ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে দেওয়া-নেওয়া

আহমদ রফিক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:০৭, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে দেওয়া-নেওয়া

অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, পাকিস্তানি আবেগ ও অন্ধতা অতিক্রম করে পাকিস্তান নামক স্বপ্নভুবনটি প্রতিষ্ঠার মাস দুই আগে ও পরে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পাকসরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের সূচনা। শুরুতে লেখক, শিক্ষাবিদগণের প্রতিবাদী রচনা— দ্রুতই রাজপথে বিক্ষোভ। শুরুটা প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকায়। প্রতিবাদ ‘একমাত্র রাষ্ট্রভাষা উর্দুই হবে’— এই ঘোষণার বিরুদ্ধে।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই ছাত্র-শিক্ষকদের প্রতিবাদ। এরপর নভেম্বরে (১৯৪৭) নীলক্ষেত ব্যারাকের তৃতীয় শ্রেণীর সরকারি কর্মচারীদের অবিশ্বাস্য তৎপরতা— সভা ও মিছিলে প্রতিবাদ–স্লোগান: ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘সবকিছুতে বাংলা চাই’। সরকারি অপরিণামদর্শিতা— না, উর্দুই হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। নিহিত মনোভাব— এক দেশ, এক নেতা, এক রাষ্ট্রভাষা।

সেই একনেতা পাকিস্তানের স্থপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্’রও একই কথা— পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা একমাত্র উর্দুই হবে, অন্য কোনো ভাষা নয়। যেমন রাজধানী করাচিতে রাজসিংহাসনে বসে ঘোষণা, তেমনি ঢাকায় এসে রেসকোর্স মাঠে, কার্জন হলে এবং বেতার বক্তৃতায় ওই একই কথা। মেধাবী আইনজীবীর অদূরদর্শী ঘোষণা— ভেবে দেখেননি, পরিণাম কী হতে পারে।

ক্ষুব্ধ ছাত্রসমাজ। দ্বিধান্বিত, সংশয়গ্রস্ত রাজনৈতিক মহল, শিক্ষিত শ্রেণীর বড়সড়ো অংশ দোলাচলচিত্ত। কায়েদে আজমের মতামত বলে কথা। ছাত্রদের ছোট একাংশ, সরকারি সমর্থকগণ, সরকারি মতের অনুসারী— নিজের বিদ্যাবুদ্ধি ও মেধা, যুক্তিতর্ক খরচ করছে না এ প্রসঙ্গে। এক ধরনের অন্ধতা বলা চলে— পাকিস্তান বিষয়ক প্রবল অন্ধতা। কিন্তু বৃহত্তর ছাত্রসমাজ ভিন্ন পথ ধরে হাঁটছে। তারা প্রগতিবাদী ছাত্রযুবাদের যুক্তিবাদী রাজনীতি, জাতীয় স্বার্থের রাজনৈতিক পথের অনুসারী— মাতৃভাষার স্বার্থে, জাতীয় স্বার্থে। উর্দু তাদের বিচারে বিজাতীয় ভাষা। এতে অভ্যস্ত নয় বাঙালিসমাজ, মধ্যবিত্ত থেকে সাধারণ মানুষ— উর্দু তাদের জন্য অপরিচিত ভাষা, রপ্ত করতে সময় লাগবে, শ্রম লাগবে— তাতেও উর্দুভাষীদের সমমাত্রিক হতে পারবে না। সব সুবিধা উর্দুভাষীদের পাতেই যাবে।

দুই
এসব যুক্তিতথ্য নিয়ে বেশ কিছু লেখালেখি হয়েছিল। সংক্ষেপে বলতে নামগুলোর উল্লেখই যথেষ্ঠ। সাংবাদিক, লেখক আবদুল হক ও মাহবুব জামাল জাহেদি, শিক্ষাবিদ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্, মোতাহার হোসেন, ড. মুহাম্মদ এনামুল হক, ড. আবুল কাসেম, সাংবাদিক লেখক আবুল মনসুর আহমদ প্রমুখ।

এদের বিরুদ্ধে অর্থাৎ রাষ্ট্রভাষা উর্দুর পক্ষে কবি গোলাম মোস্তফা, মওলানা আকরম খাঁ, সাংবাদিক মুজীবর রহমান খাঁ এবং অনরূপ জনাকয় কবি-সাহিত্যিক। আশ্চর্য, এরা ধর্মীয় সংস্কৃতির টানে পূর্ব বাংলার জাতীয় স্বার্থ, আর্থ-সামাজিক স্বার্থ বিসর্জন দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি। ভাবেননি এদের উত্তরসূরিদের আর্থ-সামাজিক স্বার্থ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?

ভাবেননি আবার সেই বৈষম্য দেখা দেবে। দেখা দেবে পুবে-পশ্চিমে। দেখা দেবে রাষ্ট্রীয় জীবনে, জাতীয় জীবনে, শিক্ষার ক্ষেত্রে, জীবিকার ক্ষেত্রে— বলতে হয়, পূর্বঘটনার পুনরাবৃত্তি। বাঙালির আবার পিছিয়ে পড়া। যাকে বলে পুনর্মুষিক অবস্থা।

পাকিস্তানটা তাহলে এসেছে পশ্চিমাঞ্চলের জন্য, ভারত থেকে আগত উর্দুভাষী মোহাজেরদের জন্য? আর পশ্চিমাঞ্চলের ক্ষমতাশালী সামন্তভূস্বামী ও বিত্তবানদের জন্য যারা মূলত পাঞ্জাব এবং অংশত সিন্ধুর অধিবাসী। বিশেষভাবে উচ্চস্তরের সমরতন্ত্রের জন্য যারা শুরু থেকে নেপথ্যে থেকেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রেখেছে দেশের শাসন ব্যবস্থায়। পরে তো পর্যায়ক্রমে ক্ষমতা দখল করেছে এবং ক্ষমতা ভোগ করেছে এরাই।

পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থকে বিবেচনা করলে এখানকার ইতিহাস অভ্যন্তরীণ লড়াইয়ের ঐতিহ্যে পুষ্ট। অর্থাৎ প্রতিবাদ, প্রতিরোধ এবং আন্দোলন ও রক্ত ঝরার ঘটনাবলীতেই পূর্ণ। এবং সেটা প্রধানত পশ্চিম বনাম পূর্বে। তবে ঢালাওভাবে পশ্চিমাঞ্চল থেকে নয়। পশ্চিম বলতে মূলত পাঞ্জাব ও অংশত সিন্ধু— এক কথায় যারা কেন্দ্রীয় সামরিক শক্তির প্রতিনিধি। কিন্তু প্রদেশ বিবেচনায় বেলুচিস্তান ও সীমান্ত প্রদেশ ব্যতিক্রম। তারা আবার স্বশাসনের জন্য লড়াই করেছে পূর্ববঙ্গের মতো।

ওরা অনেক সংগ্রাম করেছে বিচ্ছিন্নভাবে। কিন্তু পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সমর শক্তির সঙ্গে ক্ষমতার লড়াইয়ে এঁটে উঠতে পারেনি। কেন্দ্রীয় শক্তি স্বদেশে তথা বেলুচিস্তানে বিদ্রোহ দমন করতে বোমা হামলা চালিয়েছে ব্যাপকভাবে। জেনারেল টিক্কা খান তার নিষ্ঠুরতার জন্য ‘বেলুচিস্তানের কসাই’ এই কুখ্যাতি অর্জন করেছে। সময়টা আইউবি শাসনের। একই লোক পূর্ববঙ্গে গণহত্যার সূচনা ঘটিয়েছে ইয়াহিয়া খানের আমলে, বাকিটা শেষ করেছে আরেক সামরিক লম্পট নিয়াজি।

তিন
ঘটনার ঘনঘটা এমনই যে, পুনরুক্তির প্রয়োজন পড়ে। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ লড়াইয়ের ইতিহাসের সূচনা ও বিচ্ছিন্নতার পরিসমাপ্তি পূর্ববঙ্গে। তাই এক বেলুচ নেতা আক্ষেপ করে বলেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানের মতো আমাদের ভূ-বিচ্ছিন্নতা এবং ভারতের সঙ্গে দীর্ঘ সীমান্ত থাকলে আমরা অনেক আগেই স্বাধীন হয়ে যেতে পারতাম। এমনই ছিল পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সংহতি। তাই পাকিস্তানি শাসকদের সর্বদা বিচ্ছিন্নতা নিয়ে শঙ্কায় থাকতে হয়েছে। তবে পূর্ববঙ্গের ছাত্র যুবসমাজ রাষ্ট্রভাষা নিয়ে প্রথম থেকেই যে লড়াই শুরু করে তা অল্প সময়ের মধ্যে বিস্ফোরক পর্যায়ে পৌঁছে ১৯৪৮-এর মার্চ থেকে ১৯৫০-এ মূলনীতি কমিটির উর্দু সুপারিশবিরোধী বিক্ষোভের মধ্যে দিয়ে ১৯৫২-এর বিস্ফোরক ফেব্রুয়ারিতে পৌঁছে। তৈরি হয় একুশের সংগ্রামী প্রেক্ষাপট। আবারো সেই স্লোগান: ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।’

একুশের স্বল্পস্থায়ী আন্দোলন সফলতা অর্জন করেছিল দুটো অসাধারণ ঘটনার ভিত্তিতে। প্রথমটি হলো ঢাকায় অবাঙালি-প্রধান প্রশাসনের জারি করা ১৪৪ ধারা ভাঙার দৃপ্ত প্রত্যয়ে এবং বাস্তবে তা ভেঙে। দ্বিতীয়ত সেই সূত্রে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার ওপর মেডিকেল ব্যারাক প্রাঙ্গণে পুলিশের গুলিবর্ষণজনিত ছাত্র-অছাত্রের শাহাদাত বরণে। ১৪৪ ধারা ভাঙা একদিকে পুলিশের মনোবলে আঘাত করেছিল, যেজন্য পুলিশ পরিনাম বিবেচনা না-করে গুলি চালিয়ে বেশ কিছুসংখ্যক বিক্ষোভকারীকে হতাহত করেছিল। ফলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া- সারাদেশে বিক্ষোভের আগুন জ্বলে ওঠে। স্লোগান ওঠে: ‘খুনি নুরুল আমিনের বিচার চাই’, ‘নুরুল আমিন গদি ছাড়’।

পুলিশের গুলিবর্ষণে হতাহতের কারণে ঢাকা শহরে যে আগুন জ্বলে ওঠে, সে আগুনে অতিদ্রুত ছড়িয়ে গেল সবখানে, অর্থাৎ প্রদেশের সর্বত্র— জেলা শহর থেকে মহকুমা শহর, থানা শহর হয়ে গ্রামের শিক্ষায়তনগুলোতে। স্কুল ছাত্ররা সংগ্রাম কমিটি গঠন করে আন্দোলনের সূচনা ঘটায়। ঢাকার মতোই স্লোগান ওঠে, ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’, ‘রাজবন্দিদের মুক্তি চাই’, ‘সর্বস্তরে বাংলা চালু কর’।

পুলিশের গুলিতে শহীদদের প্রতি গভীর সমবেদনায় ক্ষুব্ধ স্লোগান ‘শহীদ স্মৃতি অমর হোক’। আর শহীদ স্মৃতি অমর করে রাখতে ঢাকাসহ শহরে শহরে শহীদ মিনার নির্মাণ। এমনকি পরবর্তী সময়ে গ্রামের স্কুল প্রাঙ্গণেও স্থাপিত হয় ছোটখাট শহীদ মিনার। পুলিশ যথারীতি শহীদ মিনার ভাঙে, আবার তা গড়ে ওঠে। শহীদ মিনারের ইতিহাসও ভাঙা-গড়ার ইতিহাস, যেমন ঢাকায় তেমন দেশের অন্যত্র।

একুশের আন্দোলন দুটো গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখে— সাহিত্য, সংস্কৃতিতে এবং রাজনীতিতে। সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় বাঁকফেরা গুণগত পরিবর্তন— ভাষিক জাতীয়তাবাদী প্রতিবাদী চেতনায়, রাজনীতিতে একটা ধারায়। সাহিত্য সম্মেলনগুলো যদি এক দিককার পরিবর্তন সূচিত করে থাকে, তাহলে রাজনৈতিক পরিবর্তন যুক্তফ্রন্টের বিজয়ে এবং নব্য রাজনৈতিক চেতনার বিকাশে— পরিণামে ঊনসত্তরের গণঅভ্যত্থান এবং একাত্তরের (১৯৭১) স্বাধীনতা যুদ্ধে। অবশেষে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়।

আর শহীদ দিবস একুশে ফেব্রুয়ারি ইউনেস্কোর কল্যাণে ঘোষিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে। এ আরেক বিরাট অর্জন। কিন্তু এত বড় অর্জনের নেতিবাচক দিকটিও কম তাৎপর্যপূর্ণ নয়। স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রভাষা বাংলার স্বীকৃতির বাইরে আর সবই পূর্ববৎ। উপনিবেশিক রাষ্ট্রভাষা ইংরেজি এবং অনুরূপ সংস্কৃতি তাৎপর্যপূর্ণ স্থানগুলো দখল করে আছে যেমন—উচ্চশিক্ষা ও উচ্চ আদালত।

একুশে আমাদের দিয়েছে অনেক। কিন্তু আমরা নিয়েছি আমাদের প্রয়োজনমাফিক। তাই ঘটনাটি ট্র্যাজিক, সন্দেহ নেই। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে দেওয়া-নেওয়ার চরিত্রটি পুরোপুরি শ্রেণীভিত্তিক। 

লেখক: ভাষাসংগ্রামী, রবীন্দ্র গবেষক, প্রাবন্ধিক

 

ঢাকা/তারা/নাসিম 

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়