ঢাকা     শনিবার   ১৬ নভেম্বর ২০২৪ ||  অগ্রহায়ণ ১ ১৪৩১

কৃষকের উন্নয়ন ছাড়া সর্বার্থে উন্নয়ন অসম্ভব

মামুন রশীদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৪৭, ৫ ডিসেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৫:৩১, ৫ ডিসেম্বর ২০২০
কৃষকের উন্নয়ন ছাড়া সর্বার্থে উন্নয়ন অসম্ভব

শীতের সকালে বাজারে গেলে মন ভরে যায়। নানারকম সবজি, তার ঘ্রাণ, সতেজতা মন ভরিয়ে দেয়। যদিও দাম শুনে আঁৎকে উঠতে হয়। নতুন আসা অনেক সবজি বাজারের থলেতে তোলার সুযোগ হয় না। তারপরও সবজির উপস্থিতি মন প্রশান্ত করে। উত্তরবঙ্গের নানা জেলা সবজি চাষে এগিয়েছে অনেক। শুধু ধান চাষের ওপর নির্ভরশীল নয় আর কৃষক। ফলে একসময় যেসব সবজি বিদেশি বলে চিনতাম, সেসবও চাষের কল্যাণে বাজারে প্রচুর। সবজির উপস্থিতি, প্রাচুর্যতার সঙ্গে দামের সাদৃশ্য নেই যদিও। তারপরও  রাজধানীর বাজার দেখে বিভ্রান্ত ক্রেতার মনে হতে পারে আমাদের কৃষি ও কৃষকের উন্নতি ঘটছে। কৃষক তার ফসলের দাম পাচ্ছে। তবে এ যে কতটা ভ্রান্ত ধারণা, তা টের পাওয়া যায় স্থানীয় পর্যায়ের বাজারগুলোতে। উত্তরবঙ্গে বাড়ি হবার সুবাদে, স্থানীয় বাজারের সঙ্গে পরিচয় রয়েছে। কিছু কেনার না থাকলেও শুধু শীতের সবজি দেখতেও বাজারগুলোতে ঢুঁ মারার অভ্যাস থেকে, দেখছি বিভিন্ন সবজির দামের তারতম্য।

বগুড়ায় একটি স্থানীয় হাটে ঘোরার সময় সেদিন দেখি একজন বয়স্ক মানুষ বসেছেন মুলাসহ শাক নিয়ে। এত সজীব সেই পাতার হাসি, কিন্তু তার সঙ্গে বিক্রেতার হাসির মিল নেই। দেখেই মনে হলো, তিনি ব্যবসায়ী নন, উৎপাদক। তাকে ঘিরে ক্রেতাও নেই। হাটে মুলা খুচরা বিক্রি হচ্ছে দশ টাকা কেজি। তার কাছে দাম জানতে চাইলাম, তিনিও কেজি প্রতি দশই চাইলেন। পরে আরও কমে দেবার জন্য অস্থির হয়ে উঠলেন। কথাপ্রসঙ্গে জানলেন, নিজের ক্ষেতের মুলা। তিনিই চাষী, সকালে ক্ষেত থেকে তুলেছেন, ধুয়ে পরিষ্কার করেছেন, বিকেল তিনটার দিকে হাটে এসে বসেছেন। নিজে বিক্রি করছেন, বিক্রি হলে কিছু থাকবে, না হলে পুরোটাই লোকসানের খাতায় উঠবে। কারণ ক্ষেত থেকে মুলা তোলার জন্য শ্রমিকের খরচও উঠবে না এখন। বীজ, সার, কীটনাশক, ক্ষেতের পরিচর্যার খরচ ওঠা তো দূরের কথা। তবু তিনি ধরে রেখেছেন কৃষি, কারণ এছাড়া অন্য কিছু জানেন না। অন্য কিছু করার সুযোগ আর নেই। বছর শেষে মিলিয়ে ঝিলিয়ে বিভিন্ন ফসলে সংসার চলে যায়। এই অবস্থা আমাদের প্রান্তিক পর্যায়ের অনেক কৃষকেরই।

অথচ নানাক্ষেত্রে আমাদের উন্নতি হচ্ছে। আমরা উন্নয়নের পথেই রয়েছি। অবকাঠামোগত এই উন্নয়ন সকল স্থানেই দৃশ্যমান। আজ জোরালোভাবে ভেবে দেখার সময় এসেছে যে, এর বাইরেও আমাদের উন্নয়নের দিক ও ক্ষেত্র রয়েছে। আর সেটিই প্রধান। আজকের পৃথিবীতে উন্নয়ন, উন্নতির যে প্রতিযোগিতা, তা যে কয়েকটি ক্ষেত্র ঘিরে, তার মাঝে প্রধান শিক্ষা। এরপর কৃষিসহ অন্যান্য ক্ষেত্র। বর্তমান পৃথিবী মোকাবিলা করছে এক ভয়াবহ সংকট। মানুষের লড়াই চলছে, এক অনুজীবের বিরুদ্ধে। নভেল করোনাভাইরাস নামের এই অনুজীবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য মানুষের হাতে এখনও পর্যন্ত কার্যকর অস্ত্র নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত না মানুষ তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে, অনুজীবকে হটিয়ে দিতে পারছে, ততক্ষণ পর্যন্ত স্বস্তি নেই। অনুজীবের বিরুদ্ধে আমাদের টিকে থাকার পথে স্বস্তি এনে দিতে পারে শিক্ষা। আজ অনুজীবের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে আমাদের প্রধান যে দুটি দিকে নজর দিতে হচ্ছে তার একটি শিক্ষা, অন্যটি কৃষি। এ দুটি ক্ষেত্রই বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য প্রধান ভূমিকা রাখতে পারে। বিষয়টি একটু বিস্তৃত করে যদি বলি, তাহলে প্রথমেই বলতে হয় শিক্ষার কথা। কারণ একমাত্র শিক্ষার উন্নয়নের মাধ্যমে, বর্তমান বিশ্বে যারা এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে রয়েছে, তারাই কোভিড সংকট মোকাবিলার কার্যকর ওষুধ আবিষ্কারে এখনও পর্যন্ত এগিয়ে। হয়তো শিক্ষায় উন্নত জাতিগুলোর হাত ধরেই করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে জয়ী হবার অস্ত্র আসবে। অন্যদিকে করোনার কারণে বর্তমান পৃথিবীতে অন্য যে সংকটের শুরু, তা হলো জীবন বাঁচাতে মানুষের ঘরে ঢুকে পড়া। নিরাপদ আশ্রয়ের তাগিদ থেকে মানুষকে ঘরে ঢুকতে বাধ্য হতে হয়। সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার তাগিদ থেকে মানুষকে স্বেচ্ছায় ঘরবন্দি হতে হয়। ঘরে আশ্রয় নেওয়ায় জীবন বাঁচলেও, ক্ষতিগ্রস্ত হয় জীবিকা। বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন খাদ্য। সেই খাদ্য উৎপাদন করে কৃষক। কৃষি নির্ভর দেশগুলোর কৃষিই এক্ষেত্রে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার প্রাণভোমরা। খাদ্যশস্য উৎপাদন ছাড়া, আগামীর প্রাণ বাঁচিয়ে রাখার উপাদান থাকবে না। করোনার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হলেও, খাদ্যশষ্যের অভাবে না খেয়ে থাকা থেকে রেহাই মিলবে না। দুর্ভিক্ষের ঘণ্টাধ্বনিও কারো কারো মুখে করোনার শুরুতে জোরেশোরেই শোনা গেছে। তবে আমাদের সৌভাগ্য আমাদের কৃষক, শত বিপদে, শত দুর্যোগেও তার পেশা ছাড়েননি। মাঠে তিনি নিজের লড়াই জারি রেখেছেন। ফলে দুর্ভিক্ষ বা খাদ্যশস্য সংকটের হাত থেকে আমাদের রেহাই মিলেছে। চীনের হুবেই প্রদেশের উহান থেকে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে গত বছর ডিসেম্বরে। সে হিসেবে পৃথিবী দাপিয়ে বেড়ানো ভাইরাসের তাণ্ডব চলছে এক বছর। আমাদের দেশে করোনা থাবা বসায় চলতি বছরের মার্চে। এরপর মানুষকে বাঁচাতে চলতে থাকে সরকারের নানা উদ্যোগ। প্রণোদনা দেওয়া হয় নানাক্ষেত্রে। কৃষিতেও সরকার ভুর্তকি ঘোষণা করে। প্রধানমন্ত্রী কৃষি জমির কোনো অংশ ফেলে না রাখার আহ্বান জানান। সেই আহ্বানে আমাদের কৃষক যে সাড়া দিয়েছেন, তার উদারহণ আমরা পদে পদে অনুভব করছি।

উদ্বৃত্ত ফসল আমাদের মুখে হাসি এনে দিয়েছে। বাজার ভর্তি শীতের সরজি। কিন্তু কৃষকের মুখে হাসি নেই। কৃষক তার উৎপাদিত ফসলের নায্য দাম কখনই পায় না- এ অভিযোগ বরবার। শুধু অভিযোগ নয়, এ আমাদের কৃষিক্ষেত্রে নির্মম সত্য। আমাদের কৃষকের আর্থিক দুর্দিন ফুরোয় না। আমদের কৃষির দুরবস্থা শেষ হয় না। ফসল ফলাতে কৃষকের প্রয়োজন বীজ, সার, কীটনাশকসহ নানা উপাদান। সারের জন্য কৃষকের জীবন দেওয়ার নিষ্ঠুর উদাহরণও রয়েছে আমাদের। যদিও বর্তমান সরকারের আন্তরিকতায় সে ধরনের নিষ্ঠুর পরিস্থিতিতে কৃষককে আর পড়তে হয় না। কিন্তু অন্য দুর্ভোগ শেষ হয়নি। নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে হাহুতাশ রয়েছে। বাজারে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি নিয়ে মানুষের ক্ষোভ রয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে কৃষক যে নায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত তা নিয়ে আমাদের খুব বেশি কথা নেই।

আমাদের খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে। এক সময়ের খাদ্য শস্য ঘাটতির দেশ থেকে আমরা খাদ্যশস্য উদ্বৃত্ত দেশে নাম লিখিয়েছি। কিন্তু আমাদের বাজারে খাদ্যশস্যসহ নিত্যপণ্যের দাম কমেনি। এই যে দাম না কমা, অথচ এর সুফল কৃষকের ভাগ্যে জোটেনি। আমাদের খাদ্যের জোগান বেড়েছে, বাজারে সরবরাহ বেড়েছে কিন্তু কৃষকের দুর্ভোগ কমেনি।

বাজারে গেলে শীতের সবজির যে উপস্থিতি তা চোখ জুড়িয়ে দিলেও, কৃষকের কান্না আড়াল করে না। সংবাদপত্রের একটি প্রতিবেদন বলছে, কৃষককে তার উৎপাদিত ১০ মণ মুলার বিপরীতে কিনতে হচ্ছে ১ কেজি চাল। প্রতিবেদনে এক মন মুলার দাম বিক্রয়মূল্য মাত্র দশ থেকে পনের টাকা বলে উল্লেখ করা হয়েছে (যদিও প্রতিবেদনটিতে গাণিতিক হিসেবের ক্রুটি রয়েছে)। অন্যদিকে মোটামুটি খাবার যোগ্য চালের কেজি এখন পঞ্চাশের নিচে না। বাজারে সবজি আসার আগে ধানের দামের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে একই প্রবণতা। কৃষক ধানের দাম পাননি, উৎপাদন খরচ ওঠেনি। অথচ এই মূলা উৎপাদন করছে কৃষক, আবার ধানও উৎপাদন করেছে কৃষক। কিন্তু তাদের কেউই দাম পাননি, মাঝে বাজার থেকে বাড়তি টাকা উঠিয়ে নিয়েছে মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা। 

এ থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজে বের করতে হবে। সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে ক্ষেত্রে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করে। বাজারে পণ্যমূল্য যেন স্থিতিশীল থাকে সেজন্য উদ্যোগী হয়। বাজার মনিটরিংসহ ভ্রাম্যমান আদালতও পরিচালনা করে। কিন্তু এতে খুব বেশি উপকার মেলেনি। কারণ, আমাদের অসচেতনতা। আমাদের বাজারে শৃঙ্খলা নেই। যে মুলা উত্তরবঙ্গে কৃষককে বিক্রি করতে হচ্ছে এক-দুই টাকা কেজিতে, সেই একই মুলা রাজধানীর বাজারে বিক্রি হচ্ছে গড়ে পঁচিশ থেকে ত্রিশ টাকা কেজিতে। রাজধানীতে মুলা বা পণ্য আসার পথে পরিবহন খরচের বাইরেও রয়েছে অলিখিত অনেক খরচ। যা কখনই উহ্য থাকেনি। নানাভাবে পত্রপত্রিকায় এসেছে। এর সঙ্গে অতিলোভী মধ্যস্বত্বভোগী গোষ্ঠী তো রয়েছেই। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য শুরুতেই বাজারে শৃঙ্খলা আনা প্রয়োজন। যদিও সেটি সময় সাপেক্ষ। তারপরও সেই চেষ্টা করতে হবে। বাজারে নিয়ন্ত্রণে ফেরানোর পাশাপাশি কৃষি সমবায়ে কৃষককে উৎসাহিত করতে হবে। কৃষিভিত্তিক সমবায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো এমনভাবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে যাতে করে আমাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চাষীরাও তাতে শুধু অংশগ্রহণই নয়, বড় ভূমিকা রাখতে পারে। এছাড়া কয়েক বছর আগে কৃষক বাজরের ধারণা নিয়ে দেশের বেশ কয়েকটি স্থানে বাজার বসানো হয়েছিল, যেখানে কৃষক নিজেই তার উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করবেন। যাতে করে কৃষকের নায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়। সেই প্রক্রিয়াটিকে সচল করার সঙ্গে সঙ্গে সরকারের বাজারদর নির্ধারণ করা এবং তা যথাযথভাবে মনিটরিংয়ের উদ্যোগ নিতে হবে। অন্যথায় কৃষক আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে কৃষিতে। ক্রমাগত লোকসানের মুখে কতদিন তার টিকে থাকা সম্ভব, সেদিকটিও ভাবার সময় এসেছে।

শুরুতে যে উন্নতির কথা বলেছিলাম শিক্ষা ও কৃষি ক্ষেত্রে। সেই উন্নতির পথে শিক্ষা আমাদের কৃষিকে এগিয়ে দিতে পারে আরও অনেক গুণ। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে দেশব্যাপী খাদ্যশস্য চলাচলের পথও মসৃণ হয়েছে। কৃষক আজ অনায়াসে তার পণ্য অন্য জেলায়, পাঠাতে পারছে। কিন্তু এখানে এই উদ্যোগে কৃষকের সম্পৃক্ততা কতোটুকু, তা দেখতে হবে। কৃষকের পরিবর্তে খাদ্যশষ্য পাঠানোর প্রক্রিয়ায় মধ্যসত্বভোগীদের অবস্থান জোরালো কৃষক লাভবান হবে না। কৃষকের দুর্ভোগ ও দুর্দশা ঘোচানোর জন্য সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। বাজারের চাহিদা নির্ধারণসহ ফসল উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় আধুনিকায়নের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। কতটুকু ফসল আমাদের প্রয়োজন, কতটুকু বাজারের চাহিদা তা নির্ধারণ করে কৃষককে উৎপাদনের সম্পৃক্ত করলে, উদ্ধৃত্ব ফসলের ভারে দাম না পেয়ে কৃষককে নুয়ে পড়তে হবে না। কৃষির উন্নয়নের পথে শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে কৃষি ও কৃষককে বাঁচাতে হবে। কৃষি ও কৃষকের উন্নয়ন ছাড়া সর্বার্থে উন্নয়ন নিশ্চিত করা অসম্ভব বলেই মনে করি।

কবি, সাংবাদিক

ঢাকা/তারা


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়