ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

ফেসবুকে গুজব কেন ছড়ায়?

মোহাম্মদ নূরুল হক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৫৬, ৮ মে ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ফেসবুকে গুজব কেন ছড়ায়?

বাঙালির গুজবপ্রীতি হয়তো একদিন কিংবদন্তিতে পরিণত হবে!

এদেশের মানুষ মিথ্যাকে যত দ্রুত গ্রহণ করে, সত্যকে তত নয়। এর কারণ হয়তো এই— বাঙালি আবহমান কাল থেকেই গল্পপ্রিয়। সুপ্রাচীনকাল থেকেই রূপকথা-উপকথা শুনে-শুনে এই তার মানসগঠিত হয়েছে। এসব কাহিনীর পরতে পরতে যত অ্যাডভেঞ্চার-রোমান্স লুকিয়ে থাকে, একটি নিরেট সত্যবাক্যে তার লেশমাত্রও থাকে না। নিরেট-রসহীন-রুঢ় সত্য বেশিরভাগই হজম করতে পারে না। আজন্ম রূপকথাপ্রেমী বাঙালির তো ভালো লাগার কথাও নয়। কারণ, তার কাছে  ‘যতপ্রিয় মোহন মিথ্যারা, সত্য তত প্রিয় নয়।’ এই মোহনমিথ্যার ফাঁদে পড়েই অধিকাংশ নাগরিক আজ বিভ্রান্ত। আর এই বিভ্রান্তির পালে নতুন করে হাওয়া দিচ্ছে ফেসবুক।

ফেসবুক ব্যক্তির ইচ্ছাধিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। ফেসবুক অ্যাকাউন্টধারীর কোনো পোস্ট অন্য কারও সম্পাদনার অধিকার নেই। আইডি যার, ইচ্ছাও তার। ফলে সেখানে যখন যা খুশি ব্যক্তি লিখতে পারে। এ যেন ‘পাগলার হাতে কুঠার’ দেওয়ার মতো ব্যাপার! পাগলা হাতে কুঠার পেলো তো, ‘ফলদ-বনজ’— যেই গাছই সামনে পড়ুক, তাতেই কোপ বসাবে। এমনকী গোলাপের চারা পেলেও। তার হাত থেকে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো গাছেরই মুক্তি পাওয়ার উপায় নেই। এই নির্বিচারে গাছকাটা পাগল যেমন নির্দয় বিবেকহীন, তেমনি কাণ্ডজ্ঞানহীন ফেসবুকাররাও।  তারাও কখনো উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে, কখনো বা অন্যের মাধ্যমে প্ররোচিত হয়ে মিথ্যা তথ্য ছড়ায়। কখনো আবার ‘ভুয়া-বানোয়াট’ তথ্য ছড়ায় না বুঝেই।

এই গুজব ছড়ানোর পেছনে বেশ কিছু কারণ থাকতে পারে। সম্ভাব্য কারণগুলো হলো:

   ১। কারও প্রতি বিদ্বেষ-প্রতিহিংসাপরায়ণতা
   ২। সবার আগে তথ্য পৌঁছানোর প্রযোগিতা
   ৩। হিরোইজম
   ৪। ক্রসচেক না করা
   ৫। অন্যের মাধ্যমে প্ররোচিত হওয়া

ফেসবুক পর্যালোচনা করলে প্রথমে ধরা পড়বে বিদ্বেষের বিষয়টি।  কারও প্রতি কেউ বিদ্বেষপোষণ করলে তখন তার মধ্যে প্রতিহিংসাপ্রবণতাও কাজ করে। আর তখনই সে সুযোগ খুঁজতে থাকে প্রতিপক্ষের কোনো ত্রুটি পাওয়া যায় কি না। এই ক্ষেত্রে প্রায় দোষ-গুণ বিবেচনা না করেও প্রতিপক্ষের কুৎসা রটানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়ে গুজব রটনাকারী। এতে বেশিরভাগই ধর্মীয়-গোষ্ঠীগত বিদ্বেষ প্রাধান্য পায়। তবে, ধর্মান্ধরা প্রগতিশীলদের ক্ষেত্রে বেশি কুৎসা রটায়। 

এরপরই গুরুত্ব পায় কোনো একটি ‘বিশেষ তথ্য’ সবার আগে জানানোর প্রতিযোগিতার মনোভাব। ওই মুহূর্তে গুজব ছড়ানো ব্যক্তির একমাত্র লক্ষ্যই থাকে— সবার আগে তার তথ্য ‘রাষ্ট্র’ করে দেওয়ার।  আর এই সবার আগে তথ্য জানিয়ে দেওয়ার ভেতর এক ধরনের হিরোইজমও কাজ করে। ফলে ঘটনার সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের সুযোগ নেয় না ওই ব্যক্তি। এছাড়া, কিছু গুজব রটনাকারী অন্যের মাধ্যমেও প্ররোচিত হয়। তারা জানতেও চায় না, নিজ-নিজ টাইমলাইনে যা প্রচার করছে, তার আদৌ কোনো ভিত্তি আছে কি না। তখন পূর্ববর্তী পোস্টদাতার মন রক্ষার্থেও ফেসবুকাররা যাছাই ছাড়াই তথ্য শেয়ার করতে থাকে। এতে কার মানহানি হলো, কার প্রাণ গেলো, তাতে ওই গুজব রটনাকারীদের কোনো মাথাব্যথা থাকে না। তারা বরং আড়ালে বসে, সমাজে কী পরিমাণ বিভ্রান্তি  ছড়ালো, তার হিসাব কষতে বসে। একই সঙ্গে তাদের পোস্টের লাইক-কমেন্ট গুনতে থাকে।

এই ধরনের গুজবের জন্য যে একচেটিয়া রটনাকারীরা দায়, তা নয়। এর জন্য অর্ধেক দায়ী গুজবের ভোক্তাশ্রেণীও। এই ভোক্তাশ্রেণীর মধ্যে যেমন অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত রয়েছেন, তেমনি রয়েছেন উচ্চশিক্ষিতরাও। অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিতদের গুজব বিষয়ে সতর্ক করলেই তারা প্রায়ই মেনে নেন। পাল্টা যুক্তি দেখান না। নিজের ভুল শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু উচ্চশিক্ষিতদের গুজব ও বস্তুনিষ্ঠ তথ্যের পার্থক্য বোঝানো কঠিন। প্রথমত, তারা উচ্চশিক্ষিত— বিষয়টি তারা জানেন, মনেপ্রাণে নিজেদের এলিটও ভাবেন। দ্বিতীয়ত, এই শ্রেণীর দাবি—তারা যেহেতু উচ্চশিক্ষিত, সেহেতু গড়পড়তা সমাজের চেয়ে তারা বেশি বোঝেন। তাদের অন্য কেউ কোনো বিষয়ে বোঝানোর চেষ্টা করলে তারা চরম ইগো প্রবলেমে ভোগেন। কখনো কখনো উত্তেজিতও হয়ে পড়েন। তখন তারা অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিতদের ভুল বুঝিয়ে নিজেদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করেন। ঠিক ওই মুহূর্তে কিছু লোক এই উচ্চশিক্ষিতদের দলে ভিড়েও যান। আর তাতেই ঘটে যত বিপত্তি।

অনেক সময় এই উচ্চশিক্ষিতরা নির্ভরযোগ্য সূত্র-গণমাধ্যমের চেয়ে বেশি বিশ্বাস করে ফেসবুককে। ফেসবুকে যা কিছুই পান, তাতে কোনো রকম সন্দেহপোষণ করেন না তারা। অমনি হামলে পড়েন। সেই তথ্য প্রচারের রীতিমতো প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন। এই ক’দিন আগে মুগদা হাসপাতালে ভর্তি হলেন মুনতাসীর মামুন। ‘তিনি মারা গেছেন’— এমন গুজব গত সোমবার (৪ মে) দিবাগত রাতেই ছড়িয়ে দেয় বেশ কয়েকজন রটনাকারী। আর ওই রটনাকারীদের গুজবে সাধারণ নাগরিক তো বিভ্রান্ত হয়েছেনই, সঙ্গে ওই ‘ভুয়া তথ্যযুক্ত’ পোস্টগুলো শেয়ার করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন খোদ গণমাধ্যমকর্মীদেরই কেউ কেউ। অথচ তারা চাইলেই সহজে মুগদা হাসপাতালে ফোন করে এই ইতিহাসবিদ-শিক্ষাবিদের খোঁজ-খবর নিতে পারতেন। হাতের কাছে নির্ভরযোগ্য সূত্র থাকার পরও তারা সেদিকে গেলেন না। গেলেন ফেসবুকের ভুয়া তথ্যে গা ভাসানোর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে।

ঘটনা এখানেই শেষ নয়, আরও আছে। এরপর গত ৫ মে এমপি হাবিবুর রহমান মোল্লাকে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া এবং তার একান্ত সহকারী জামাল উদ্দিন। এই দুজনের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমও সেই সংবাদ প্রকাশ করে। অথচ বিশ্বস্ত-দায়িত্বশীল সূত্রগুলোর বরাতে প্রকাশিত ওই  সংবাদের তোয়াক্কা না করে বেশ কয়েকজন ব্যক্তি এমপি মোল্লার মৃত্যুসংবাদে ফেসবুকের টাইমলাইন ভাসিয়ে দিলেন। যদিও পরদিন সকালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

বিস্ময়কর হলেও সত্য— এই দুটি ঘটনায় আরও অবাক হওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। প্রথমজনের ক্ষেত্রে কেবল মৃত্যুসংবাদই ছড়ায়নি গুজব সৃষ্টিকারীরা,  তাকে নিয়ে অনেক অশ্রদ্ধাপূর্ণ উক্তিও করেছে।

এসব ঘটনা পর্যালোচনা করলে একটি বিষয় পরিষ্কার বোঝা যায়— শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত-অশিক্ষিত—নির্বিচারে বেশিরভাগই নির্ভরযোগ্য সূত্র-দায়িত্বশীল মানুষের দেওয়া তথ্যের চেয়ে অসমর্থিত সূত্রের খবরে বেশি প্রলুব্ধ হয়। তারা একবারও খেয়াল করে না— ফেসবুকের সিংহভাগই গুজব।

তাদের এই ফেসবুকনির্ভরতা একদিন ভয়ানক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।  উল্টো তারা যুক্তির ডালা নিয়ে বসেন। বলেন, ‘গণমাধ্যম তথ্য সেন্সর করে। কাটছাঁট করে।’ তাই ফেসবুক নাকি বিকল্প গণমাধ্যম হয়ে উঠেছে। এমন যুক্তি দেওয়ার সময় তারা ঘুণাক্ষরেও ভেবে দেখেন না— যেখানে জবাবদিহিতার নিশ্চয়তা নেই, সেখান থেকে বস্তুনিষ্ঠ তথ্য আসার সম্ভাবনাও অতি ক্ষীণ। কারণ, বাড়িতে নিম গাছ লাগালে, নিম ফলই পাওয়া যাবে, দেখতে অনেকটা একইরকম হলেও মিষ্টি আঙুর মিলবে না। সেখানে মনগড়া-মনভোলানো ও বিভ্রান্তিকর তথ্যেরই পসরা থাকবে। থাকবে নিরেট গুজব।

আর গুজব সৃষ্টিকারীদের প্রধান উদ্দেশ্য হলো— সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা। সমাজ হানাহানিতে লিপ্ত হলে তারা পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে পারবে। কারণ এই গুজব সৃষ্টিকারীদের পারিবারিক-সামাজিক-শিক্ষাগত যোগ্যতার অতীত-বর্তমান বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে— তাদের অতীতে হয়তো ধোঁকাবাজি-প্রতারণা স্বভাব ছিল, নয়তো ছিনতাইয়ে মতো হীনকর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিল। মানুষে মানুষে ঝগড়া বাধিয়ে তারা ফায়দা লুটতো। এখন তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। তথ্যবিভ্রাটের জন্য তাদের অবারিত সুযোগ। সেই সুযোগের অপব্যবহার তারা করছে। কিন্তু এভাবে বেশি দিন চলতে দেওয়া যায় না।

গুজব প্রতিরোধে আমাদের মনে রাখতে হবে— একশটি গুজব প্রচারের চেয়ে একটি সত্য ঘটনা প্রয়োজনে চাপা পড়ে যাক। তাতে একটি পরিবার হয়তো তাৎক্ষণিক ন্যায়বিচার বঞ্চিত হবে। হয়তো একটি ঘটনা জনতার সামনে আসার সুযোগ পাবে না। তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে মাত্র একটি পরিবার। কখনো কখনো একজন মাত্র ব্যক্তি।  কিন্তু একটি মাত্র গুজবও যদি মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে পুরো জাতির ভেতর বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে। সৃষ্টি হতে পারে সাম্প্রদায়িক কিংবা গোষ্ঠীগত দাঙ্গাও। নিকট অতীতে এমন ঘটনার বহু নজির রয়েছে। সেসব ঘটনা জাতি এখনো ভুলে যায়নি বলে এখানে আর উল্লেখ করলাম না।

তাই, এই মুহূর্তে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া গুজব প্রতিরোধে প্রশাসনকে আরও কঠোর হতে হবে। বাড়াতে হবে মনিটরিং। কোনো একটি মিথ্যা পোস্ট দেওয়ার পর খবর পাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে শনাক্ত করতে হবে গুজব সৃষ্টিকারীকে। সে গুজব যত হালকাই হোক, তবুও। এরপর যত দ্রুত সম্ভব তাকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

লেখক: কবি-প্রাবন্ধিক-সংবাদকর্মী

[email protected]


ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়