হিংসার উল্লাস || সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা || রাইজিংবিডি.কম
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
ইতিহাস নাকি ফিরে আসে না? কিন্তু বাংলাদেশে চোখের সামনে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি দেখলাম আমরা। বিশ্বজিৎয়ের পর রিফাত। রাজধানী থেকে বরগুনা। অ্যাকশন একই, শুধু চিত্রনাট্য আলাদা। বিরোধী দলের অবরোধ কর্মসূচি চলার সময় গত ২০১২ সালের ৯ই ডিসেম্বর ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে দিনে-দুপুরে খুন হন বিশ্বজিৎ দাস। অনেকগুলো টিভি ক্যামেরা আর শত শত মানুষের সামনে একদল যুবক নিরীহ বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে রক্তাক্ত করতে করতে মেরে ফেলে।
কী নিষ্ঠুর সেই দৃশ্য! স্বাধীন দেশে এমন আরো ঘটনা দেখেছি আমরা। হুমায়ুন আজাদ, অভিজিৎ রায়, আলোকিত প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন। দেশব্যাপী তোলপার করা সেইসব ঘটনার পর ভাবা হয়েছিল আর হয়তো হবে না এমন নৃশংসতা। কিন্তু হয়েছে। রাজধানীতে নয়, বরগুনায়। সন্ত্রাসীদের সঙ্গে লড়াই করেও স্বামী রিফাত শরীফকে বাঁচাতে পারেননি তার স্ত্রী। গত বুধবার সকাল সাড়ে দশটার দিকে বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে রিফাতকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে জখম করে কয়েকজন যুবক। এরপর বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠন। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিকেল ৪টার দিকে রিফাতের মৃত্যু হয়। পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে কলেজের সামনে তিন যুবক রিফাতকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে জখম করে ফেলে রেখে যায়। তাকে উদ্ধার করে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে নেয়া হলে সেখানকার চিকিৎসকরা তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বরিশাল পাঠান। বিকেল ৪টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রিফাতের মৃত্যু হয়। হামলার সময় রিফাতের স্ত্রী স্বামীকে রক্ষা করতে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে লড়াই করেন একা। তাকে সাহায্য করতে কেউ এগিয়ে আসেনি। তিনি জাপটে ধরে সন্ত্রাসীদের সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন।
গণমাধ্যম এবং সামাজিকমাধ্যম এ ঘটনায় সরব। কত কথা বলছে সবাই আজ! কিন্তু ভয়াবহ ঘটনা কি অপ্রত্যাশিত ছিল? অহেতুক? আকস্মিক? কোথাও না কোথাও তো ঘটতই। গত কয়েক দশক ধরে দেশের সর্বত্র যে পরিকল্পিত দুর্বৃত্তায়ন ঘটানো হয়েছে, যে-ভাবে প্রতিটি এলাকার চিহ্নিত সমাজবিরোধী ও দুষ্কৃতীদের ক্ষমতার ছায়ায় আশ্রয় দেয়া হয়েছে, তাতে এটাই কি এ ধরনের ঘটনার মূল নয়?
অনেকে আমার সঙ্গে তর্ক করবেন যে, রিফাতের মূল খুনি নয়ন কোনো দলের সাথে ছিল না। হ্যাঁ ছিল না। কিন্তু ক্ষমতার সাথে সংশ্রব ছিল না, সেটা কি বলা যায়? তার বিরুদ্ধে আগে থেকেই খুন, সন্ত্রাস আর রাহাজানির অভিযোগ ছিল, এমন কথা পুলিশ আর গণমাধ্যমই বলছে। তাহলে সে এত দাপট নিয়ে এলাকায় ঘুরে বেড়াতো কীভাবে? দেশব্যাপী মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলছে, কিন্তু বরগুনার অন্যতম মাদক কারবারী নয়ন ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকল কীভাবে?
একটা কথা জানতে ইচ্ছা করে– রিফাত বা বিশ্বজিৎরা কি স্বতঃস্ফূর্ত জনরোষের শিকার? কারণ কেউ তো এগিয়ে এলো না তাদের বাঁচাতে! কুপিয়ে, পুড়িয়ে মারার জন্য দেশব্যাপী এমন অসংখ্য হার্মাদ আছে, আর তাদের বাহিনী আছে। দুই একটা ঘটনা ভাইরাল হয়, বাকী সবই আড়ালে আবডালে থেকে যায়।
প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছিলেন, তাই ফেনীর নুসরাত হত্যার বিচারে কিছুটা প্রশাসনিক তৎপরতা দেখছি আমরা। রিফাত হত্যায়ও নাকি প্রধানমন্ত্রী হত্যাকারীদের ধরতে নির্দেশ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু তিনি একা কী করবেন? আর তাকেই বা বারবার বলতে হবে কেন? আসল কাজ হলো দুর্বৃত্তায়নের সংস্কৃতি হতে দেশকে টেনে বের করে আনা। কাজটি দুরূহ। রাতারাতি হবারও নয়।
নুসরাতের বেলায় যেমন করার চেষ্টা করেছিলেন ওসি মোয়াজ্জেম– অর্থাৎ ভিকটিমকেই চরিত্রহীন বানানো, সেই কাজটি করার একটা সূক্ষ্ম প্রচেষ্টা রিফাতের স্ত্রী মিন্নীর বেলায়ও করছেন কেউ কেউ। এ ধরনের পৈশাচিক বর্বরতার সময়ও যারা নারীর চরিত্র খোঁজেন, আর যদি তারা প্রশাসনেরই অংশ হন, তাহলে বলতেই হবে আমরা কোনো শাসনে নয়, অপশাসনে বাস করছি। আর সামাজিক মাধ্যমে যারা প্রেম, পরকীয়ার গল্প খুঁজছেন, তারা সভ্যতার এই মহাসড়কে মহা-অসভ্য।
আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি এসব দেখতে দেখতে- চেনা ছক, ছয়কে নয় করার সেই চেনা পদ্ধতি, সেই চেনা তত্ত্ব যা হত্যার নৃশংসতা ও অন্যায়কে লঘু করে দুষ্কৃতীকারীদের উৎসাহিত করে, নিরপেক্ষ তদন্তকেও প্রভাবিত করে। প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত কোথাও না কোথাও সহিংসতার নতুন নতুন সব প্রদর্শনী। যেন এক হিংসার উল্লাস। গণমাধ্যম আর সামাজিক মাধ্যমের চাপে কিছু বিচারিক প্রক্রিয়া হয়, কিন্তু বিচার আর হয় না। যদি এই অবস্থা চলতে থাকে, তাহলে আশঙ্কা হয়- না জানি আর কী দেখব আসছে দিনগুলোতে! মনের মাঝে অজান্তেই ভাবনা সৃষ্টি হয়- দুষ্কৃত্যায়নের এই সংস্কৃতি হতে আসলে আমাদের আর মুক্তি নেই।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ জুন ২০১৯/তারা
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন