ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক ঘটনা প্রসঙ্গে

অনির্বাণ দে || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৩০, ৮ মার্চ ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক ঘটনা প্রসঙ্গে

সংস্কৃতি বলতে এখানে আমরা যা বুঝি, তার মধ্যে একটা শালীনতার মাত্রা নিহিত থাকে। এই মাত্রাটি ভীষণভাবে স্থান-কাল-পাত্র নির্ভর, অর্থাৎ এক পরিস্থিতিতে যা সুসংস্কৃতি, অন্য ক্ষেত্রে তা নাও হতে পারে এবং এটা মূলত ঠিক করে দেয় সেখানকার সমাজ।

রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা যা দেখতে পেলাম, তা দৃশ্য আকারে আজ দেখলেও, শব্দ আকারে আগেই শোনা হয়ে গেছে, জনৈক ব্যতিক্রমী ‘গায়ক’-এর গানের কলিতে। এ নিয়ে যত বিতর্কই হোক, তা থেকে অন্তত দুটি কথা বোঝা যায়। এক, তর্ক শুধু বিপক্ষে নয়, কিছু কিছু পক্ষেও। দুই, যারা এটা করেছেন, তারা পছন্দ করেছেন বলেই করেছেন এবং অনেকে এটা উপভোগ করেছেন, করেন। কারা উপভোগ করেছেন? যারা প্রদর্শনকারী, তাদের সঙ্গী, বন্ধুস্থানীয়? শুধু কি তাই? ওই প্রদর্শনের ভাষা দেখে মনে হয়, তারা যেন প্রচলিত সামাজিক সীমারেখা ভেঙে বেরোনোর চেষ্টা করেছেন। এই ‘ভেঙে বেরোনোর’ মধ্যে একটা আনন্দ আছে। এই আনন্দ অনেকে অনেকভাবে পেয়ে থাকেন। কেউ সেই আনন্দ পান ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে’- এমন একটি গান রচনা করে। কেউ-বা আনন্দ পান সেই গান শুনে, গেয়ে! কিন্তু এই ক্ষেত্রে আনন্দ পাওয়ার (বা দেওয়ার?) মাধ্যম হিসেবে কয়েকজন ব্যবহার করেছেন কিছু শব্দবন্ধ, মূলধারার সংস্কৃতির নিরিখে যা হলো ইতর ভাষা।

তাদের এই আনন্দের ভাগীদার শুধু ওখানে উপস্থিত কিছু মানুষ নন, এমন অনেক মানুষ এই সমাজেই ছড়িয়ে রয়েছেন! অর্থাৎ ওই জনাকয়েক, যারা এই ঘটনা ঘটিয়েছেন, তারা এই সমাজের একটি অংশের প্রতিনিধিও বটে। যারা অবদমিত নানা প্রবৃত্তিকে সংযত করে রাখার সামাজিক বিধিটুকু মানতে চান না। তাকে আক্রমণ করতে চান, বারবার আঘাত করতে চান, ভাঙতে চান এবং তা অবশ্যই সুযোগ-সুবিধা ও পরিস্থিতির আনুকূল্য অনুযায়ী। অন্যদিকে যারা এই কাজ পছন্দ করছেন না, তারা যখন প্রতিবাদ করছেন, প্রশ্ন তুলছেন, তখনই শুরু হচ্ছে বিতর্ক। যা একটি বহুচর্চিত প্রসঙ্গ উস্কে দিচ্ছে- ‘স্বাধীনতা’! ব্যক্তি-স্বাধীনতা, বাক-স্বাধীনতা, ভাব-প্রকাশের স্বাধীনতা!

ঘটনা হলো এই প্রসঙ্গটি এর আগেও বহুবার উঠেছে, সাম্প্রতিককালেও। কখনো কোনো দেব-দেবী নিয়ে আঁকা ছবি বা বর্ণনা নিয়ে, কখনও বা রাষ্ট্রের আইন, সার্বভৌমত্ব ও রাষ্ট্রনায়ক নিয়ে মন্তব্য ও বিভিন্ন আচরণ নিয়ে, কখনও বা ‘হোকচুম্বন’-এর মতো নিছকই সামাজিক বিষয়ে নিয়ে। যে উদাহরণগুলো দিলাম, তার প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই জনমানসে একটা আড়াআড়ি বিভাজন লক্ষ্য করা গিয়েছিল। কিন্তু বিশ্বভারতীর এই ঘটনাটিতে যেন বিপক্ষের পাল্লাটা একটু ভারী। অর্থাৎ ধরে নেওয়া যায়, এই ঘটনাটি সমাজের অপেক্ষাকৃত বেশিসংখ্যক মানুষকে আঘাত করেছে, যা আগের ঘটনাগুলোতে তেমনভাবে হয়নি। কিন্তু বিতর্ক প্রতিটি ক্ষেত্রেই হয়েছিল। যারা ওই ঘটনাগুলোর পক্ষে মত দিয়েছিলেন, তারা স্বপক্ষে নানা যুক্তিও দিয়েছিলেন। সেগুলোও ছিল সেই ‘স্বাধীনতা’র ধারণার উপর আধারিত। এবার প্রশ্ন হলো, তারা যে আক্রমণটি করেছিলেন তার নিশানা ছিল এই দেশের সংস্কৃতি, কিন্তু সে আক্রমণের অস্ত্র হিসেবে তারা যা ব্যবহার করেছিলেন, তা কিন্তু এদেশীয় ছিল না! বিদেশী কষ্টিপাথরে স্বদেশী সংস্কৃতি যাচাই করা কতটা সমীচীন? কাজটি করলে তার ফল-ই বা কী হতে পারে?

একটা সম্পূর্ণ অন্য উদাহরণ দেওয়া যাক। নোবেল পুরস্কার দেওয়ার যে কমিটি আছে, তাদের সদস্যরা একথা একাধিকবার স্বীকার করেছেন, ‘উপযুক্ত’ অনুবাদের অভাবে আমাদের বহু সাহিত্যিক ওই পুরস্কারটি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, বহুবার। এখন প্রশ্ন হলো, একখানা ‘আরণ্যক’ বা একখানা ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ কিংবা একখানা ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র উপযুক্ত অনুবাদ কতদূর হওয়া সম্ভব? অপর দিকে ‘হোকচুম্বন’ ছিল ‘পিডিএ’ বা ‘পাবলিক ডিসপ্লে অফ অ্যাফেকশন’ নামক বিষয়ের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। পিডিএ নামটি পশ্চিমী, সন্দেহ নেই। এখন কথা হলো এই ধরনের ব্যাপার-স্যাপার ঠেকানোর জন্য আমাদের দেশে একটি আইনও আছে, ভারতীয় দণ্ডবিধির ২৯৪ নম্বর ধারা। কিন্তু সেটা তখন প্রয়োগ হয়েছিল বলে জানা নেই। জানা নেই বিখ্যাত হলিউড নায়ক রিচার্ড গিয়ারের এইডস সচেতনতার প্রকাশ্য মঞ্চ থেকে ভারতের শিল্পা শেঠীর সঙ্গে ওই একই ধরনের ঘটনা ঘটানোর জন্য গ্রেপ্তার করা হয়েছিল বলে। এদেশের সমাজ সাধারণত এগুলো মানুষের বিবেকবুদ্ধির উপরেই ছেড়ে দেন। তবে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে এই দেশ যতটা নমনীয়, সব দেশ কিন্তু তা নয়। বিশেষত এই ধরনের ঘটনার স্বপক্ষে যারা যুক্তি দেন, তারা যেসব দেশের উদাহরণ দেন, সেই সব দেশেই আবার অনেক ঘটনায় রীতিমত কঠোর অবস্থান নিয়ে থাকে, যা হয়ত এদেশের লোকের বিচারে নেহাতই তুচ্ছ! যেমন? অভিজ্ঞান চক্রবর্তী এবং ঐশ্বর্য চক্রবর্তীর কথা মনে আছে? যাদের নেই, একটু স্মরণ করিয়ে দেই এই দুজনকে নরওয়ের শিশুকল্যাণ পরিষেবা বিষয়ক বিভাগ আটক করে রেখেছিল ২০১১ সালের মে মাস থেকে। তাদের অপরাধ?

সে অতি গুরুতর অভিযোগ! মা সন্তানকে নিজের হাতে খাইয়েছিলেন, আর বাবা নাকি ছেলেকে নিয়ে নিজের বিছানায় শুতেন! তখন ছেলের বয়স তিন বছর, আর মেয়ের? স্রেফ এক বছর! ভারতীয় সংস্কৃতির এই ‘ঘোর অপরাধ’র শিকার তাদের সন্তান যাতে না হয়; অর্থাৎ এ কারণে তাদের মা-বাবা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছিল; ওই বয়সে! বহু আবেদন নিবেদন করে কাজ না হওয়ায় সেই বাবা-মাকে তৎকালীন ভারতের রাষ্ট্রপতির দ্বারস্থ হতে হয়েছিল, নিজেদের সন্তান ফেরত পাওয়ার জন্য। ভারতীয় দূতাবাস বহুভাবে ওদের বোঝানোর চেষ্টা করেছিল- এর ফলে শিশু দুটি শুধু যে মা-বাবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তাই নয়, নিজের দেশের ভাষা ও সংস্কৃতি থেকেও তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। অবশেষে ২০১২ সালের এপ্রিলে তারা মুক্তি পায়। কিন্তু হেফাজত সরাসরি বাবা-মাকে দেওয়া হয়নি। কারণ সেদেশের আইন অনুযায়ী তারা সন্তানকে যথাযথভাবে লালন-পালন করতে অক্ষম!

এখন নরওয়ে ইউরোপের একটি অতি উন্নত দেশ। এতটাই যে এমন কোনো আন্তর্জাতিক মানব উন্নয়ন সূচক পাওয়া মুশকিল যাতে তারা প্রথম সারিতে থাকে না। অর্থাৎ এটা ধরে নেওয়া যায়, এমন উন্নত দেশের আচার-আচরণ অত্যন্ত উচ্চ মানের এবং প্রবলভাবে গ্রহণীয় মনে করা হয়। আর সেক্ষেত্রে কোনো রকম আপোসে তারা রাজি নয়।

হতে পারে ওপরের যে পাশ্চাত্য প্রবল ইন্দ্রিয়বাদের বিপরীতে ভারতীয় সংযমের দর্শন নেহাতই ফিকে, আকর্ষণহীন হয়ে উঠেছে আমাদের প্রচণ্ড গতিশীল জীবনে। হতে পারে এদেশের মায়েরা যে ভাষায়-ভঙ্গীতে সন্তানের স্নেহভাবের আদান-প্রদান করেন তার ‘উপযুক্ত অনুবাদ-ব্যবস্থা’ এখনও গড়ে ওঠেনি। তার ফলে নরওয়ের ‘চাইল্ড ওয়েলফেয়ার সার্ভিসেস’ কতকটা ‘সুইডিশ অ্যাকাডেমি’র মতই অপারগ ছিলেন অসহায় মা সাগরিকা চক্রবর্তীর মনোভাব বুঝতে। এ প্রসঙ্গে একটা কথা না বললেই নয়। ভারত ছাড়া পৃথিবীর বহু দেশ অতীতে উপনিবেশ তৈরি করত। সেসব ছিল মূলত রাজনৈতিক উপনিবেশ। আর সুসভ্য ইউরোপ ছিল এর পুরোধা। গণতন্ত্রের আবিষ্কার হওয়ার পর সেসব ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে বটে, কিন্তু আবার অন্য রূপে সেই ঔপনিবেশিকতা যেন ফিরে ফিরে আসে। কখনো অর্থনৈতিক ঔপনিবেশিকতায়, কখনো বা ভাষা ও সাংস্কৃতিক ঔপনিবেশিকতার হাত ধরে। উদ্দেশ্য সেই একই- ‘তুমি তোমার মত থাকবে না, তুমি আমার মত হবে!’

আর সেই কাজে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো কিন্তু ক্রমশ আরো সফল হচ্ছে। এর কারণ এই উপনিবেশ বিস্তার করতে অস্ত্র লাগে না, লাগে সুচতুর বিপণন কৌশল। যাতে অপেক্ষাকৃত মুক্তমনা দেশের মানুষেরা মনের অজান্তেই সেই প্রবল পরাক্রমী ‘সভ্যতা’র দাসে পরিণত হয় আর নিজের দেশ-সমাজ-সংস্কৃতিকে বিচার করতে বসে সে বিদেশের নিরিখে। অবচেতনে তাই আমরা যেন এগিয়ে চলেছি একমেরু কোনো বিশ্বের দিকে, যেখানে থাকবে শুধু একটাই ভাষা, একটাই সংস্কৃতি, একটাই ধর্ম, ধীরে ধীরে, কিন্তু নিশ্চিতভাবে।


কলকাতা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ