জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার: কিছু কথা কিছু ব্যথা
চলচ্চিত্রকে সমাজের দর্পণ বলা হয়। সমাজের বিভিন্ন ন্যায়, অন্যায়, অসঙ্গতি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়। যা দেখে দর্শক বিনোদিত হওয়ার পাশাপাশি সচেতন হওয়ার অবকাশ পান। রুপালি পর্দায় শিল্পীদের অভিনয় দেখে বিমোহিত হন দর্শক। আলো ঝলমলে এই পর্দার পেছনে রয়েছে নির্মাতা, সংগীতশিল্পী ও কলাকুশলীরা। তাদের মেধার প্রকাশ ঘটান পর্দায়। তাদের কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পুরস্কার প্রদান করা হয়। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’। চলচ্চিত্র শিল্পের বিকাশ ও উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য ব্যক্তি, শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র ও প্রামাণ্যচিত্রে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান করে। সারা বছর এই পুরস্কারের জন্য মুখিয়ে থাকেন শিল্পী ও কলাকুশলীরা।
১৯৭৫ সাল থেকে এই পুরস্কার প্রদান করা হচ্ছে। ২০০৯ সালে প্রথম আজীবন সম্মাননা পুরস্কার চালু করা হয়। ঢাকার চলচ্চিত্রের বিভিন্ন অঙ্গনে জাতীয় পুরস্কার অধরা থেকে যাওয়া অগণিত তারকা রয়েছেন। এদের মধ্যে সংগীত পরিচালক থেকে শুরু করে মেকআপ ম্যান, ক্যামেরাম্যান, সম্পাদক, শিল্প নির্দেশক, শিশুশিল্পীও রয়েছেন। এ নিয়ে তাদের আক্ষেপও কম নয়। বিভিন্ন সময় সংবাদ মাধ্যমে আক্ষেপ করেছেন পুরস্কার বঞ্চিতরা।
ঢাকার চলচ্চিত্রে ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’, ‘সুজন সখী’, ‘দিন যায় কথা থাকে’সহ অনেক অসাধারণ সিনেমার নির্মাতা খান আতাউর রহমান। পরিচালক বা অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জোটেনি তার ভাগ্যে। যদিও চিত্রনাট্যকারের সম্মান পেয়েছেন তিনি। ‘ময়নামতি’, ‘অবুঝ মন’, ‘বধূ বিদায়’, ‘মধু মিলন’র মতো জনপ্রিয় সব সিনেমা নির্মাণ করেন খ্যাতিমান নির্মাতা কাজী জহির। তিনিও কখনো পাননি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের দেখা। ‘অশিক্ষিত’ ও ‘ছুটির ঘণ্টা’র মতো কালজয়ী সিনেমার জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাননি প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা আজিজুর রহমান। তিনি ৫০টিরও বেশি সিনেমা নির্মাণ করেন। নির্মাতাদের এই তালিকাও বেশ লম্বা।
এদিকে অভিনয় করে খ্যাতির চূড়ায় গিয়েও ভাগ্যে জোটেনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এমন অভিনেতাও রয়েছেন। ‘সারেং বউ’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘দিন যায় কথা থাকে’, ‘কথা দিলাম’সহ অসংখ্য সিনেমায় অভিনয় করে আকাশছোঁয়া দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছেন নায়ক ফারুক। তার দীর্ঘ অভিনয় জীবনে মাত্র একবার জাতীয় পুরস্কার দেয়া হয়েছে। তাও আবার পার্শ্ব অভিনেতা হিসেবে। ১৯৭৫ সালে নারায়ণ ঘোষ মিতার ‘লাঠিয়াল’ সিনেমার জন্য তাকে এই স্বীকৃতি দেয়া হয়। এ নিয়ে তার আক্ষেপও কম ছিলো না। সর্বশেষ ২০১৬ সালে তাকে যৌথভাবে আজীবন সন্মাননা প্রদান করা হয়। ১৯৮৭ সালে ‘সারেন্ডার’ সিনেমায় দুর্দান্ত অভিনয় করেন জসীম। নায়ক ও খলনায়ক হিসেবে বেশ কিছু জনপ্রিয় সিনেমায় অভিনয় করেছেন তিনি। এরপরও এই মুক্তিযোদ্ধার হাতে ওঠেনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ওয়াসিম, জাভেদসহ অনেকেই বঞ্চিত হয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার থেকে। ঢাকার সিনেমার স্টাইলিশ নায়ক হিসেবে খ্যাত জাফর ইকবাল। তার অভিনয় স্টাইল ছিল তরুণ দর্শকদের কাছে রীতিমতো অনুকরণীয়। তারপরও তিনি জাতীয় পুরস্কার প্রদানকারীদের মন জয় করতে পারেননি। বাংলাদেশের রোমান্টিক চলচ্চিত্রের ধ্রুবতারা, অমর চিত্রনায়ক সালমান শাহ। অভিনয়ের মাত্র চার বছরে দুই ডজনেরও বেশি সিনেমায় অভিনয় করেছেন। স্বল্প সময়ে তার মতো এমন অভিনয় দক্ষতা আর জনপ্রিয়তা অন্য কোনো নায়কের ভাগ্যে জোটেনি। অথচ তিনিও জাতীয় পুরস্কারে রয়ে গেলেন অধরা।
দর্শকদের আর্কষণ করার মোহনীয় ক্ষমতা থাকে নায়িকাদের। বিভিন্ন সময় দর্শকদের মন জয় করেছেন রুপালী পর্দার নায়িকারা। দর্শকন নন্দিত হলেও তাদের কারো কারো হাতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরুস্কার ওঠেনি। প্রখ্যাত অভিনেত্রী শবনম ১৩ বার নিগার ও ৩ বার পাকিস্তানের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেলেও পাননি বাংলাদেশের জাতীয় পুরস্কার। প্রায় এক ডজন বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। আশির দশকে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের ‘সন্ধি’ ও নব্বই দশকে নির্মিত কাজী হায়াতের ‘আম্মাজান’ চলচ্চিত্রে অসাধারণ অভিনয়ের করেও জাতীয় পুরস্কার পাননি। আরেক ডাকসাইটে অভিনেত্রী অঞ্জু ঘোষ ছিলেন অসম্ভব জনপ্রিয় একজন শিল্পী। বাংলাদেশের সবোর্চ্চ ব্যবসাসফল সিনেমা ‘বেদের মেয়ে জোছনা’। এই সিনেমায় অভিনয় করেও তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাননি। জাতীয় পুরস্কার না পাওয়া এমন নায়িকার তালিকা অনেক দীর্ঘ। এদের মধ্যে সর্বশেষ সংযোজন অপু বিশ্বাস। প্রায় একশ সিনেমায় অভিনয় করে তার হাতে ওঠেনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। তার অভিনীত অনেক সিনেমা ব্যবসা সফল হয়েছে। চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘দেবদাস’ সিনেমায় পার্বতী অর্থাৎ মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেও তিনি পাননি এই পুরস্কার। অথচ তার অভিনয়ের প্রশংসা করে খোদ এই সিনেমার নির্মাতা প্রয়াত চাষী নজরুল ইসলাম তার জীবদ্দশায় বলেছিলেন, ‘দেবদাস’ সিনেমায় অসাধারণ অভিনয়ের জন্য সেরা পুরস্কার অপুর প্রাপ্য ছিল।
গল্পকে শ্বাসরুদ্ধকরভাবে এগিয়ে নেয়াসহ সিনেমায় গতি এনে দেয় একজন খল-অভিনেতা। দর্শকের কাছে গ্রহণযোগ্য সিনেমা তৈরিতে খলনায়কের ভূমিকা অনেক। তাই নায়কের চেয়ে খলনায়কের গুরুত্ব মোটেও কম নয়। খলনায়কের কাজ হচ্ছে গল্পে ব্যঞ্জনা তৈরি করা। জনপ্রিয় অনেক খল অভিনেতা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এক সময়ের খল-অভিনেতা হিসেবে দর্শকপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন ইনাম আহমেদ। এ দেশের প্রথম বাংলা সিনেমা ‘মুখ ও মুখোশ’-এ অভিনয় করে দর্শকদের মধ্যে আলোড়ন তুলেছিলেন। তার ভাগ্যেও জোটেনি জাতীয় পুরস্কার। আরেক খ্যাতিমান খল-অভিনেতা আবদুল মতিনও জাতীয় পুরস্কার থেকে অধরা থেকে যান। খল চরিত্রে অভিনয় করে দক্ষতা দেখানো এমন জাতীয় পুরস্কার বঞ্চিত শিল্পীর তালিকাও নেহায়েত ছোট নয়। রাজ, আদিল কিংবা দারাশিকোর কথা এ দেশের দর্শক কখনো ভুলবে না। তাদের হাতেও ওঠেনি জাতীয় পুরস্কারের ট্রফি।
চলচ্চিত্রের একটি গুরত্বপূর্ণ অংশ হলো গান। গত চার দশক ধরে চলচ্চিত্রের গানের সঙ্গে যুক্ত প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী খুরশিদ আলম। তার গানের জনপ্রিয়তা কম নয়। চলচ্চিত্রে তার প্রায় পাঁচশ গানের মধ্যে ৯৮ ভাগই শ্রোতাপ্রিয়। অথচ এই জনপ্রিয় শিল্পী আজ পর্যন্ত জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাননি। এ নিয়ে তিনিও অভিমান করে মরণোত্তর পুরস্কার গ্রহণ না করার ঘোষণা দিয়েছেন। একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার, বাচসাস পুরস্কারসহ অনেক পুরস্কার পেয়েছেন কণ্ঠশিল্পী আবদুল জব্বার। কিন্তু জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার তিনি পাননি। আইয়ুব বাচ্চু বাংলা ব্যান্ড সংগীতে এক কিংবদন্তির নাম। গীতিকার, সুরকার, সংগীত পরিচালক, গিটারবাদক, গায়ক— সব মিলিয়ে আইয়ুব বাচ্চু। সিনেমার গানেও তার ভূমিকা রয়েছে। ‘অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে’, ‘আম্মাজান’, ‘স্বামী আর স্ত্রী বানাইছে কোন মিস্তিরি’সহ বেশ কিছু জনপ্রিয় গানে তিনি কণ্ঠ দিয়েছেন। কিন্তু জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার না পেয়েই পারি জমিয়েছেন এই শিল্পী।
দর্শকদের এক ঘেঁয়েমি থেকে বেড়িয়ে আসতে কৌতুক অভিনেতাদের ভূমিকা অনেক। প্রখ্যাত কৌতুক অভিনেতা টেলি সামাদ নিজ নামেই জনপ্রিয়। পাঁচ শতাধিক সিনেমায় অভিনয় করেছেন। পর্দায় তার উপস্থিতি মানে দর্শকদের হাততালি। কিন্তু আজ পর্যন্ত জাতীয় পুরস্কার জোটেনি তার কপালে। চলচ্চিত্র পুরস্কার না পেয়ে আক্ষেপ নিয়ে পরপারে পারি জমিয়েছেন কৌতুক অভিনেতা হাসমত, খান জয়নুল, রবিউল, বেবী জামানসহ অনেকে। পুরস্কার জোটেনি রহিমা খালা, মায়া হাজারিকা, সুমিতা দেবী, মিনু রহমান, মিনারা জামান, রিনা খানসহ অনেকের ভাগ্যে।
দেশবরেণ্য অনেক নির্মাতা, শিল্পী ও কলাকুশলী রয়েছেন। চলচ্চিত্র শিল্প বিকাশে তাদের অবদান ও ভিন্ন সময় দর্শকনন্দিত শিল্পকর্ম রয়েছে তাদের ক্যারিয়ারে। জীবদ্দশায় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়ে আত্মতৃপ্তির ঢেকুর নিতে পারেনি তাদের কেউ কেউ। আবার তাদেরই মৃত্যুর পরে মরোণত্তর পুরস্কার প্রদান করা হয়। মৃত্যুর পরে তাদের কদর বেড়ে যায়। আবার কেউ কেউ জীবিত থেকেও এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রের সবোর্চ্চ চলচ্চিত্র পুরস্কারের স্বাদ গ্রহণ করতে পারেনি। মনের অজান্তে এই যন্ত্রণায় জ্বলেন দেশের খ্যাতিমান শিল্পী ও কলাকুশলীরা। না পাওয়ার এই কথাগুলো ব্যথা হয়ে ভাসছে রুপালী আকাশে।
ঢাকা/রাহাত সাইফুল/তারা
রাইজিংবিডি.কম