ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

আমাদের বাজেট, ‘আমরা’ কোথায়?

উম্মে সালমা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ১০ জুন ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
আমাদের বাজেট, ‘আমরা’ কোথায়?

নতুন বছরের নানা সম্ভাবনার বার্তা নিয়ে প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিন দ্যা ইকোনমিস্ট প্রকাশিত ‘দ্যা ওয়ার্ল্ড ইন ২০২০’ এর বিশেষ সংখ্যায় জিডিপি প্রবৃদ্ধির দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা শীর্ষ দশটি দেশের তালিকায় বাংলাদেশ তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হালনাগাদের সর্বশেষ প্রতিবেদন বিশ্লেষণে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদসংস্থা ব্লুমবার্গ বলছে ২০১৯ সালে বিশ্ব জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রায় ৮৬ শতাংশ এসেছে যে ২০টি দেশ থেকে, তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি।

সরকারি হিসাবে উর্দ্ধগতিতে এগোচ্ছে আমাদের জিডিপি। কিন্তু এর বাস্তব চিত্রটি কেমন?

গত এক দশকে আমাদের উচ্চ প্রবৃদ্ধির সঙ্গে বেকারত্ব বেড়েছে, প্রকৃত মজুরি কমেছে, বদলেছে দারিদ্র্যের ধরন। উচ্চ প্রবৃদ্ধির উন্নয়নের সার্বিক অবস্থা কাদাটে, ঘোলাটে। প্রতি বছর বাজেটের আকার বেড়ে চলেছে। স্বাধীনতার ৪৮ বছরে বাজেটের আকার বেড়েছে ৬৬৬ গুন। সে অনুপাতে বাজেটের বাস্তবায়নের হার বেড়েছে কতখানি? বাজেটে মৌলিক সমস্যা সমাধানের দিকে দৃষ্টি দেওয়া হচ্ছে কি? সক্ষমতার খাতগুলোতে উর্দ্ধগতি আদৌ কি এসেছে?

‘লক্ষ্যমাত্রা পূরণের বাজেট’ শিরোনামে অভিহিত ২০১৯-২০ অর্থবছরের ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার বাজেট বিশ্লেষণে অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য বলেছিলেন ‘এই বাজেট স্বচ্ছল উচ্চ আয়ের মানুষকে অনেক বেশি সুবিধা দিচ্ছে৷ কিন্তু বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত, বিকাশমান মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত- এ থেকে খুব বেশি উপকৃত হবে না’৷ দেশের প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, কিন্তু গরিব মানুষের মধ্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে সক্ষমতা বাড়ছে না। বরং আয় বৈষম্য, ধনের বৈষম্য, ভোগের বৈষম্য, সম্পদের বন্টনে বিশৃঙ্খলা আরো দৃশ্যমান হচ্ছে৷

এ বছরের শুরুতেই বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ মহামারী প্রকট থেকে প্রকটতর হয়ে আঘাত করেছে বিশ্ব অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডে, বিধ্বস্ত হচ্ছে বিশ্ব মানবতা। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে করোনার বড় আঘাত লেগে গেছে ইতোমধ্যেই। এই ভাইরাস জানান দিচ্ছে মানুষ, দেশ ও জাতির বেঁচে থাকার জন্য টেকসই খাদ্য ব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাকে এড়িয়ে কেবল অবকাঠামোগত উন্নয়নে মনোযোগ কতোটা অবান্তর!

২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের যে দৌড়ে আমরা নাম লিখিয়েছি তার তৃতীয় এবং চতুর্থ লক্ষ্য পর্যায়ক্রমে সুস্বাস্থ্য ও মানসম্মত শিক্ষা। অথচ দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ আমাদের বাংলাদেশ স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যয়ে দক্ষিণ এশিয়ার সর্বনিন্ম। ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে আমাদের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের ব্যয় ২৫ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা যা মোট জাতীয় বাজেটের ৪.৯২ শতাংশ এবং জিডিপির ০.৮৯ শতাংশ। ১৬ কোটি জনগণের দেশে স্বাস্থ্যখাতে এই বরাদ্দ কতোটা পর্যাপ্ত, কতোটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে? এই নামমাত্র বরাদ্দে স্বাস্থ্যখাতে মাথাপিছু বরাদ্দের পরিমাণ দাঁড়ায় বছরে মাত্র ১৪২৭.৭৭ টাকা।

দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা উন্নত চিকিৎসার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান ভারত, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডের মতো দেশগুলোতে। এমনকি রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, এমপি-মন্ত্রীর মতো ব্যক্তিদের সামান্য হেলথ চেকআপ করাতে বিদেশ ছুটে যাওয়া– নিজ দেশের চিকিৎসার ব্যবস্থার প্রতি তাদের এই অবিশ্বাস জনগণের চিকিৎসা পাবার মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকরণের রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার ছবিই প্রকাশ করে।

সংবিধানের ১৮(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করবে রাষ্ট্র। অথচ তার পরিবর্তে পর্যাপ্ত বাজটে বরাদ্দ, বরাদ্দের সঠিক ব্যবহার, চিকিৎসাপ্রদান, ওষুধ সরবরাহ, জনবল নিশ্চিত করা- সকল ক্ষেত্রে অপরিকল্পনা, অব্যবস্থাপনার সংকটের শিকার হচ্ছেন সাধারণ জনগণ। অধিকাংশ সরকারি হাসপাতালে অপর্যাপ্ত বিছানা, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ, নোংরা পয়ঃনিষ্কাশনব্যবস্থা, নোংরা খাবার নিয়ে আমাদের স্বাস্থ্যখাতের দুর্বলতার সাক্ষী হয়ে ধুঁকছে। বিছানা, চিকিৎসক এবং নার্সের অনুপাত আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে যেখান ১:৩ সেই হিসেবে দেশে নার্সের ঘাটতি রয়েছে প্রায় তিন লাখ। রোগীরা প্রয়োজনীয় সেবা থেকে বঞ্চিত। আড়ই হাজার মানুষের বিপরীতে ডাক্তার রয়েছেন মাত্র একজন। প্রতি লাখ মানুষের জন্য আইসিইউ বেড মাত্র ০.৭টি৷ রাষ্ট্রীয় নয়া উদারবাদী দৃষ্টিভঙ্গি, অপ্রতুল বরাদ্দ আর বিশৃঙ্খলা স্বাস্থ্য খাতকে ক্রমশ বেসরকারি খাতের দিকে ঠেলে দিয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আমদানি-রফতানি খাত, সরবরাহগত পরিবর্তন, স্বাস্থ্য, সরকারি অর্থায়ন ও সরকারের মুদ্রানীতি- এই পাঁচটি মূল খাতের ওপর কোভিড ১৯ প্রভাব ফেলবে। স্বাধীনতার পর থেকে কখনোই জিডিপির ১ শতাংশ থেকে বাড়তে না পারা অবহেলিত এই স্বাস্থ্যখাত করোনাভাইরাসের এমন দুর্যোগ প্রতিরোধে হিমশিম খাচ্ছে৷ কোভিড-১৯ ব্যবস্থাপনার এবং সংকট উত্তরণে আমাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা আসলেই কতখানি? অর্থ এবং জনবল উভয়ের এই অকুলান সরাসরি আমাদের স্বাস্থ্যখাতে দীনহীন বাজেট বরাদ্দের দিকে আঙুল তুলতে বাধ্য করে।

অন্যদিকে শিক্ষাখাতে অপ্রতুল বরাদ্দের কারণে দক্ষ ও কর্মক্ষম জনশক্তির অভাবে ভুগছে দেশ। এশীয় অঞ্চলে শিক্ষাখাতেও বরাদ্দে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বাংলাদেশের। ইউনেস্কো বলছে, জাতীয় বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ হওয়া উচিত মোট বাজেটের কমপক্ষে ২০ শতাংশ এবং জিডিপির ৬ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৬১ হাজার ১১৮ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১১.৬৮ শতাংশ। একটি উন্নত জাতি ও উন্নত দেশ গঠনে প্রযুক্তিগত, গবেষণাধর্মী ও কারিগরি শিক্ষা খুবই জরুরি; সার্বিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং উন্নতমানের ল্যাব, এগুলো শিক্ষাব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ দিক। কিন্তু হাতে গোনা দু’একটি ব্যতিক্রম(!) ছাড়া গবেষণাখাতকে সমৃদ্ধকরণে পদক্ষেপ নেওয়ার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের বাজেট প্রণয়নকালে ঐতিহাসিকভাবেই অনুপস্থিত।

বাংলাদেশে সরকারি শিক্ষাখাতের একটি বড় সংকট এখন গবেষণা। বর্তমানে সরকারি, বেসরকারি এবং আন্তর্জাতিক মিলিয়ে বাংলাদেশে মোট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৫০টি। ২০১৮ সালে প্রকাশিত ইউজিসির এক প্রতিবেদন বলে আমাদের ২০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েরই কোনো প্রকাশনা নেই, সরকারি ৬টি ও বেসরকারি ১৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাখাতে কোনো ব্যয় নেই। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বরাদ্দ করেছে ১৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকা, যা মোট বাজেটের মাত্র ২.১ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটের আকার বিগত বছরের চেয়ে ৯.৩৫ শতাংশ বাড়লেও গবেষণায় বরাদ্দ কমছে ২.৮৪ শতাংশ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’র ‘শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭’ অনুযায়ী মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশেরও বেশি কর্মক্ষম জনসংখ্যা নিয়ে আমাদের দেশ এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট এর সময় পার করছি। অথচ এই বিশাল কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী নিয়ে কোভিড-১৯ এর মতো দুর্যোগ প্রতিরোধে আমাদের যে সক্ষমতা থাকা দরকার, সে সক্ষমতা আমাদের নেই। ২০০৭ থেকে ২০২০- ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট-এর এক যুগ পেরিয়েও বিদ্যমান জননীতিগুলোর ব্যর্থতা, বাজেট বরাদ্দের ব্যর্থতা এবং অব্যবস্থাপনায় আমরা দক্ষ জনশক্তি হয়ে উঠতে পারিনি।

করোনা সংকট দেশের সকল মানুষের আয় ও খাদ্য নিরাপত্তাকে কমবেশি প্রভাবিত করেছে। সীমিত আয়ের মানুষ থেকে শুরু করে সকল পর্যায়ে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুন। খাদ্য নিরাপত্তাহীন ও অপুষ্টির শিকার জনগোষ্ঠীর একটি বিশাল অংশ নিয়ে কোভিড-১৯ আমাদের অর্থনীতিতে কি পরিমাণ প্রভাব ফেলবে তার পরিমাণ নির্ধারণ কঠিন।

কোভিড-১৯ এর এই তাণ্ডব একদিন থেমে যাবে। এই মহামারিকালে স্থবিরতার সময় এসেছে অতীতের কাঠামো, কার্যপদ্ধতির সত্যিকারের উপযোগিতা সততার সাথে পরিমাপ করার। আসন্ন বিপদের দিনগুলোতে কার্যকরী নীতি নির্দেশনা গ্রহণ ও সুপরিকল্পিত পদক্ষেপের মাধ্যমে এগিয়ে যেতে হবে। দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়ে তুলতে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে নজর দিতে হবে। স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করে সর্বজনীন পুষ্টি নিশ্চিত করা ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি প্রশমনে এগোতে হবে।

খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আগামী অর্থবছরের বাজেট কার্যক্রম শুরু হতে যাচ্ছে। আমাদের সময় এসেছে বাজেট নিয়ে ভিন্নরূপে নতুন করে ভাববার, সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার। প্রতি বছর বাজেট পেশের ঠিক পরপরই কোন নিত্যপণ্যে ব্যয় বাড়লো, কোন পণ্যে কমলো- বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের লাভ-ক্ষতির এই ঈষৎ আলাপ পেরিয়ে, চায়ের আড্ডায় ভাসাভাসা কিছু আলোচনা সমালোচনা আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তীর্যক কিছু মন্তব্য ছাড়িয়ে বাংলাদেশে বাজেট নিয়ে গঠনমূলক আলোচনার সময় ঠিক এখনই। 

বাজেট আসলে কার? বাজেট কারা করছে? ফি-বছর কিসের ভিত্তিতে হচ্ছে এই বাজেট? সবাই কি এর উপকার পাচ্ছি? বাজেটে কার স্বার্থ কতোটা রক্ষিত হচ্ছে? বাজেটের সমৃদ্ধির সুফল আর কতদিন গুটিকয়েক মানুষের হাতের তালুতে খেলবে? সাধারণ জনগণের উন্নয়নে নেওয়া পদক্ষেপ কতোটা বাস্তবসম্মত এবং সুপরিকল্পিত হবে? এর কতোটা বাস্তবায়ন হবে? এই প্রশ্নের উত্তর আমাদেরকেই খুঁজে বের করতে হবে।

বাজেট তৈরি হয় আমার টাকায়, আমাদের টাকায়। মহামারি পরবর্তী পৃথিবীতে সত্যিকারের উন্নয়নের পথে এগুবো বলে বাজেটের স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণে তাই আমাদেরই পদক্ষেপ নিতে হবে। বাজেটের নীতি, বাজেটের সুচিন্তিত বরাদ্দ সম্পর্কে ভাবতে হবে, সচেতন ও দায়িত্বশীল হতে হবে আমাদের।

বাজেট তৈরি হয় আমাদের টাকায়, আমাদের জন্য। তাই বাজেট হতে হবে আমার অংশগ্রহণে, আমাদের অংশগ্রহণে।

লেখক: বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়