সে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। ঈদের আগ থেকেই সড়কের নিরাপত্তায় কাজ করছেন তারা। মহাসড়কে তিন চাকার যানবাহন চলাচল করতে নিষেধ করা হয়েছিল। পরিবহন সংশ্লিষ্টদের দেওয়া হয়েছিল নানা নিদর্শনা।
তারপরও কেন এত দুর্ঘটনা, এত প্রাণহানি ও আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে গেল?
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঈদের ছুটিতে সড়ক- মহাসড়কে যেসব মর্মান্তিক দুঘটনা ঘটনা ঘটে থাকে, তা মূলত যানবাহনের দ্রুত গতির জন্য হয়ে থাকে। চালকদের পেশাগত দক্ষতারও অভাব রয়েছে, যা উন্নয়ন করা অপরিহার্য।
যাত্রীকল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ৬ হাজার ৩৫৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ৫৪৩ জন নিহত এবং ১২ হাজার ৬০৮ জন আহত হন। ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে সড়কে দুর্ঘটনা বেড়েছিল ১ দশমিক ৫৪ শতাংশ, মৃত্যু বেড়েছিল ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ, আর আহতের সংখ্যা বেড়েছিল ১৭ দশমিক ৭৩ শতাংশ।
বেসরকারি সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশে ৫৯৬টি দুর্ঘটনায় নিহত হন ৫৭৮ জন। আহত হন কমপক্ষে ১ হাজার ৩২৭ জন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে নারী ৭৮ ও শিশু ৮৭ জন।
আর জানুয়ারি মাসে সারা দেশে ৬২১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬০৮ জন নিহতের তথ্য দিয়ে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন জানায়, ওই মাসে অন্তত ১ হাজার ১০০ জন আহত হন। নিহতের মধ্যে নারী ৭২, শিশু ৮৪ জন। ২৭১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হন ২৬৪ জন, যা মোট নিহতের ৪৩ দশমিক ৪২ শতাংশ।
সড়ক দুর্ঘটনার কয়েকটি জানাশোনা কারণ হয়েছে, যেগুলো বন্ধ করা গেলে বা মেনে চলতে বাধ্য করা গেলে হয়তো সড়কে এই মৃত্যুর মিছিল কমানো যেতে পারে।
অতিরিক্ত ট্রিপ
মহাসড়কে বাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান চলাচলে একাধিক চালক রাখার কথা থাকলেও বাস্তবে একজন চালক দিয়েই একটি গাড়ি চালানো হচ্ছে। এতে চালক শারীরিক-মানসিক চাপ ও ঘুমের অভাবে ভুগতে থাকেন। এসব কারণে অনেক দুর্ঘটনা হয়ে থাকে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম রোডের বেসরকারি একটা কোম্পানির বাস চালক রুবেল হোসেন বলেন, “আমরা ট্রিপ হিসাবে টাকা পাই, ফিক্সড কোনো বেতন নাই। দিনে যত বেশি ট্রিপ দিতে পারি, এই চেষ্টা থাকে। ট্রিপ দিতে পারলে ইনকামও বেশি, বেশি ট্রিট মারতে গেলে গাড়ি দ্রুত গতিতিই চালাতে হয়।”
আরো কয়েকজন চালকের সঙ্গে কথা হলে পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেন, তাদের দিয়ে মালিকপক্ষ বেশি পরিশ্রম করিয়ে মুনাফা হাতিয়ে নেন। অতিরিক্ত ট্রিপের কারণে ঘুমাতেও পারেন না তারা। ঝিমাতে ঝিমাতে গাড়ি চালাতে হয়। ভোরের দিকে অনেক চালক ঘুমে ঢুলে পড়েন। এ কারণেও অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটছে। পরিবহনে বেতন ব্যবস্থা চালু করলে এবং অতিরিক্ত সময় গাড়ি চালানো বন্ধ করা গেলে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব।
ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন
মালিকরা যানবাহনের ফিটনেসের কাথা চিন্তা না করে টাকার নেশায় সড়কে ছেড়ে দিয়ে থাকেন বলে অনেক চালকের অভিযোগ। চলাচল করার সময় এসব যানবাহন নিয়ন্ত্রণে হারিয়ে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনার জন্য ফিটনেসবিহীন গাড়ির দায় ৩০ শতাংশ; এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য দিয়েছে যাত্রীকল্যাাণ সমিতি।
ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি সড়ক-মহাসড়কে উঠলেই সেগুলো জব্দ করে মামলা দেওয়ার বিধান থাকলেও রাস্তায় তাকালেই দেখা যায় জরাজীর্ণ সব যানবাহন হরদম চলাচল করছে।
নজরদারি অভাব
সড়কে অব্যবস্থাপনা, অদক্ষ চালক, অতিরিক্ত গতি, ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি জব্দ করার যাবতীয় বিধান থাকলেও বাস্তবায়ন দেখা যায় না। বড় দুর্ঘটনার পরই সবাই একটু নড়েচড়ে বসে; কয়েকদিন পর আবার আগের অবস্থায় চলতে থাকে সব। তবে অন্তর্বর্তী সরকার সড়ক নিরাপত্তায় জোর দিয়েছে। এ ছাড়া সড়ক-মহাসড়কে সিসি ক্যামেরা বসানোসহ সড়ক নিরাপত্তায় প্রযুক্তি ব্যবহারের দাবি রয়েছ বিভিন্ন পক্ষের।
অদক্ষ চালক
পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের কয়েকটি সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে একান্তে কথা বলে জানা গেছে, দেশে দক্ষ চালকের সংখ্যা খুবই কম। আবার ফাঁক-ফোঁকর গলিয়ে অদক্ষরাও নিয়ে নিচ্ছেন ড্রাইভিং লাইসেন্স। এ ক্ষেত্রে কঠোর অবস্থান নেওয়ার পক্ষে বিশেষজ্ঞরা। প্রয়োজনে অদক্ষ চালকের পরিবার মালিকের লাইসেন্স বাতিলের বিধান করা যেতে পারে।
মহাসড়কে তিন চাকার গাড়ি
মহাসড়কের দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ অটোরিকশা, ইজিবাইক, নসিমন, করিমনের মতো তিন চাকার যানবাহন। এগুলো মহাসড়কে চলাচল নিষিদ্ধ থাকলেও তা মানা হয় না। প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও তিন চাকার যানবাহনের দুর্ঘটনার খবর থাকে। যাত্রীকল্যাণ সমিতির মতে, তিন চাকার যানবাহন মহাসড়ক থেকে সরিয়ে দিতে পারলে দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব।
ঢাকা/রাসেল