ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

একুশে গ্রন্থমেলার মূল অংশে একীভূত হোক লিটলম্যাগ

শফিক হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৫৬, ৬ ডিসেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
একুশে গ্রন্থমেলার মূল অংশে একীভূত হোক লিটলম্যাগ

একুশে গ্রন্থমেলার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। দেরিতে হলেও স্থানান্তরিত হওয়ার আভাস মিলছে লিটলম্যাগ চত্বরের। সম্পাদক ও পাঠক লিটল ম্যাগাজিনকে আদর করে সংক্ষিপ্ত নামে ‘লিটলম্যাগ’ ডাকতেই পছন্দ করেন। এটি পরিচিত ‘ছোটকাগজ’ হিসেবেও। ছোটকাগজের সম্পাদকরা বরাবরই পালন করে আসছেন বড় দায়িত্ব। কেউ তাদের এটা পালন করতে বলেননি, স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই তারা এগিয়ে থাকেন সময়ের চাহিদা বুঝে।

বাংলা একাডেমির অভিন্ন বইমেলায় লিটলম্যাগ চত্বর ছিল বর্ধমান হাউজ ও প্রেস বিল্ডিংয়ের মাঝখানের জায়গাটুকু। জায়গাটি ‘বহেরাতলা’ নামেও সমধিক পরিচিত। বইমেলার অবিচ্ছেদ্য এই অংশ কালক্রমে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিসর বাড়ানোর উদ্দেশ্যে ২০১৪ সালে একুশে গ্রন্থমেলা স্থানান্তরিত করা হয় ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। লিটল ম্যাগাজিন থেকে যায় আগের জায়গাতেই। যদিও শুরু থেকেই বইমেলার সঙ্গে লিটলম্যাগ চত্বর একীভূত হবে না কি ঐতিহ্য ধরে রেখে আগের জায়গাতেই থাকবে এমন সিদ্ধান্তের দোলাচল ছিল। বিদ্যমান অবস্থায় লিটলম্যাগ সম্পাদকরা দুদিকেই অবস্থান নেন। অনেকে মূল মেলায় লিটলম্যাগকে একীভূত করার দাবি জানালেও, ছোট একটি অংশ ঐতিহ্যের বিষয় উল্লেখ করে স্থানান্তরের বিপক্ষে অবস্থান নেন।

এদিকে মূল মেলা সরে যাওয়ায় লিটলম্যাগ চত্বর ক্রমশ নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে। লেখক আড্ডা কিংবা পাঠক আড্ডা কোনোটিই তেমন অবশিষ্ট রইল না। লেখকরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই আড্ডা দেন, ভক্তদের সঙ্গে মিলিত হন। যারা একান্তই লিটলম্যাগের লেখক তারাও কেমন যেন আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। ফলে এ চত্বর হয়ে পড়ে আক্ষরিক অর্থেই জনশূন্য। বাংলা একাডেমির পুকুরপাড়ের একাংশ ও নজরুল মঞ্চের তিন দিকে এনজিওসহ কিছু স্টল বরাদ্দ দেয়া হলেও পাঠকের আগ্রহের কেন্দ্রে থাকা কোনো প্রকাশনা এদিকে থাকে না। ফলে মেলায় নিছক ঘুরতে আসা দর্শনার্থীও এদিকটা মাড়ান না।

লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকদের অধিকাংশই ঢাকার বাইরে অবস্থান করেন। ঢাকায় বসবাসকারীরাও চাকরি, ব্যবসা কিংবা অন্য কোনো কাজে জড়িত থাকায় স্টলে সময় দিতে পারেন না। তাদের স্টলে বসার জন্য মাসচুক্তিতে কর্মী নিয়োগ দিতে হয়। কর্মীর বেতনসহ আনুষঙ্গিক খরচ মিলিয়ে স্টলপ্রতি একমাসে খরচ হয় ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা। অথচ স্টলে এ পরিমাণ অর্থের চারভাগের একভাগও বিক্রি হয় না। লিটলম্যাগ কখনোই বাণিজ্যিক ধারায় ছিল না, তবুও সম্পাদকরা চান মেলা চলাকালীন খরচটুকু তুলে নিতে। এ বিষয়ে লিটলম্যাগ ‘খেয়া’ ও ‘প্রতিস্বর’ সম্পাদক পুলক হাসান ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় জানান, চলতি বছর তাকে গচ্চা দিতে হয়েছে প্রায় ১০ হাজার টাকা। স্টলটা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে থাকলে এতটা লোকসানের মুখোমুখি হয়তো হতে হতো না। অধিকাংশ লিটলম্যাগ সম্পাদকই নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

বাংলা একাডেমির কর্মকর্তা, চলতি বছর লিটলম্যাগ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা ড. আমিনুর রহমান সুলতান জানান, লিটলম্যাগ চত্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রাখার জন্য এবার বাঁশের খুঁটিও গাড়া হয়েছিল। পরে একশ্রেণির সম্পাদকের বাধার মুখে কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত পাল্টাতে বাধ্য হয়। পোড়খাওয়া সম্পাদকদের মনোবেদনা সঞ্চারিত হয়েছে প্রকাশনা সংশ্লিষ্ট অন্যদের মাঝেও। এ বিষয়ে এগিয়ে এসেছে ‘বাংলাদেশ লেখক ঐক্য’।  সংস্থাটির সভাপতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফাহমিদুল হক, সাধারণ সম্পাদক ‘হালখাতা’ সম্পাদক শওকত হোসেন। লেখক ঐক্যের উদ্যোগে গত ১ ডিসেম্বর বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী বরাবর একটি প্রস্তাবনা দেয়া হয় আনুষ্ঠানিকভাবে।

ছোটকাগজ ও সাহিত্য সম্পাদকদের ৭০ জনের স্বাক্ষরিত প্রস্তাবনামা নিয়ে উপস্থিত সম্পাদকরা কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ মত বিনিময় করেন। সম্পাদকদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সরকার আশরাফ, সম্পাদক : নিসর্গ; অনিকেত শামীম: সম্পাদক : লোক; পুলক হাসান, সম্পাদক : খেয়া; রিসি দলাই, সম্পাদক : সরলরেখা ও চারবাক; সোহেল মাজহার, সম্পাদক : কাশপাতা; শাহিন লতিফ, সম্পাদক : মেঘ; তৌহিদ ইমাম, সম্পাদক : মারমেইড; শওকত হোসেন, সম্পাদক : হালখাতা।

লেখক ঐক্যের প্রস্তাবনায় লিটলম্যাগ চত্বরকে মেলার মূল অংশে সৃজনশীল প্রকাশনাগুলোর সঙ্গে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্থানান্তরের সুপারিশ করা হয়। এতে বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে পাঠক-ক্রেতাসহ লেখকদেরও পারস্পরিক যোগাযোগের ক্ষেত্র বিস্তৃত হবে।

‘লেখক বলছি’ বা ‘লেখকমঞ্চ’র মতো ছোটকাগজের জন্যও স্বতন্ত্র একটা মঞ্চ থাকা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করা হয়। যেখানে আলাপ চলবে লিটলম্যাগ ও সাহিত্য বিষয়ে, ছোটকাগজের মোড়ক উন্মোচন হবে। স্টলের আকার বৃদ্ধির ওপরও জোর দেয়া হয়। যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিটি লিটলম্যাগকে বাংলা একাডেমি কর্তৃক ১০ হাজার টাকার বিজ্ঞাপন প্রদানের প্রস্তাব দেয়া হয়।

দাবিগুলোর প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে হাবীবুল্লাহ সিরাজী প্রতিশ্রুতি দেন, বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হবে। তিন সদস্যের একটি কমিটিও করে দেয়া হয়। আনুষঙ্গিক কাজ ও সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করবেন ‘নিসর্গ’ সম্পাদক সরকার আশরাফ, ‘লোক’ সম্পাদক অনিকেত শামীম ও ‘চারবাক’ সম্পাদক রিসি দলাই। সংশ্লিষ্টরা জানান, লিটলম্যাগ চত্বর স্থানান্তরিত হলে সবাই নানাভাবেই লাভবান হবেন। পাঠকরাও পাবে সাহিত্যের তুলনামূলক অনালোকিত ধারাটির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ।

চলতি বছরের লিটলম্যাগ স্থানান্তর বাধাগ্রস্ত হয়েছে অল্প যে কজন লিটলম্যাগকর্মী ও সম্পাদকের দ্বারা তারা এবার নতুন সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হবেন নাকি নতুন করে আবারও ওজর-আপত্তি তুলবেন সেটাও বিবেচনায় রাখছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলা একাডেমি এসব ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তে অটল থাকবে কিনা এমন বিষয়ও গুঞ্জরিত হচ্ছে। তবে পরিবর্তনের পক্ষের লিটলম্যাগকর্মী-সমর্থকরা নতুন এ সিদ্ধান্তে আশান্বিত হচ্ছেন, এর মাধ্যমে নিজেদের কাজকে যেমন পাঠক সমীপে তুলে ধরা যাবে, কমানো যাবে লোকসানের পরিমাণও। লিটলম্যাগের সঙ্গে জড়িতরা প্রকাশনা ব্যয় প্রায় পুরোটাই বহন করেন নিজেরা। বিজ্ঞাপনের আনুকূল্য কিংবা বিক্রিলব্ধ অর্থ কোনোটাই সেখানে মেলে না। নেই এর বড় কোনো পাঠকশ্রেণিও। তবুও নিজস্ব মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা ও নতুন সাহিত্যের বিকাশে কাজ করে চলেছেন শিল্প-নেশায় উন্মত্ত বিশুদ্ধ সাহিত্যিকরা!

লেখক : সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়