সৃজনসত্তা আর মানবিকতার যৌথ বোধন
পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগর ঘূর্ণির শিল্পী ভাস্কর পল্লব ভৌমিক ও রিন্টু দাশ এ বছর পরিযায়ী এক শ্রমিকের আদলে প্রতিমা তৈরি করে প্রায় হৈ চৈ ফেলে দিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মিডিয়ায় দেবীর এই মৃন্ময়ী প্রতিমা ভাইরাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ বছর কেন যেন নড়েচড়ে বসেছেন অনেকেই। সোশ্যাল মিডিয়ায় চলছে পক্ষে-বিপক্ষে তুমুল তর্ক। শিল্পীর সৃজনশীলতাকে উচ্চকিত গ্রহণ করেছেন কেউ, কেউ ধুয়ো তুলেছেন মাতৃরূপেণ দেবীর এমন নিরীক্ষায়। তাদের বক্তব্য এতে দেবীর সাত্ত্বিক রূপের অবমাননা হয়, যাতে খর্ব হয় ভক্তিভাব।
থিম পূজার প্রচলন বাঙালি হিন্দু সমাজে মোটেই নতুন প্রবর্তিত কোনো সংস্কৃতি নয়। উড়ে এসে জুড়ে বসা কোনো প্রথাভাঙা চোখ রাঙানিও নয়। তবে কেনো এই প্রতিমা নিয়ে হঠাৎ করে উত্তাল হবে অতিধার্মিক, বকধার্মিকেরা। এই উত্তাল নেতিবাচকতার পেছনে আমি দেখি মূলত কিছু উন্নাসিক উপেক্ষা। আপাত নিরাপদ মিডল ক্লাস কিংবা সুবিধাপ্রাপ্ত উচ্চবিত্তের চোখ বুজে রাখা আত্মকেন্দ্রিকতার অহমে এক তীব্র চপেটাঘাত। ঘরে বসে স্মার্ট ফোন কিংবা টিভিতে যে সচিত্র সংবাদ অনায়াসে উপেক্ষা করা যায় নিজস্ব দায় অস্বীকার করে, দেবী প্রতিমা দর্শনে দশজনের সামনে আর তার সুযোগ থাকে না মোটেই। আমাদের দাঁড়াতেই হয় নির্দয় সময়ের প্রতিচ্ছবির মুখোমুখি। দেবি দশভুজার নির্মল প্রতিমূর্তি কেবল আর ফুল বিল্বপত্রের অঞ্জলির আচারে সীমায়িত হয়ে থাকে না, বরং আচারের উর্ধ্বে এক সমকালীন সংকটের উদোম চেহারা দেখিয়ে দেয় আমাদের। তাই হয়তো আমরা সাত্ত্বিকতার দোহাই দিয়ে অস্বীকার করতে চাই এই থিম পূজার সুচিন্তিত নান্দনিকতাকে, অগ্রাহ্য করতে চাই এর সামাজিক আবেদনকে?
এরা হলেন একপক্ষ। আবার এহেন অভিনব সৃজনশীলতায় উদার শিল্পমনস্কতা দেখার মানুষও নেহায়েত কম নয়। মূলত থিম পূজার মাধ্যমে দেবীর নিত্যরূপ বিবর্তনের মূর্ততায় রয়েছে সামাজিক সচেতনতা তৈরি কিংবা বৃদ্ধির প্রয়াস। থিমের কারণে শারদীয় পূজাকে ঘিরে জীবিকার সংস্থানও হচ্ছে নানা পেশাজীবী মানুষের। ফলে একে অনুৎসাহিত করার কোনো যুক্তিই মূলত এই সময়ে খুঁজে পাওয়া ভার।
২
অতিমারির শুরুতে যে লকডাউনে হাজার হাজার শ্রমিক পায়ে হেঁটে যাত্রা করেছিলেন নিজেদের গন্তব্যে, হাজার মাইল দূরত্বে। পরিযায়ী শ্রমিকের এই রূঢ় বাস্তবতায়, বেঘোরে মৃত্যু, মানবেতর যাপন যদি নতুন করে দশভুজার অবয়বে আমাদের স্মৃতিকে পুনজাগ্রত করে তবে কি তা এস্টাব্লিশমেন্টের বিস্মৃতি প্রচেষ্টার বিপরীতে স্মৃতির লড়াই নয়, যেমনটি এলিস মুনরো বলে থাকেন সাহিত্যের ক্ষেত্রে?
এ শিল্পীর সৃজনশীলতা তো বটেই, এই থিম প্রতিমা, থিম পূজা বা থিম মণ্ডপ সজ্জার অন্তরালে কাজ করে গভীর অন্তর্দৃষ্টি, সমাজের প্রতি দায়বোধ আর অভিনবত্বের প্রতিযোগিতা। এই পুজোর থিমকে বা থিমের পুজোকে এক কথায় খোল নলচে সমেত উড়িয়ে দেওয়ার আগে কিংবা প্রশংসার ফুলঝুরিতে ভাসিয়ে দেওয়ার আগে জেনে নেওয়া যায় কেমন হতে পারে এই থিম পূজার প্রভাব।
ধরুন এই অতিমারির উৎসবে আপনি কোনো মণ্ডপে ঢুকে দেখলেন দেবী দশভুজা মুখে মাস্ক পরে আছেন। উপরে আশেপাশে যেদিকে তাকান কোথাও অক্সিজেনের সিলিন্ডার, কোথাও হাইফ্লো অক্সিজেনের স্যাম্পল, কোথাও আইসিইউ বেডের আদলে ডেকোরেশন। কিংবা মণ্ডপে একজন পিপিই পরা ডাক্তারের নিষ্প্রাণ মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে গেটে। দেবি পরে আছেন এপ্রোন, হাতে ভ্যাক্সিনের সিরিঞ্জ। অসুরের মাথাটা করোনাভাইরাসের অবয়বে, যাকে বধ করছেন করোনানাশিনী।
এই অতিমারির কালে, আজ যখন এই নিবন্ধ লিখছি তখন বিশ্বে মৃত্যুর হার ছাড়িয়ে গেছে দশ লাখ। যখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বাস্থ্যবিধি বলছে নিজ থেকে এই রোগ থেকে দূরে থাকা ছাড়া আর কোনো প্রতিষেধক এই মুহূর্তে আবিষ্কৃত হয়নি।
ঘরে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় ভেসে আসছে সব হতাশ করা সংবাদ। দ্বিতীয় ওয়েভের ধাক্কায় ইতোমধ্যে আবার লকডাউনে গেছে ইউরোপ। আসন্ন শীতে বহুগুণ হয়ে ফিরে আসার আশঙ্কা হানা দিচ্ছে জনমানস আর প্রেডিকশনে। এর মাঝেই এসেছে উৎসব। যে উৎসবের জন্য সারাবছর অপেক্ষা করে থাকে বাঙালি হিন্দুরা। উৎসব, সম্মেলনের আকুল অপেক্ষা ছাপিয়ে মণ্ডপে মাতৃপ্রতিমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আতঙ্ক কি শিরদাঁড়া ছাপিয়ে আপনাকে একাত্ম করে দেবে না মহামারির প্রাথমিক লগ্নের অতি সাবধানতার প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে ধেয়ে আসা দ্বিতীয় ঢেউয়ের মুখোমুখি এই অতিসাবধানতার কোনো বিকল্প নেই। একসময় অতর্কিত ঘাতকের মতো যে শব্দগুলো ঢুকে পড়েছিল আমাদের প্রতিদিনের জীবনে, লকডাউন কোয়ারেন্টাইন, মঞ্চ, মণ্ডপসজ্জা আর প্রতিমা সজ্জার সমকালীন আবেদনে মানুষ কি থমকে দাঁড়াবে না আবার শব্দগুলোর মুখোমুখি। যা এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি?
মূলত থিম পূজার লক্ষ্য আপাতত এটুকুই। সময়ের প্রয়োজনে, সময়ের ডাকের সম্মুখে মানুষকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া। দেবী দশভুজার আবির্ভাবও কিন্তু সময়ের প্রয়োজনেই। মার্কেণ্ডেয় পুরাণে অসুর বধে কিংবা কৃত্তিবাসী রামায়ণে রাবণ বধের অকাল বোধনে। সময়ের প্রয়োজনেই দেবী বারবার নানারূপে আবির্ভূত হয়েছেন নানারূপে। কাত্যায়নী, কালি, দুর্গা, পার্বতী নানা রূপে। দেবী নিজেই যেখানে ভক্তকে উদ্ধারের প্রয়োজনে নিজের রূপ বদলান, সেখানে মানুষ যদি ‘একং সদা বহুধা বিপ্রন্তি’র মতো তাঁকে নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে অধিষ্ঠিত করেন অর্চনার বেদিতে, তাতে শাস্ত্রীয় বিধান কোনো বাদ সাধে না। কিন্তু এই যে সময়ের প্রয়োজনে আমজনতাকে বোধনের অন্তর্গত সুর, তা বোধগম্যতার জন্য ‘অসুর’ হলে চলে না। পূজাচারের মাহাত্ম্য উপলব্ধি করতে হলে নিজের মাঝেও ধারণ করতে হয় ভাবের সুর।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর হিন্দু-মুসলমান প্রবন্ধে বলেছেন, ‘ধর্মমতে হিন্দুর বাধা প্রবল নয়, আচারে প্রবল।’ যতো মত ততো পথের ধর্ম বলেই সিন্ধু নদের তীরবর্তী ধর্মটিতে নানা মত নানা দর্শনের সমন্বয় ঘটেছে। চার্বাক কিংবা বুদ্ধ দর্শনের মতো নিরশ্বরবাদী দর্শনও আত্মস্থ করেছে হিন্দুধর্ম। হিন্দু ধর্ম সমুদ্রবৎ ধারণ করেছে নানা দর্শন নদের শাখা-প্রশাখা। চিমনির কাঁচের মতো ঠুনকো হয়ে ভেঙে পড়েনি।
দুর্গার অকাল বোধন বাঙালির প্রধানতম ধর্মীয় উৎসব হয়ে ওঠার কাহিনী বহুল শ্রুত। আর অন্তর্জালের কারণে তা জানাও এখন অনায়াস সাধ্য। তাহিরপুরের রাজা কংস নারায়ণ থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে ইংরেজ তোষণের উপলক্ষ, বাঈজী নাচ আর মদ্যপান যার আবশ্যিক অনুষঙ্গ সেই পূজা সময়ের প্রয়োজনে বিবর্তিত হয়েছে বারোয়ারি পূজায় আর তারও পরে, সর্বজনীন উৎসবে।
সর্বজনীন পূজায় বিবর্তনও ছিলো সময়ের অনিবার্য ডাক। জমিদারের মণ্ডপ থেকে যা আসে সর্বজনীনতায়। স্বদেশী আন্দোলনকারীরা সর্বজনীন পূজার অন্তরালে একদিকে বিত্তবান, ক্ষমতাবানদের বিত্ত-বৈভবের অসুস্থ প্রতিযোগিতা অস্বীকার করেন, অন্যদিকে দেবী দুর্গাকে দেশ মাতৃকার রূপে প্রতিস্থাপিত করে দেশকে মুক্ত করার শপথ নিতেন। লাঠিখেলার আয়োজনের আড়ালে চলতো বিপ্লবীদের অনুশীলন।
স্বদেশী চেতনায় সিমলা ব্যায়াম সমিতির পূজায় প্রতিমাকে খাদি কাপড় পরানোর মাধ্যমেই সম্ভবত থিম পূজার যাত্রা শুরু। এই বঙ্গভূমের স্বদেশী আন্দোলন শারদীয় উৎসবের সঙ্গে এমনিভাবে একাত্ম হয় যে মণ্ডপগুলোতে ইংরেজিতে লেখা হতো পোস্টার, যার ভাষ্য ছিল- নাথিং বিদেশি এভরিথিং স্বদেশী। এভাবেই আমাদের ধর্মীয় আচরণ আর স্বদেশ চেতনা একে অপরের পরিপূরক হয়ে ওঠে। যার প্রকাশ ঘটে পূজার নানা থিম নির্ধারণে। জানা যায়, ১৭৯০ সালে হুগলি জেলার গুপ্তপাড়ায় টাকার অভাবে বন্ধ হতে যাওয়া পূজা টাকা দিয়ে বন্ধুরা চালু করতে গিয়ে বাঙালি হিন্দুর সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসবটির পত্তন ঘটেছিল, কালক্রমে উনিশ শতকের প্রথম ভাগে ভবানীপুর সনাতন ধর্মোৎসাহিনী সভা সর্বজনীন পূজাকে দীর্ঘস্থায়ী, প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে গিয়েও তৎকালীন রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের প্রচুর বাধার মুখে পড়েছিলেন। পুরোহিতরা সম্মত হননি সেই পূজোয় পৌরোহিত্য করতে। এগিয়ে এসেছিলেন একজন যুবক। শুরু হয়েছিল বাঙালির বৃহত্তম উৎসবের গণতন্ত্রায়ণ।
উনিশ শতকের প্রথম ভাগ নানাদিক থেকে হিন্দু সমাজের জন্য মাইলফলক। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায় প্রমুখ যুগোত্তীর্ণ পুরুষেরা হিন্দু ধর্মের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে শাস্ত্রীয় বিধানসহ নানা হাতিয়ার নিয়ে লড়াইয়ে নেমেছেন জীবন পণ ব্রত নিয়ে। সেই উনিশ শতকের প্রথমার্ধেই সর্বজনীন পূজার ধারণাটির উদ্ভব আর থিম পূজার গোড়াপত্তন। আর শুরু থেকেই এই নিয়ম ভাঙা তরুণেরা সামাজিক নানা বৈষম্য আর অসঙ্গতিকেই লক্ষ্য করেছে সম্মিলিতের দৃষ্টি আকর্ষণে। ফলে হালে পশ্চিমবঙ্গে দেবী দশভুজা কখনো হয়েছেন দিল্লীর অভয়া, কখনো মণ্ডপ সেজেছে কারগিলের যুদ্ধক্ষেত্রের রূপে। বাংলাদেশে পদ্মাসেতু কিংবা উড়াল ট্রেন।
কলকাতার কানকারপাড়া পুজোর থিম হয়েছে বৃদ্ধাশ্রম। নিশ্চয়ই সে থিমের ছায়াতলে দাঁড়িয়ে ক্ষণিকের জন্য আপনার হৃদয় আর্দ্র হয়ে উঠবে বৃদ্ধ পিতামাতার জন্য! কিংবা মানিকতলা ১৪ পল্লীতে দেবীর বনবিবি-রূপে প্রকৃতি রক্ষার বার্তা, সবই তো দেবী বন্দনার পাশাপাশি সামাজিক দায়বোধের এক অপূর্ব বার্তা। কিংবা হরিণঘাটা সর্বজনীন পূজার থিম প্লাস্টিক নয় ভরসা রাখুন কাগজে, অভিনব মণ্ডপ সজ্জায় কিন্তু মানুষকে সচেতন করারই বার্তা।
যে ব্যক্তি বাস্তবতায় মানুষ বাস করেন সেই ব্যক্তি বাস্তবতায় মানুষ সবাই নিশ্চয়ই সদাশুভ্র পবিত্র মানুষ নন। সবাই কেবলই সাত্ত্বিক পূজার জন্য অঞ্জলি নিবেদনেই পূজায় যান না! যে উপলক্ষেই যান, কিছু সামাজিক বার্তায় যদি সে উদ্বুদ্ধ হয় সচেতনায়, তাকেই আমাদের বোধন করা উচিত দেবী বোধনের সঙ্গে। দেবীর মাস্ক কিংবা খাদি বসন পরিধানে আমি তাই সৃজনসত্তা আর মানবিকতার যৌথ বোধন দেখি।
পূজা উপলক্ষে লাখ টাকার শপিং করে নিজের বিত্ত বৈভব অর্থনৈতিক অবস্থা, শ্রেণি মর্যাদার তীব্র প্রতিযোগিতা শেষে দেবি প্রতিমার মণ্ডপ আর প্রতিমাই মানুষকে যদি দাঁড় করিয়ে দেয় আত্মোপলব্ধির মুখোমুখি। পরিযায়ী শ্রমিকের ক্লান্ত ঘর্মাক্ত, ক্ষুধার্ত মুখটি কাউকে যদি মুহূর্তের জন্য দাঁড় করিয়ে দেয় আত্মদহনের মুখোমুখি? আমার কাছে হৈ-হুল্লোড়ের আয়োজনে এটুকুই প্রাপ্তি বলে বোধ হয়।
লেখক: গল্পকার, নাট্যকর্মী