ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

পড়তে পারা, না-পারা

জাহাঙ্গীর আলম বকুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:৫০, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পড়তে পারা, না-পারা

জাহাঙ্গীর আলম বকুল :  ঝিনাইদহের একটি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ইংরেজি ‘সাবলীল’ পড়তে না পারায় ইংরেজি শিক্ষিকাকে সাময়িক বরখাস্ত করেছেন জেলা শিক্ষা অফিসার। কিন্তু মজার বিষয় হলো, যে ব্যক্তি অদক্ষতার অভিযোগে শিক্ষিকার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেন, তিনি বরখাস্তের চিঠিতে নিজেকে আরো অযোগ্য প্রমাণ করলেন। সেই চিঠিটি ভুলে ভরা। একটি অনলাইন পত্রিকা লিখেছে- তাতে ৪০টি ভুল রয়েছে। একাধিক অশুদ্ধ বাক্য রয়েছে।

তাহলে অযোগ্য কে, মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। স্কুল শিক্ষিকার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলে ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া অধিকতর যৌক্তিক।

এই দুই জন সরকারি কর্মচারির অদক্ষতা পুরো জনপ্রশাসনের প্রতিচ্ছবি নয়। বরং জনপ্রশাসনে দক্ষ ও যোগ্য লোকের সংখ্যাই বেশি। তবে এমন অযোগ্য কর্মকর্তাও অসংখ্য আছেন, সেটাও অস্বীকার করার সুযোগ নেই।

এখন সময় এসেছে, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ক্যাডার কর্মকর্তা নিয়োগের বিষয়টি ভাবার। একই সঙ্গে শিক্ষক নিয়োগে অধিকতর যোগ্যপ্রার্থী আকৃষ্ট এবং শতভাগ স্বচ্ছ নিয়োগ নিশ্চিত করার।

প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বিদেশি ভাষা ‘সাবলীল’ পড়তে না পারার দায় শুধু ওই ক্লাসের শিক্ষকের ওপর বর্তায় না। একজন শিক্ষার্থী একটি ক্লাসে ৭/৮ মাস পড়লেই দক্ষ হয়ে যায় না। শাস্তি যদি দিতেই হয়, তবে ওই শিক্ষার্থীদের আগের চারটি ক্লাসে যে সকল শিক্ষক ইংরেজি পড়িয়েছেন, তাদেরও দেয়া উচিত।

ব্যর্থতার দায় চাপিয়ে কয়েক জন শিক্ষককে বরখাস্ত করে কর্মকর্তারা নিজেদের দায় আড়াল করতে পারেন না। শিক্ষার্থীদের শেখানোর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে শিক্ষকদের, তাই তাদের ব্যর্থতার হিসাব নেয়া সহজ। কিন্তু এ কথা ভুললে চলবে না, এই শিক্ষকরা ব্যর্থ হলে জাতি ব্যর্থ হবে। এই শিক্ষকরা ১৪/১৫তম গ্রেডের কর্মচারি। এদের ওপর ছড়ি ঘোরাতে সকল কর্মকর্তা তৎপর থাকেন, কিন্তু তাদের ভার কেউ নিতে চান না।

জাতিকে শিক্ষিত করতে হলে এই শিক্ষকদের দিয়েই করতে হবে। এদের যোগ্য-দক্ষ করে না তুললে, কিছুটা মর্যাদা না দিলে তারা কীভাবে শিশুদের উন্নয়ন করবে। এই শিক্ষকরা যেভাবে ঊর্ধ্বতনদের দ্বারা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের শিকার হন, শিক্ষা অফিসের অফিস সহকারী, পিয়ন, আয়ারা যেভাবে তাদের হয়রানি করেন, তাতে তারা পদে পদে মর্মাহত ও অপমাণিত হন।

ঢাকা শহরের নামি-দামি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ‘সাবলীল’ ইংরেজি পড়তে পারে। গ্রামের স্কুলের শিক্ষার্থীরা পারেনি। গ্রামে এমন বহু হাইস্কুল আছে, যেখানে বহু শিক্ষার্থী বাংলা ভালো পড়তে পারে না। যারা পারে, তারা গ্রামের সচ্ছল বা অবস্থাপন্ন ঘরের সন্তান।

শুধু গ্রাম নয়, ঢাকা শহরেই ভিন্ন চিত্র আছে। এই শহরে নামি-দামি স্কুল আছে, যেখানে সচেতন ও সচ্ছল পরিবারের সন্তানরা পড়তে যায়, তারা সমাজের সুবিধাভোগী অংশ। তাদের পিছনে অভিভাবকরা কী পরিমাণ খরচ করেন, তা জানলে অবাক হতে হয়। এই ছাত্ররা সব কিছুই ‘সাবলীল’ পড়তে পারে।

আর কয়েকটি ছাড়া, ঢাকা শহরের বাকি সরকারি প্রাইমারি স্কুলে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত নিম্নবৃত্ত ঘরের সন্তানরা পড়ে। এই শিশুরা সারা বছর একটি জামা-প্যান্ট পরে এবং অধিকাংশ দিন কিছু না খেয়ে স্কুলে আসে। স্কুল থেকে ফিরেও অধিকাংশ শিশু পেটভরে থেতে পায় না। বাবা-মায়ের স্নেহ-ভালোবাসা কী তা জানে না। সারা দিন বাবা-মাযের বকা-ঝকা তাদের কপালে জোটে। এই বাচ্চাদের জীবনে উচ্চাঙ্ক্ষা নেই, কোনো রকমে  প্রাইমারি স্কুলে বাংলা পড়া এবং লেখার মতো শিক্ষা পেতে চায়। এদের জীবনে ঘটেও তাই। প্রাথমিক স্তর শেষে তাদের শিক্ষাজীবন শেষ হয়ে যায়।

গ্রামে বা শহরে এই বৃত্তের সন্তানদের ইংরেজি ‘সাবলীল’ পড়তে পারানো সহজ নয় এবং দায়িত্ব শুধু শিক্ষকদের নয়।

আগে সমাজের এই প্রকট শ্রেণিবৈষম্য ভাঙতে হবে। ঘোচাতে হবে শহর এবং গ্রামের মধ্যে দূরত্ব। একজন নিরীহ শিক্ষককে বরখাস্ত করে এর কোনোটা অর্জন হবে না। সমস্যার মূল কোথায়, তা অনুধাবন করার যোগ্যতা শিক্ষা কর্মকর্তার থাকতে হবে।


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১ সেপ্টেম্বর ‍২০১৯/বকুল

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়