বিষন্ন মুখ, বিষন্ন মন
চট্টগ্রামের পাথরঘাটার বিস্ফোরণে হতাহত স্বজনদের আর্তনাদ (ছবি : স্কাই নিউজ)
বিষণ্ণ মন। বার্তাকক্ষে খবরের শিরোনামগুলো বারবার দেখছিলাম। আর মনে পড়ছিল কবিতার পঙ্ক্তি- ‘হৃদয়ের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে চাপা কষ্টের যন্ত্রণা/মেহেদী পাতার মতো রক্তে রঞ্জিত, ক্ষত-বিক্ষত দেহবাস/গগন বিদারি চিৎকারে উদ্বিগ্ন চারপাশ/আমি বাঁচতে চাই, আমি বাঁচতে চাই, ধরণীর অতল তলে।’ [বিষণ্ণ মন, এমদাদ হোসেন নয়ন]
রোববার যখন বার্তাকক্ষে কাজ করছিলাম, তখন সহকর্মীরা সংবাদগুলো নিয়ে কাজ করছিলেন। শিরোনামগুলো হলো- ‘তাদের গন্তব্য পথেই থেমে গেছে’, ‘পছন্দের শাড়ি পরেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন’, ‘মায়ের সঙ্গে আর কোনো দিন স্কুলে যাবে না আতিফুর!’, ‘স্ত্রী-সন্তানের কাছে আর ফেরা হলো না নুরুলের’।
আঙ্গুলগুলো কী বোর্ডে কাজ করছে না। একবুক ব্যাথা নিয়ে কিছুক্ষণ কাজ করি আবার ওদের কথা ভাবি, কীভাবে বেঁচে থাকবে মা হারা সন্তানগুলো। ওদের ভবিষ্যৎ কী হবে? নানান প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খায়।
রোববার সকাল ৮টা। বাবা আর ভাইয়ের সঙ্গে নাস্তা খেয়ে মাকে নিয়ে স্কুলের জন্য তৈরি আতিফুর। বাবা কর্মস্থল চট্টগ্রাম কোর্ট বিল্ডিংয়ের উদ্দেশ্যে বিদায় দিয়েছেন। এরপর মা আর ভাইয়ের সঙ্গে স্কুলে যাচ্ছিল আতিফুর। পথে পাথরঘাটা ব্রিক ফিল্ড এলাকায় গ্যাস লাইনের বিস্ফোরণে দেয়াল চাপা পড়ে নিহত হন তার মা ফারজানা এবং ১০ বছর বয়সি ভাই আতিকুর। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় পাঁচ বছর বয়সি ছোট্ট আতিফুর রহমান। ছোট্ট শিশু আতিফুর এখনো বুঝতেই পারছে না তার মা এবং বড় ভাই মারা গেছে! আর কোনোদিন মায়ের সঙ্গে স্কুলে যেতে পারবে না সে।
রোববার থেকে শুরু হয়েছে পিএসসি পরীক্ষা। পটিয়া মেহেরআঁটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরীক্ষক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন অ্যানি বড়ুয়া। পরীক্ষায় ডিউটি আছে বলে পছন্দের শাড়িটিও পরেছিলেন তিনি। তবে সেই শাড়ি পরে আর স্কুলে যাওয়া হয়নি অ্যানির। আলিঙ্গন করতে হয়েছে মৃত্যুকে। চট্টগ্রামের পাথরঘাটায় গ্যাস লাইনের বিস্ফোরণে নিহত পথচারীদের তালিকায় নাম রয়েছে অ্যানি বড়ুয়ারও। তিনি চট্টগ্রামের পটিয়া মেহেরআঁটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন।
মাত্র দুই বছর আগে বিয়ে করেন রংমিস্ত্রি নুরুল ইসলাম। এক বছরের ছেলে আর স্ত্রীকে নিয়ে তার সংসার। শনিবার দিবাগত রাতব্যাপী চট্টগ্রামের পাথরঘাটা এলাকায় একটি বাসায় রঙের কাজ করেন তিনি। সকালে বাসার উদ্দেশে রওনা দেন। বাসায় অপেক্ষা ছিলেন স্ত্রী-সন্তান। কিন্তু বাসায় আর পৌঁছানো হয়নি। পাথরঘাটার বিস্ফোরণে দেয়াল চাপা পড়ে ঘটনাস্থলে মৃত্যু হয় নুরুলের।
সময় বাড়ছে, সাথে সাথে বার্তাকক্ষ যেন আরো ভারী হয়ে উঠছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। সন্ধ্যা হয়। বার্তাকক্ষে আবারো দুঃখের খবর আসে। পিএসসি পরীক্ষা দিয়ে বাসায় ফিরছিল লাজুক (১১)। কিন্তু ফেরা হলো না। ট্রাক বাসায় ফিরতে দেয়নি শিশুটিকে। ধাক্কা দিয়ে পাঠিয়ে দেয় না ফেরার দেশে। কিশোরগঞ্জ সদরের মারিয়া-বিন্নাটি সড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে। সে সময় লাজুক একটি ইজিবাইকে বসে ছিল।
বিষণ্ণ মুখগুলো আরো বিষণ্ণ হয়ে ওঠে। এত গেলো রোববার চট্টগ্রামে গ্যাস লাইন বিস্ফোরণ ও কিশোরগঞ্জের ঘটনা। সেদিনের রেল দুর্ঘটনার কথা মনে পড়ে। সেই সাথে মনে পড়ে ছোঁয়া মনির কথাও। গত সপ্তাহের (১২ নভেম্বর) ঘটনা। আদিবা আক্তার ছোঁয়া। বয়স তিন বছর। বাবা-মার সঙ্গে ট্রেনে যাচ্ছিল। রাতের ট্রেনে মায়ের কোলে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছিল সে। অথবা বাবার সাথে হয়তো খুনসুঁটিতে মেতে ছিল। তার খলখলে হাসিতে হয়তো আশপাশের কারো ঘুমের ব্যাঘাত হচ্ছিল। আর কখনো হাসবে ছোঁয়া। আচমকা তার হাসিটি কেড়ে নিয়ে গেছে সেদিনের সেই ট্রেন দুর্ঘটনা।
দুর্ঘটনা বাড়ছে। প্রাণহানি আর হতাহত স্বজনদের আহাজারিতে বাতাস ভারি হয়ে যাচ্ছে নিত্যদিন। এখনো রেশ কাটেনি। বুলবুলের কথা অনেকেরই মনে আছে এখনো। এতে প্রাণ গেছে অনেকের। বুলবুলের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কয়েকটি জেলার মানুষ। জীবিকার শেষ সম্বল ঘের ভেসে গেছে অনেকের। পথের ফকির হয়েছে অনেকেই। অথচ ঝড়ের আগেও তিনি হয়তো সমাজে মাথা উঁচু করেই চলতেন। এমন হাজারো মানুষ এখন দিশেহারা।
বিষণ্ণ এ মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াতে হবে। মানুষগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে তাদের বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করতে হবে। এদের জন্য মানবতাকে জাগাতে হবে। বাড়িয়ে দিতে হবে সহায়তার হাত। তাদের পাশে যদি উদার চিত্তে দাঁড়াতে না পারি তাহলে এমন মানব জনম বৃথাই হয়ে যাবে।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
ঢাকা/সাইফ/সনি
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন