ঢাকা     মঙ্গলবার   ০৭ জানুয়ারি ২০২৫ ||  পৌষ ২৩ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু একটি আদর্শ ও স্বপ্নের নাম

মিনার মনসুর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:২৭, ১৫ আগস্ট ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বঙ্গবন্ধু একটি আদর্শ ও স্বপ্নের নাম

বাংলাদেশকে দৃশ্যত দু’বার হত্যা করার চেষ্টা হয়েছে- একবার একাত্তরে, আরেকবার পঁচাত্তরে। সেই ষড়যন্ত্রে যে দেশিবিদেশি অনেকেই যুক্ত ছিল তাও এখন সুবিদিত। এটা প্রমাণিত যে, একাত্তরে জন্মলগ্নেই বাংলাদেশকে হত্যার লক্ষ্যে যারা রক্তসমুদ্র বয়ে দিয়েছিল এই জনপদে, পরাজয়ের গ্লানি তারা কখনোই ভুলতে পারেনি। তাদের সমস্ত কূটকৌশল ব্যর্থ করে দিয়ে বাংলাদেশ যখন সত্যি সত্যি স্বাধীন হয়ে গেল, তখন পশ্চিমা দুনিয়ার ঝানু ঝানু উন্নয়নবিশেষজ্ঞরা রায় দিয়েছিলেন, সদ্যোজাত এই দেশটির কোনো ভবিষ্যৎ নেই। কেন নেই- তার অনুকূলে অকাট্য সব যুক্তিও তুলে ধরেছিলেন তারা। কিন্তু তাদের যাবতীয় ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা প্রমাণিত করে মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর জাদুকরী নেতৃত্বে ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে বাংলাদেশ যখন ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল, তখনই আবার প্রচণ্ড আঘাত হানা হয় বাংলাদেশের বুকে। মূলত উদীয়মান বাংলাদেশকে হত্যার লক্ষ্যেই একাত্তরে ৩০ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল এবং সম্ভ্রমহানি করা হয়েছিল তিন লক্ষ নারীর। কিন্তু তারপরও ষড়যন্ত্রকারীরা সফল হতে পারেনি। সেই ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়েই পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট তারা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। কারণ তারা জানতো, বঙ্গবন্ধুই হলেন বাংলাদেশের প্রকৃত প্রাণভোমরা। তিনিই বাঙালির ঐক্য, শক্তি, সাহস ও অগ্রযাত্রার প্রতীক- যা এদেশের মানুষকে অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছে। বস্তুত বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে তারা বাংলাদেশকে মুছে ফেলতে চেয়েছিল বিশ্বের মানচিত্র থেকে। কিন্তু তারা যেটা জানতো না তা হলো, বঙ্গবন্ধু কোনো ব্যক্তিমাত্র নন, তিনি হলেন একটি আদর্শ ও স্বপ্নের নাম- যাকে কখনোই হত্যা করা যায় না। তার প্রমাণ হলো, দীর্ঘ দু’দশকের অব্যাহত ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও। সেই রক্তসমুদ্রের ভেতর থেকে বঙ্গবন্ধুতনয়া শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ শুধু প্রবলভাবে ঘুরেই দাঁড়ায়নি, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সফল বাস্তবায়নের পথে অনেক দূর এগিয়েও গেছে। অনিবার্যভাবে এই পুনরুজ্জীবনের মূল প্রেরণাও বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

বঙ্গবন্ধু আমৃত্যু সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছেন এবং সেই স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ করে গেছেন দেশের আপামর মানুষকে। বললে অত্যুক্তি হবে না যে এটাই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র আরাধ্য। সেই সোনার বাংলার একটি রূপকল্পও তিনি নির্মাণ করে গেছেন নানা উপলক্ষে, নানাভাবে। মাত্র দুটি বাক্য দিয়ে মূর্ত করে তোলা যায় তাঁর আকাশচুম্বী স্বপ্নের সেই ছবিটি। প্রথমত, ভুখানাঙ্গা দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটবে; এবং দ্বিতীয়ত, কেউ আমাদের ‘দাবায়ে’ রাখতে পারবে না। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সেই বাংলাদেশ হবে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত এবং আত্মমর্যাদায় ও আত্মশক্তিতে বলীয়ান। প্রসঙ্গত লক্ষণীয় যে বঙ্গবন্ধুর কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি কথা প্রায়শ বলে থাকেন, সেটি হলো- ‘আমরা বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে বাঁচবো’। আর এটি যে কেবল কথার কথা মাত্র নয়, তার বহু দৃষ্টান্তও তিনি স্থাপন করেছেন ইতোমধ্যে। সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্তটি নিঃসন্দেহে পদ্মা সেতু। নানা কারণে এই সেতুটি পরিণত হয়েছে বাংলাদেশের পুনর্জন্মের এক তাৎপর্যপূর্ণ প্রতীকে। অনেকটা একাত্তরের আদলে বিশ্বব্যাংককে সামনে রেখে বাংলাদেশবিরোধী সমস্ত শক্তি একাট্টা হয়ে শুধু যে পদ্মা সেতুর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল তা-ই নয়, পরিকল্পিতভাবে দুর্নীতির কালিমা লেপন করে তারা শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুতও করতে চেয়েছিল। কিন্তু একাত্তরের রুদ্ধশ্বাস দিনগুলোতে যেমন বঙ্গবন্ধু জীবনের তোয়াক্কা না করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ইস্পাতকঠিন অবস্থান নিয়েছিলেন, তেমনি তাঁর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনাও দেশিবিদেশি প্রবল পরাক্রান্ত ষড়যন্ত্রকারীদের সম্মিলিত বিরোধিতার মুখে দৃঢ় চিত্তে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে দিয়েছিলেন, বাংলাদেশ নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু বানাবে। কোনো ষড়যন্ত্রের কাছে মাথা নত করবে না। শুধু তাই নয়, তিনি একথাও বলেছিলেন যে বিশ্ববাসীর সামনে তিনি ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ উন্মোচন করে দেবেন। তিনি তাঁর কথা রেখেছেন অক্ষরে অক্ষরে। তাঁর অনন্য দৃঢ়তার কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছে সবাই। মাত্র কদিন আগে বিশ্বব্যাংকের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম বাংলাদেশ সফরে এসে প্রশংসার বৃষ্টিতে ভাসিয়ে দিয়ে গেছেন বাংলাদেশের মানুষকে। অতএব, ধীরে ধীরে যে পদ্মা সেতু দৃশ্যমান হয়ে উঠছে তা সেতু মাত্র নয়, এটা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলারই দৃশ্যরূপ মাত্র।

স্বল্পোন্নত দেশ থেকে নিন্মমধ্যম আয়ের দেশের সারিতে বাংলাদেশের উত্তরণের বিষয়টি বদলে যাওয়া বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ও নির্ভরযোগ্য বিজ্ঞাপন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। গর্বের বিষয় হলো, উত্তরণের এ পথপরিক্রমায় তিনটি সূচকেই চমকপ্রদ সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. শামসুল আলম লিখেছেন:

‘... এলডিসি থেকে উত্তরণের জন্য এবার সিডিপি কর্তৃক যে পর্যালোচনা হয়েছে, তাতে একটি দেশের মাথাপিছু আয় হতে হবে কমপক্ষে ১,২৩০ মার্কিন ডলার। বিশ্বব্যাংক নির্ধারিত যে এটলাস পদ্ধতিতে এ আয় নির্ধারণ করা হয়, সেই হিসাবে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এখন ১,২৭১ মার্কিন ডলার। মানবসম্পদ সূচক যা কি-না পুষ্টি, স্বাস্থ্য, স্কুলে ভর্তি ও শিক্ষার হারের সমন্বয়ে তৈরি হয়- সেখানে একটি দেশের স্কোর থাকতে হবে ৬৬ বা তার বেশি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের বর্তমান স্কোর হচ্ছে ৭২.৯। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক- যা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক আঘাত, জনসংখ্যার পরিমাণ এবং প্রধান বিশ্ববাজার থেকে একটি দেশের বিচ্ছিন্নতার ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়- সেখানে একটি দেশের স্কোর হতে হবে ৩২ বা তার কম। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্কোর এখন ২৪.৮। (ইত্তেফাক, ২০ মার্চ ২০১৮)।

জন্মলগ্নেই যারা বাংলাদেশকে চরম তাচ্ছিল্যের সঙ্গে খারিজ বা বাতিল করে দিয়েছিল, বেশ জোরেশোরেই তারাও এখন বলছেন বা বলতে বাধ্য হচ্ছেন যে বাংলাদেশ বিশ্বের স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্যে একটি মডেলে পরিণত হয়েছে। কেউ কেউ আরও একধাপ এগিয়ে গিয়ে বলছেন যে, অতি অল্প সময়ে বাংলাদেশ যা করে দেখিয়েছে- তা এককথায় ‘মিরাকল’ বা উন্নয়নের বিস্ময়। প্রসঙ্গত বিশ্বব্যাংকের বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিষয়ক পরিচালক ওলুসজি আদেইয়ির একটি মন্তব্য এখানে তুলে ধরা যেতে পারে। তিনি বলেছেন, স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নে বাংলাদেশের ট্র্যাকরেকর্ড যথেষ্ট মর্যাদাপূর্ণ। বিশ্ব নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের এই অর্জনকে পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর কাছে উদাহরণ হিসেবে দেখিয়ে থাকেন। (ইত্তেফাক, ৯ নভেম্বর ২০১৪)। এ তালিকায় যোগ করা যায় জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন কিংবা পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের নামও। আর নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মূল্যায়ন তো সুবিদিত। কোনো রাখঢাক ছাড়াই তিনি বলেছেন- খাদ্য নিরাপত্তা, নারীর ক্ষমতায়ন এবং প্রাথমিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবাসহ সামাজিক উন্নয়নের নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতসহ প্রতিবেশী দেশগুলোকেও ছাড়িয়ে গেছে। জোরালো ভিত্তিও রয়েছে এসব মন্তব্যের। মাত্র দেড়-দুই দশক আগেও যে-দেশটিকে দুর্যোগের-দুর্ভোগের উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা হতো এবং টেলিভিশনে হাড্ডিসার শিশু আর ভিক্ষার থালা দেখিয়ে সংগ্রহ করা হতো এনজিওদের তহবিল, সেই দেশটিকে ঘিরে এই যে এতো এতো প্রশংসার পুষ্পবৃষ্টি- তা অকারণে নয়। ঘোর নিন্দুকেরাও বলছেন যে এই সাফল্যের নেপথ্যে যে-দুটি বিষয় আলাদীনের আশ্চর্য চেরাগ হিসেবে কাজ করেছে তার প্রথমটি হলো, গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা; এবং দ্বিতীয়টি হলো বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ ও দূরদর্শী নেতৃত্ব।

এর স্বীকৃতি হিসেবে একাধিক আন্তর্জাতিক পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছে বাংলাদেশ। প্রশংসার বৃষ্টিতে স্নাত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। একটি-দুটি ক্ষেত্রে হলে এটাকে আকস্মিক বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে পাশ কাটিয়ে যাওয়া যেতো। কিন্তু সাফল্যের তালিকা এতো দীর্ঘ এবং তার ভিত্তি এতোটাই মজবুত যে সেই সুযোগও নেই। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, খাদ্য নিরাপত্তা, তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও দুর্যোগ মোকাবিলাসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে একের পর এক চমক সৃষ্টি করে চলেছে বাংলাদেশ। সর্বোপরি, যে-কথাটি না বললেই নয় তা হলো, জঙ্গিবাদের বিষে মধ্যপ্রাচ্যের বৃহদংশ যখন অবশ হতে চলেছে এবং আফ্রিকা ও বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বহু দেশ যখন জঙ্গিবাদের উদ্যত ফণার নীচে বিনিদ্র রাত্রি যাপন করছে, ঠিক সেই মুহূর্তে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশ শান্তি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য উদাহরণ হয়ে উঠেছে।

কীভাবে সম্ভব হলো এতোসব অসাধ্য সাধন? যারা বাংলাদেশকে আঁতুড় ঘরেই হত্যা করতে চেয়েছিল, যারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত এ-দেশটির ললাটে লেপে দিয়েছিল ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র অপবাদ, যারা মাঝপথে খাদ্যবোঝাই জাহাজ ফিরিয়ে নিয়ে লাখ লাখ মানুষকে ঠেলে দিয়েছিল নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে এবং যারা কথায় কথায় আরোপ করে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা- তারাই এখন এ প্রশ্নের উত্তর সন্ধানে প্রবৃত্ত হয়েছেন। তারা খোলাখুলিই বলছেন যে বাংলাদেশের সামগ্রিক অগ্রগতি এককথায় ‘বিস্ময়কর’। সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনার নেতিবাচক ভূমিকা ও অবস্থান কারো অজানা নয়। সেই ভদ্রলোকও রাখঢাক ছাড়াই বাংলাদেশের এ বিস্ময়কর অগ্রযাত্রার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে গেছেন বিদায়ের প্রাক্কালে। বলেছেন, বাংলাদেশ যে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে, তা স্বীকার করতে তার কোনো দ্বিধা নেই। ভিন্ন নয় বর্তমান রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া স্টিফেন বার্নিক্যাটের অবস্থানও। একই কথা বলে আসছে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), আইএমএফসহ বিশ্বের নামীদামি সব মূল্যায়নকারী প্রতিষ্ঠানও। এ জাগরণ কোনো সামান্য ব্যাপার নয়; নয় বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনাও। মেট্রো রেলের কাজ চলছে পুরোদমে। দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে বহু প্রত্যাশিত পদ্মা সেতুর অবয়ব। মহাশূন্যে স্বমহিমায় নিজের জায়গা করে নিয়েছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১। বিশ্ববাসীর নজর কাড়ছে রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের ব্যাপক কর্মযজ্ঞ। এ কী কম গর্বের বিষয় যে বাংলাদেশ এখন বিশ্ব স্যাটেলাইট ক্লাবের ৫৭তম সদস্য আর পরমাণু শক্তিধর দেশগুলোর সারিতে তার অবস্থান ৩৪তম। দুটি সাবমেরিন ক্রয়ের মাধ্যমে সমুদ্রের তলদেশেও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে বাংলাদেশ। বিপুল সমুদ্র সম্পদ আহরণের উদ্দেশ্যে স্থাপিত হয়েছে সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট। কখন শুরু হয়েছে এ-কর্মযজ্ঞ? কার নেতৃত্বে? উত্তরটা সবাই জানি বললে ভুল হবে। কারণ এমনিতেই আমাদের স্মৃতিশক্তি দুর্বল। তদুপরি, এ দেশের অনেক জ্ঞানীগুণীজনও অপ্রিয় সত্যের মুখোমুখি হতে ভয় পান।

শুধু এটুকু বলাই যথেষ্ট হবে না যে মহাজোট সরকারের আমলেই এ কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে। সুনির্দিষ্টভাবে বলতে হবে যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। প্রসঙ্গত বলা দরকার যে দীর্ঘ কালক্ষেপণের পর বিগত সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার যাত্রাবাড়ি ফ্লাইওভার প্রকল্পটি বাতিল করে দিয়েছিল। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন যাত্রাবাড়ি সেতুর কাজ শুরুর নির্দেশ দিয়েছিলেন, তখনও ‘গেল গেল’ রব উঠেছিল। যারা সেদিন এ ধরনের রব তুলেছিলেন, তারাই এখন অকুণ্ঠ চিত্তে তার সবটুকু সুফল ভোগ করছেন। ততোধিক রব উঠেছিল বিদ্যুৎ নিয়ে। মহাজোট সরকার যখন দায়িত্ব নেয়, তখন সারা দেশে বিদ্যুতের জন্যে হাহাকার চলছে। চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ বিদ্যুৎও উৎপাদিত হয় না দেশে। কারণ পূর্ববর্তী বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার পাঁচ বৎসরে জাতীয় গ্রিডে এক মেগাওয়াট বিদ্যুৎও যোগ করতে পারেনি। দফায় দফায় টেন্ডার দিয়েও শুরু করতে পারেনি বৃহৎ কোনো বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজও। কেন পারেনি- তা দাতারা সাংবাদিক সম্মেলন করে দেশবাসীকে জানাতে বাধ্য হয়েছিলেন। একমাত্র টঙ্গীতে একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছিল ৮০ বা ৯০ মেগাওয়াটের। সেটিও বেশিরভাগ সময় বন্ধ থাকতো যান্ত্রিক ত্রুটি কিংবা গ্যাসের অভাবে। দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যখন বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হলেন, গ্রহণ করলেন জরুরি, মধ্যমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী নানা পদক্ষেপ- তখনও দেশজুড়ে সমালোচনার বন্যা বয়ে দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল যে বিদ্যুৎ খাত ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি বাংলা দৈনিকও একের পর এক নেতিবাচক প্রতিবেদন প্রকাশ করে তাতে সুর মিলিয়েছিল। সব নিন্দুকের মুখে ছাই দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ইতোমধ্যে ১১ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেছে। আর মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২০ হাজার মেগাওয়াটের মাইলফলক ছুঁইছুঁই করছে।

প্রসঙ্গত এও লক্ষণীয় যে, আমাদের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান খাত পোশাক শিল্পের অবস্থা ছিল আরও ভয়াবহ। আগে থেকেই অসন্তোষ ও অন্তর্ঘাত চলছিল এ খাতে। সত্যি সত্যি আমাদের স্বর্ণডিম্বপ্রসূ এ শিল্প যাতে রসাতলে যায় সে-জন্যে ব্যাপক প্রচারণাও চালানো হয় দেশেবিদেশে। অন্যদিকে, এর সমুদয় দায় চাপানোর চেষ্টা হয় বর্তমান সরকারের ওপর। যারা এ অপচেষ্টায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মদদ দিয়েছিলেন তারাই এখন স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছেন যে বিশ্বে বাংলাদেশের রফতানিমুখী পোশাক শিল্পের অবস্থান ইতোমধ্যে দ্বিতীয় স্থানে উন্নীত হয়েছে। ক্রমেই অপ্রতিদ্বদ্বী হয়ে উঠছে বাংলাদেশ।

‘গেল গেল’ রব তোলা হয়েছিল জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রেও। বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সঙ্গে জুড়ে এক ঢিলে একাধিক পাখি শিকারের সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হয়েছিল। একদিকে মধ্যপ্রাচ্যের জনশক্তি আমদানিকারক দেশগুলোকে নানাভাবে প্ররোচিত করা হয়েছিল বাংলাদেশবিরোধী অবস্থান গ্রহণের জন্যে; অন্যদিকে, বিদেশ যেতে ইচ্ছুক এবং বিদেশি আয়ের ওপর নির্ভরশীল বিপুল জনগোষ্ঠীকে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা চালানো হয়েছিল সর্বাত্মকভাবে। তাদের বোঝানো হয়েছিল যে যুদ্ধাপরাধের বিচারের মাধ্যমে মূলত তাদের পেটে লাথি মারা হচ্ছে। কিন্তু সেই প্রচারণাও হালে পানি পায়নি। এখন গ্রামগঞ্জের অতি সাধারণ মানুষও জানেন যে বর্তমান সরকারের কার্যকর পদক্ষেপের কারণে বিদেশযাত্রা বরং অনেক সহজতর ও ব্যয়সাশ্রয়ী হয়েছে। প্রতারণা কমেছে। সর্বোপরি, বিদেশে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে। কীভাবে এটা সম্ভব হলো? সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত উদ্যোগ, আন্তরিকতা ও নিরলস প্রচেষ্টার ফলে। প্রায় প্রতিটি দেশ তিনি সফর করেছেন। কথা বলেছেন সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর শীর্ষ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে। লক্ষণীয় যে কখনোই খালি হাতে ফিরতে হয়নি তাঁকে। গভীর সদিচ্ছাপ্রসূত আত্মবিশ্বাস থাকলে সব বাধাই যে অতিক্রম করা যায়- তিনি তা বারবার প্রমাণ করে চলেছেন।

যুগান্তকারী পরিবর্তন সূচিত হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে। ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন আর দূরের কোনো অধরা স্বপ্ন নয়। স্মর্তব্য যে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে নিজ দলীয় একটি মাত্র অপারেটরকে মোবাইল সেবার লাইসেন্স দিয়ে একচেটিয়া বাণিজ্যের সুযোগ করে দেওয়ার পাশাপাশি সম্ভাবনাময় এই খাতটিকে শেকলবন্দি করে রাখা হয়েছিল। বর্তমান সরকারের জনবান্ধব নীতির কারণে এখন ভিক্ষুকের হাতেও পৌঁছে গেছে এই সেবা।

গণতন্ত্র না থাকলে কী হয়- সেটা আমরা সর্বশেষ বিগত সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও দেখেছি। শুধু দেখেছি বললে ভুল হবে, হাড়ে হাড়ে তা উপলব্ধিও করেছি। মাত্র দু’বছর স্থায়ী সেই সরকারের শাসনকাল কী ভয়াবহ বিভীষিকা বয়ে নিয়ে এসেছিল জাতির জীবনে তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। জাতিকে ‘সুশাসন’ ও ‘প্রকৃত গণতন্ত্র’ উপহার দেওয়ার বিশাল প্রতিশ্রুতি দিয়ে তারা ক্ষমতায় এলেও অচিরেই আইনের শাসন ও মানবাধিকার সোনার হরিণে পরিণত হয়েছিল। তুচ্ছ কারণে তাণ্ডব বয়ে গিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের ওপর দিয়ে। আইনবহির্ভূত পন্থায় কত মানুষকে যে গ্রেফতার ও নির্যাতন করা হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। আর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণের চাপে পিষ্ট হয়ে সংবাদমাধ্যমগুলো প্রায় শুকিয়ে মরতে বসেছিল। অথচ দেশের তা বড়ো তা বড়ো ‘সুশীল’-পণ্ডিতদের বিশাল সমাবেশ ঘটেছিল এ সরকারকে কেন্দ্র করে। এটা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছিল যে রাজনীতিকদের গালমন্দ করে টকশোতে চটকদার বক্তব্য দেওয়া যতো সহজ, বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ এবং অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখা মোটেও ততো সহজ নয়।

সেনাসমর্থিত সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার আবারও প্রমাণ করেছিল যে উন্নয়নের জন্যে- সুশাসনের জন্যে এবং অবশ্যই মানবাধিকারের জন্যে গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের একটি অংশ নিকট অতীতের সেই অভিজ্ঞতা থেকে কোনো শিক্ষাই গ্রহণ করেননি। গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে হলে নির্বাচনের যে কোনো বিকল্প নেই- এটা তাদের অজানা থাকার কথা নয়। কিন্তু তারা শুধু যে নির্বাচনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন তা-ই নয়, নির্বাচন প্রতিহত করার জন্যে এমন সব পন্থা অবলম্বন করেছিলেন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যা অচিন্তনীয়। নির্বাচনে অংশ নেওয়া বা না নেওয়ার অধিকার সকলেরই আছে; কিন্তু দিনের পর দিন হরতাল-অবরোধ ডেকে, রেললাইন উপড়ে ফেলে, চলন্ত ট্রেনে আগুন দিয়ে, যাত্রীবোঝাই বাসে পেট্রোল বোমা ছুড়ে যাত্রীসাধারণকে পুড়িয়ে মেরে, স্কুলে অগ্নিসংযোগ করে এবং নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ-আনসার ও শিক্ষককে হত্যা করে আর যাই হোক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না। এ রকম দৃষ্টান্ত পৃথিবীর কোথাও আছে বলে আমাদের জানা নেই। শুধু নির্বাচনই নয়, এসবদৃষ্টে মনে হয়েছে যে তারা অর্থনীতির প্রাণস্পন্দনকেও থামিয়ে দিতে চেয়েছিল।

যে-কথাটি না বললেই নয় তা হলো- গণতন্ত্র আমাদের দেশে আগেও ছিল। সর্বশেষ বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটও পাঁচ বছর ক্ষমতায় ছিল। অভিযোগ আছে যে জাতি হিসেবে আমাদের স্মৃতি দুর্বল। তবু ‘বাংলাভাই’, আট ট্রাক অস্ত্র, একযোগে ৫শ’ স্থানে বোমা হামলা, অফিস-আদালতে বোমা হামলা, প্রকাশ্যে অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা এবং বঙ্গবন্ধু অ্যাভেনিউর জনসমাবেশে কাপুরুষোচিত গ্রেনেড হামলা চালিয়ে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা-চেষ্টার সেই লোমহর্ষক দিনগুলো ভুলে যাওয়া সহজ নয়। সেই আমলের সঙ্গে এই আমলের তুলনা করলে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে যাবে বলে আমাদের বিশ্বাস। সেটি হলো, শুধু গণতন্ত্র থাকলেই হয় না, সে রকম নেতাও লাগে। বঙ্গবন্ধুর মতো নেতা ছিলেন বলেই যেমন সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, তেমনি তাঁর সুযোগ্যা কন্যা শেখ হাসিনার দরদি ও দায়বদ্ধ নেতৃত্বের কারণেই যে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বিস্ময় হয়ে দাঁড়িয়েছে- তা স্বীকার করতে কারো কুণ্ঠা থাকার কথা নয়। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, মুক্তিযুদ্ধের অজেয় চেতনায় বলীয়ান হয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। এ অগ্রযাত্রাকে রোখার সাধ্য কারো নেই।

পুনশ্চ: যে মহাকাশযান যত দূরে যাবে, তার জন্যে সেরকম মজবুত পাটাতনও অপরিহার্য। একইভাবে আমরা যে এখন সোনার বাংলার স্বপ্ন ছুঁতে চলেছি, সেটাও সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ নামক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের শক্ত পাটাতনটি তৈরি করে দিয়ে গেছেন বলে। সেই ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণেই তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। স্বাধীনতার সংগ্রাম তিনি নিজেই সফল করে গেছেন। এখন তাঁর অকুতোভয় কন্যার সুযোগ্য নেতৃত্বে চলছে অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম। এ সংগ্রামেও দেশবাসীর বিজয় এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ আগস্ট ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়