ঢাকা     শুক্রবার   ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ১২ ১৪৩১

অভিশপ্ত আগস্ট

মুহম্মদ জাফর ইকবাল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২৩:৫০, ২০ আগস্ট ২০২০   আপডেট: ১০:৫১, ২৯ আগস্ট ২০২০
অভিশপ্ত আগস্ট

একটা মাস কিংবা বছর, কিংবা একটা তারিখ আসলে সত্যি সত্যি কখনো অভিশপ্ত হতে পারে না। যদি সত্যি সত্যি কেউ এরকম কিছু একটা বিশ্বাস করে তাহলে সেটা এক ধরনের কুসংস্কার ছাড়া আর কিছুই না। তারপরও পৃথিবীতে এরকম কুসংস্কারের কোনো অভাব নেই। বিজ্ঞানমনস্ক আধুনিক পশ্চিমা জগত অশুভ মনে করে ১৩ সংখ্যাটিকে খুবই যত্ন করে এড়িয়ে যায়। তাদের নামি-দামী হোটেলে ১২ তলার পর ১৪ তলা থাকে, ১৩ তলা থাকে না! হোটেলের রুম নাম্বারেও ১২-এর পর ১৪, ১৩ নেই। যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সিতে আমি যে বাসায় থাকতাম সেটি রাস্তার একপাশে বেজোড় সংখ্যার বাসাগুলোর একটি। ১১ নম্বরের পর আমার বাসাটি ১৩ নম্বর হওয়ার কথা ছিল কিন্তু সেটি ছিল ১৫ নম্বর। 

বিজ্ঞানমনস্কতার জগতে সবচেয়ে বড় সর্বনাশ হয়েছিল চন্দ্রাভিযানের বেলায়, সংখ্যার ধারাবাহিকতায় অ্যাপোলো-১২ এর পর অ্যাপোলো-১৩ পাঠানো হয়েছিল। সেই ‘অ্যাপোলো-১৩’ চাঁদে তো যেতে পারেইনি, মাঝখানে দুর্ঘটনায় পড়ে মহাকাশচারীদের জীবন বাঁচানোই কঠিন হয়ে পড়েছিল। কাজেই পশ্চিমা জগত এখনো কঠিনভাবে বিশ্বাস করে যে ১৩ সংখ্যাটি অশুভ।

আমি যখন এই লেখাটির শিরোনাম ‘অভিশপ্ত আগস্ট’ লিখেছি তখন সেটি কোনো কুসংস্কার থেকে লিখিনি, বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে লিখেছি। এত বছর পরেও আমি যদি ঠাণ্ডা মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কথা চিন্তা করি তাহলে আমার মাথা এলোমেলো হয়ে যেতে চায়। সেদিন বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার কথা, টিএসসিতে যে অনুষ্ঠান হবে সেখানে অনার্স পরীক্ষার রেজাল্টের ভিত্তিতে অল্প যে কয়জন ছাত্র-ছাত্রী আমন্ত্রণ পেয়েছে আমি তার একজন। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে আমি সেই অনুষ্ঠানে পরার জন্য শার্ট ইস্ত্রি করছি, তখন পাশের বাসা থেকে গৃহকর্ত্রী চিৎকার করে আমাদের জানালেন- বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলেছে। কথাটি শুনে একেবারে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম! আমাদের নিজের বাসায় তখন রেডিও-টেলিভিশন নেই, খবর শোনার জন্য পাশের বাসায় ছুটে গিয়েছি, সেখানে ‘মেজর ডালিম’ নামে একজন আস্ফালন করে যে ভাষায় সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘোষণা দিচ্ছিল সেটি এত বছর পরও আমার পক্ষে ভোলা সম্ভব নয়।

পৃথিবীতে এরকম নির্মম হত্যাকাণ্ডের উদাহরণ আরো আছে কিনা আমার জানা নেই, যেখানে অবোধ শিশু থেকে শুরু করে নব বিবাহিতা বধূ কিংবা অন্তঃসত্ত্বা তরুণীসহ পরিবারের সবাইকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। (‘হত্যা’ কী নিষ্ঠুর একটি শব্দ, একজন প্রিয়জনের বেলায় এই শব্দটি ব্যবহার করা কী কঠিন একটা কাজ!) ১৫ আগস্ট ভোরবেলা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে মুহূর্তের মাঝে পুরো বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পাল্টে দেওয়া হলো। যে দেশটি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ধারণ করে ভবিষ্যৎমুখী, ধর্ম নিরপেক্ষ, প্রগতিশীল, বিজ্ঞানমনস্ক, আধুনিক একটি দেশ হিসেবে গড়ে ওঠার কথা ছিল, মুহূর্তের মাঝে সেটি মুক্তিযুদ্ধের সকল আদর্শকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ধর্মান্ধ একটি কানাগলিতে হারিয়ে গেল। কয়েক ঘণ্টার মাঝে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলো পাকিস্তান, মুক্তিযুদ্ধে যে দেশটিকে পদানত করে বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে পৃথিবীর সামনে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল। বাংলাদেশ যতদিন পূর্ব-পাকিস্তান হিসেবে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে ছিল ততদিন তারা এই দেশের মানুষের বিরুদ্ধে কম ষড়যন্ত্র করেনি। স্বাধীন বাংলাদেশ হবার পরও সেই ষড়যন্ত্র কাজে লাগানোর মানুষ পেতে তাদের কোনো সমস্যা হয়নি। সেজন্যই কী বাংলাদেশের উপরে আঘাত হানার জন্য তারা পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসের দিনটি কিংবা মাসটিকে তারা সব সময় বেছে নেয়? মাঝে মাঝে শুনতে পাই মেজর ডালিম পাকিস্তানে লুকিয়ে আছে— পাকিস্তান কৃতজ্ঞতাবশত সেজন্যই কী হত্যাকারীদের এভাবে আশ্রয় দেয়? 

হত্যাকারী মিলিটারি অফিসারেরা দেশ ছেড়ে যাবার আগে জেলখানায় চারজন জাতীয় নেতাকে হত্যা করে গেল যেন মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের কেউ এসে ভবিষ্যতেও রাষ্ট্রের হাল ধরতে না পারে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা এবং এবং জেল হত্যার কথা বলতে গিয়েই আমরা স্তব্ধ হয়ে যাই, এর পরের ইতিহাসটুকু যে কত মর্মান্তিক সেটা আমাদের মনে থাকে না। মিলিটারি শাসকেরা জোর করে দেশের দায়িত্ব নিয়ে নিলো, হত্যাকারীদের যেন কোনোদিন বিচার করা না যায় সেটি নিশ্চিত করার জন্য অবিশ্বাস্য একটি ইনডেমনিটি আইন পাস করে রাখলো। হত্যাকারীদের শুধু যে দেশে বিদেশে আরাম-আয়েশের জীবনে পুনর্বাসন করা হলো তাই নয়, এক সময় তারা দেশে ফিরে এসে সদর্পে ঘুরে বেড়াতে লাগলো, এখানেই শেষ হয়নি, হত্যাকারীরা রীতিমতো রাজনৈতিক দল খুলে নির্বাচনে অংশ নিয়ে জাতীয় সংসদে বসতে শুরু করলো। 

সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপারটি ঘটলো অন্যভাবে, রেডিও-টেলিভিশন, সকল গণমাধ্যম আর পাঠ্যপুস্তক থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে দেওয়া হলো। সুদীর্ঘ ২১ বছর এই দেশে প্রজন্মের পর প্রজন্ম বড় হতে লাগল বঙ্গবন্ধুর কথা না জেনে, তাঁর ৭ই মার্চের সেই ভাষণটি না শুনে। তাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোনো কৌতূহল নেই, দেশের জন্য ভালোবাসা নেই। বাংলাদেশের মাটিতে তারা পাকিস্তানের ক্রিকেট খেলা দেখে পাকিস্তানের পতাকা নিয়ে উদ্বাহু নৃত্য করে।

ধীরে ধীরে সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে, এই দেশের মাটিতে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে। এখন এই দেশের অনেক শিশু তর্জনী উঁচু করে ৭ই মার্চের ভাষণ দিতে পারে, স্কুলের স্পোর্টসের দিন তারা মাথায় গামছা বেঁধে হাতে খেলনা অস্ত্র নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সেজে আসে, স্টেডিয়ামে তারা বাংলাদেশের ক্রিকেট টিমের জন্য গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে। শুধু তাই নয়, দেশের অর্থনীতি এমনভাবে শক্তিশালী হয়েছে যে, এই দেশ এখন নিজের টাকা দিয়ে পদ্মা সেতু তৈরি করতে পারে। ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করছে, বিশ্বের দরবার থেকে অলিম্পিয়াডে সোনার মেডেল নিয়ে আসছে। এমনকি পাকিস্তানের সাংসদেরা পর্যন্ত তাদের প্রধানমন্ত্রীকে বলছে, দোহাই তোমার, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জিজ্ঞেস করো কেমন করে তারা এই ম্যাজিক করে ফেলছে! 

১৯৮১ সালে যখন দেশে দেশে শরণার্থীর মতো ঘুরে ঘুরে একাকী, নিঃসঙ্গ, দুঃখী, কমবয়সী, অনভিজ্ঞ শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এসেছিলেন তখন কেউ কল্পনা করতে পারেনি, বঙ্গবন্ধুর কন্যা একদিন তার পিতার মতোই এত দৃঢ়ভাবে দেশের হাল ধরে দেশটিকে এভাবে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। একদিন এই দেশের মাটিতে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার করবেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবেন। কিন্তু যারা এই দেশকে আরেকটি পাকিস্তান তৈরি করতে চায় তারা কিন্তু সেটা সঠিকভাবে অনুমান করতে পেরেছিল। তাই ২০০৪ সালের আগস্ট মাসের ২১ তারিখ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে অন্যান্য সকল জাতীয় নেতাদের নিয়ে একসঙ্গে হত্যা করার জন্য একটা ভয়ঙ্কর গ্রেনেড হামলা করে। নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে মানব-বর্ম তৈরি করে শেখ হাসিনার প্রাণ রক্ষা করা হলো, কিন্তু মারা গেল ২০ জন, আহত হলো শত শত। তখন দেশের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনা বিরোধী দলের নেত্রী।

গ্রেনেড হামলাটিও হয়েছিল হত্যাকারীদের প্রিয় মাস— আগস্ট মাসে। এবারে তাদের রক্ষা করার জন্য ইনডেমনিটি আইন পাস করা না হলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ, ডিজিএফআই, এনএসএফ, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর কারো চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিল না! জয়নুল আবেদীন নামে একজন বিচারপতি একা তদন্ত করে ঘোষণা করলেন বিএনপি-জামাত সরকারের আমলে অরাজকতা করার জন্য এটি একটি অপচেষ্টা। জজ মিয়া নামে একজনকে নিয়ে আসা হলো এই ঘটনার মূল হোতা হিসেবে, নিজের চোখে দেখে এবং নিজের কানে শুনেও এগুলো বিশ্বাস হয় না। (এই লেখাটি যেদিন ছাপা হবে সেই তারিখটি ভয়াল ২১শে আগস্ট। সৃষ্টিকর্তা শেখ হাসিনাকে আরো দীর্ঘদিন কর্মময় জীবনের জন্য বাঁচিয়ে রাখুক সেই কামনা করছি।)

শুধু যে বঙ্গবন্ধু পরিবারকে হত্যা এবং গ্রেনেড হামলা আগস্ট মাসে হয়েছিল তা নয়, বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যাপক জঙ্গী হামলার জন্যও এই আগস্ট মাসকে বেছে নেয়া হয়েছিল। ২০০৫ সালের ১৭ই আগস্ট জেএমবি এই দেশের ৬৩ জেলার ৩০০ জায়গায় একসঙ্গে বোমা হামলা করে নিজেদের ক্ষমতা দেখিয়েছিল। সর্বশেষ, ২০১৭ সালের জাতীয় শোক দিবস ১৫ আগস্ট একটা জঙ্গী হামলার সকল প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছিল, শেষ মুহূর্তে পুলিশ সেটা ধরে ফেলার কারণে পান্থপথের হোটেল ওলিওতে জঙ্গীরা নিজেদের উড়িয়ে দেয়। যে কোনো বড় নাশকতার জন্য তাদের প্রিয় মাস হচ্ছে আগস্ট মাস, পাকিস্তানের জন্ম মাস!

এই দেশটাকে যারা এখনো পাকিস্তান বানানোর স্বপ্ন দেখে তারা কখন বুঝতে পারবে যে পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ এখন মাথা উঁচু করে থাকা একটি দেশ, সেই তুলনায় বিপর্যস্ত পাকিস্তান এখন করুণার পাত্র ছাড়া আর কিছু নয়!

১৯ আগস্ট ২০২০

ঢাকা/তারা


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়