উদ্দেশ্যমূলক সাংবাদিকতার এক ঘণ্টা!
লেখক, নাট্যকর্মী ও শিক্ষক রুমা মোদক ফেসবুকে লিখেছেন: ‘‘তিন লাইন মিথ্যার সাথে এক লাইন সত্য বসিয়ে তৈরি করা হয়েছে নতুন এস্থেটিক জেনেরে, যার নাম ‘ডকু ফিকশন’। গোয়েবলস-এর বিপরীতে এটি বেশ কার্যকরী পন্থা।’’
হিটলারের প্রচারমন্ত্রী গোয়েবলসের কৌশল ছিল মিথ্যাকে বারবার প্রচার করা, যাতে তা সত্যের বিভ্রম তৈরি করতে পারে। গোয়েবলসের আধুনিক ভার্সন হলো তিন লাইন মিথ্যার সঙ্গে এক লাইন সত্য মিশিয়ে দাও, বিতর্ক সৃষ্টি করো, মানুষকে বিভ্রান্ত করো। গোয়েবলস তার কৌশলে সাময়িক সাফল্য লাভ করেছিলেন। আধুনিক গোয়েবলসরাও মিথ্যার সঙ্গে সত্য মিশিয়ে এক ধরনের বিভ্রান্তির মেঘ তৈরি করে, যা অনেকের চিন্তা করার ক্ষমতাকে আড়াল করে দেয়।
কাতারভিত্তিক নিউজ চ্যানেল আল জাজিরাও গোয়েবলসের আধুনিক ভার্সন। কিছু বহু পূর্বে প্রকাশিত তথ্যের সঙ্গে বায়বীয় অভিযোগ মিশিয়ে তারা যে ‘ডকু ফিকশন’ বানিয়েছে, তা আলোচনার জন্ম দিতে পেরেছে বটে; আর এটাই তারা চেয়েছিল। আপনার সম্প্রচার সুবিধা আছে, তা দিয়ে যদি যখন-তখন, যাকে-তাকে হেয় করেন, তাহলে সেটা অপসাংবাদিকতা। অবশ্য জন্মের পর থেকেই অপ এবং উদ্দেশ্যমূলক সাংবাদিকতার নতুন নতুন পথ দেখাচ্ছে আল জাজিরা। অপসাংবাদিকতার কারণে মধ্যপ্রাচ্যেরই পাঁচটি দেশে আল জাজিরা নিষিদ্ধ। এই নিউজ চ্যানেলটি বরাবরই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে, বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে আল জাজিরা সংশয় প্রকাশ করেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে তারা দিনের পর দিন অপসাংবাদিকতা করেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দণ্ডিত ডেভিড বার্গম্যান, এই ডকু ফিকশনেরও অন্যতম কুশীলব। বুঝতে অসুবিধা হয় না, বাংলাদেশ-বিরোধী চক্রটি আবার এক হয়েছে।
২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বর থেকে হেফাজতে ইসলামকে বিতারণের পরও উদ্দেশ্যমূলক অপসাংবাদিকতার নজির স্থাপন করেছিল আল জাজিরা। শাপলা চত্বরে ‘গণহত্যা’ হয়েছিল, এমন কাল্পনিক অভিযোগ প্রমাণ করতে তারা একজন বধির লোকের সাক্ষাৎকার নিয়েছিল! ১৮ কোটি মানুষের দেশে ‘হাজার হাজার মানুষ’ হত্যার অভিযোগ প্রমাণ করতে যাদের বধির লোকের দ্বারস্থ হতে হয়, তারা আর যাই করুক সাংবাদিকতা করে না- এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
এক ঘণ্টার যে ‘ডকু ফিকশন’ নিয়ে এত আলোচনা; বোঝাই যায়, এর পেছনে মোটা অঙ্কের বিনিয়োগ আছে। আল জাজিরা এটিকে ‘অনুসন্ধান’ দাবি করলেও, এটি কোনোভাবেই অনুসন্ধান তো নয়ই, সাংবাদিকতাও নয়। নেটফ্লিক্সের প্রভাবে বানানো একটি থ্রিলার ডকু। এটিকে অনুসন্ধানী রিপোর্ট তো নয়ই, কোনোভাবে ডকুমেন্টারি বা তথ্যচিত্রের মর্যাদাও দেওয়া যাবে না। এটা নিছকই ডকু ফিকশন; বলা ভালো- বানানো গল্প।
বরাবরই আল জাজিরা হলো অপশক্তির মুখপাত্র। ওসামা বিন লাদেন এবং আল কায়েদার মাইক আল জাজিরা বিশ্বজুড়ে জঙ্গিবাদ আর সন্ত্রাসবাদের প্রচারের দায়িত্ব নিয়েছে অনেক আগেই। নিজেদের বাণিজ্যিক অস্তিত্বের জন্য আল জাজিরা ভাড়া খাটে। আদর্শের সঙ্গে মিললে যারা তাদের টাকা দেবে, তাদের হয়েই তারা কথা বলবে। বাংলাদেশের একটি অপ্রমাণিত বিষয় নিয়ে আল জাজিরা নিজের পয়সায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ঘুরে ঘুরে অনুসন্ধান করছে, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তাদের গল্প বানানোর দক্ষতাকে ভাড়া নিয়েছিল বাংলাদেশ-বিরোধী কোনো পক্ষ। এই ডকু ফিকশন তারই চিত্র।
আল জাজিরার তথাকথিত অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার শিরোণামেই এর উদ্দেশ্য নিহিত। এক ঘণ্টার ডকু ফিকশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিপক্ষে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকলেও শিরোনাম করা হয়েছে- অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার্স মেন। এরপর উদ্দেশ্যেমূলক সাংবাদিকতার আর কোনো প্রমাণ দরকার?
শেখ হাসিনার সঙ্গে কারো ঘনিষ্ঠতা বোঝাতে যদি আশির দশকে মঞ্চে তাঁর পেছনে দাঁড়ানো কারো ছবি ব্যবহার করা হয়- তাকে আর যাই বলুক, সাংবাদিকতা বলে না। গত চার দশকে মঞ্চে বা মঞ্চের বাইরে শেখ হাসিনার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছেন, এমন লোকের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে যাবে। এখন এই লাখ লোক পৃথিবীর কোন প্রান্তে কী করছে, তার দায়-দায়িত্ব কি শেখ হাসিনাকে নিতে হবে?
ডকু ফিকশনটির কন্টেন্ট নিয়ে খুব বেশি বলার কিছু নেই। বহু পুরোনো কিছু জানা তথ্য আর কিছু অপ্রমাণিত অভিযোগে ঠাসা সিনেমাটিক ডকুটিতে দুই মিনিটেই যা বলা সম্ভব, তা টেনে এক ঘণ্টা বানানো হয়েছে। বর্তমান সরকার টানা একযুগ ক্ষমতায়। বাংলাদেশের মতো একটি দেশে টানা এক যুগ ক্ষমতায় থাকলে নানা অভিযোগ আসবে- এটা স্বাভাবিক। বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে দুর্বল করা, গণতান্ত্রিক স্পেস সঙ্কুচিত করা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ, দুর্নীতির নানা অভিযোগ আছে। কিন্তু একটি গণমাধ্যম যখন কোনো অভিযোগ তুলবে, তা হতে হবে সুনির্দিষ্ট এবং প্রমাণসহ। তেমন কিছু ডকুতে নেই। পুরোটা দেখার পর একটা অভিযোগই আমার কাছে মনে হয়েছে, সেটা হলো- ইসরায়েল থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ইন্টারনেট ও মোবাইল মনিটরিং সরঞ্জামাদি কিনেছে। প্রথম কথা হলো, এটি সম্ভব নয়। কারণ ইসরায়েলের সঙ্গে আমাদের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)-এর পাঠানো প্রতিবাদে সেনা সদর দপ্তর সুস্পষ্টভাবে অভিযোগটি অস্বীকার করেছে এবং তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। নিছক অস্বীকার বা প্রতিবাদ নয়, সেনা সদর ব্যাখ্যা করেই বলেছে: ‘প্রকৃতপক্ষে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে ব্যবহারের জন্য হাঙ্গেরির একটি কোম্পানি থেকে সিগন্যাল সরঞ্জামাদি কেনা হয়েছে। ক্রয়কৃত সরঞ্জাম কিংবা এ সংক্রান্ত কোনো নথিপত্রেই এগুলো ইসরায়েলের তৈরি বলে উল্লেখ নেই।’
বাংলাদেশ ইসরায়েলের কাছ থেকে ইন্টারনেট ও মোবাইল মনিটরিং সরঞ্জাম কিনছে, এটা বলে আসলে বাংলাদেশে মৌলবাদীদের উস্কে দেওয়ার অপচেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে, মানুষ আল জাজিরার ডকুটি বিনোদন হিসেবে দেখেছে, বিশ্বাস করেনি। আল জাজিরা বারবার অপসাংবাদিকতা করে নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতাকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে এনেছে। তাই আল জাজিরা কিছু প্রচার করেছে, এটাই অভিযোগ অবিশ্বাস করার জন্য যথেষ্ট।
ডকু ফিকশনটির কন্টেন্ট এবং অন্যান্য বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সেনা সদর দপ্তর ব্যাখ্যা এবং প্রতিবাদ জানিয়েছে। সেটা নিয়ে আমার নতুন করে বলার কিছু নেই। তবে আমি চাই, অভিযোগগুলো অপ্রমাণিত হলেও সেগুলো খতিয়ে দেখা হোক। এই ডকু ফিকশনের সবচেয়ে দুর্বল দিক হলো, হাঙ্গেরিতে পালিয়ে থাকা মোহাম্মদ হাসান বা হারিস আহমেদের গোপনে ধারণ করা কথোপকথনই তাদের অভিযোগের মূল ভিত্তি। সেই হাসান বা হারিসকে আল জাজিরাই ‘সাইকোপ্যাথ’ বলে উল্লেখ করেছে। তো একজন ‘সাইকোপ্যাথ’ কী বললো না-বললো, তার একতরফা বক্তব্য দিয়ে এক ঘণ্টার অনুসন্ধানী ডকু বানানো যায়?
নাম ভাঙিয়ে নানা কিছু করার অনেক অভিযোগ আমরা বাংলাদেশেও পাই। যে কেউ নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণের জন্য নানা কিছু বলতে পারেন। কিন্তু একটা গণমাধ্যম সেটা আমলে নেবে কেন? আল জাজিরার ভাষায় যিনি সাইকোপ্যাথ, তার বক্তব্য দিয়ে একটি আন্তর্জাতিক মিডিয়া কীভাবে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্যদের মর্যাদাহানীর চেষ্টা করতে পারে? আল জাজিরার এই চেষ্টা কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়। এতে বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় অতন্দ্র প্রহরী পুলিশ ও র্যাবকে হেয় করার অপচেষ্টা হয়েছে। তাই এটা উদ্দেশ্যমূলক সাংবাদিকতার একটি উদাহরণ হয়েই থাকবে।
একটি সরকার ভালো কাজ যেমন করে, তেমনি খারাপ কাজও করতে পারে। বর্তমান সরকার খারাপ কিছু করলে আমরা সেটার সমালোচনা করি, করবো। কিন্তু সরকার-বিরোধিতা আর বাংলাদেশ-বিরোধিতা এক নয়। আল জাজিরার ডকুতে এমনকি ৭৪-এর দুর্ভিক্ষের ছবিও আছে, কিন্তু বাংলাদেশের ৫০ বছরের অর্জনের কোনো ছবি নেই। আল জাজিরায় এখন পর্যন্ত কোনোদিন বাংলাদেশের পক্ষে একটি লাইনও সম্প্রচারিত হয়নি। এমন একতরফা এবং একটি দেশের প্রতি বিদ্বেষমূলক একটি সম্প্রচার মাধ্যমকে গণমাধ্যমের মর্যাদা দেওয়াই কঠিন। একটা ছোট কথা বলি, আল জাজিরার এই ডকুতেই প্রমাণিত হয়েছে বাংলাদেশে আইনের শাসন আছে। অপরাধ করলে এমনকি প্রভাবশালী কারো ভাই হলেও তাকে নাম লুকিয়ে পালিয়ে থাকতে হয়। তিনি যত বড় মাফিয়াই হোন, বাংলাদেশে থাকতে পারেন না।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সেনাসদর দপ্তর প্রতিবাদ জানিয়েছে, ব্যাখ্যা দিয়েছে। প্রয়োজনে আরো তদন্ত করুক। কিন্তু একজন দেশপ্রেমিক বাংলাদেশী হিসেবে আমি আল জাজিরার এই তথাকথিত অনুসন্ধানের প্রতিবাদ করছি। একজন সাংবাদিক হিসেবেও তাদের এই উদ্দেশ্যমূলক অপসাংবাদিকতার নিন্দা জানাচ্ছি। যারা আল জাজিরার এই ডকু দেখে উল্লসিত, তাদের বলছি- এটা কিন্তু সরকার বা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নয়, আল জাজিরা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। তাই আগে দেশকে ভালোবাসুন।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ লি.
ঢাকা/তারা