আহা! আমার দুঃখিনী বাংলা ভাষা
মাহফুজা হিলালী || রাইজিংবিডি.কম
বিশ শতকের মাঝামাঝিতে বাঙালি জাতি লড়াই করেছিল ভাষার জন্য। এখন একুশ শতকের বিশের দশক; ভাষার দূষণ রোধে চলছে মানসিক লড়াই। বাংলা ভাষার জন্য কষ্ট পাচ্ছেন অল্পসংখ্যক বাঙালি। তাঁরা দূষণ রোধ করার চেষ্টাও করছেন। কিন্তু এক প্রবল অপসংস্কৃতির জোয়াড়ে ভেসে যাচ্ছে বাংলা ভাষা, নড়ে যাচ্ছে ভাষার ভীতG
একদল বলছেন- এটাই নিয়ম। অন্য দল বলছেন- এটা ভাষার জন্য হুমকিস্বরূপ। হ্যাঁ, ভাষা প্রবাহমান নদীর মতো। এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকে না। ভাষা পরিবর্তন হবে- স্বাভাবিক। কিন্তু সে পরিবর্তন ইতিবাচক হলেই মঙ্গল, নইলে ভাষা নিজস্বতা হারাবে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে ভাষাদূষণের কথাগুলো ওঠা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক! কিন্তু বাংলা ভাষা বড়োই দুঃখিনী। তাই আজ প্রশ্ন উঠছে- নতুন প্রজন্ম কি বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা করছে, অসম্মান করছে, দূষিত করছে? প্রশ্ন উঠছে- রাষ্ট্র কি সেই দূষণ দেখে চুপচাপ বসে আছে? কিংবা সত্যিই কি রাষ্ট্রের কিছু করার নেই, অনিবার্য পরিণতির দিকে এগিয়ে চলছে সংস্কৃতি। কিংবা রোধ করবার কিছু উপায় আছে, যা এখনই প্রয়োগ করা প্রয়োজন। এই প্রবন্ধে দেখানোর চেষ্টা করব ভাষায় কতোটা দূষণ হচ্ছে, কীভাবে ভাষাকে অবজ্ঞা করা হচ্ছে, কী করলে ভাষা নিজস্বতায় ফিরবে।
মধ্যযুগের কবি আব্দুল হাকিম লিখেছিলেন:
যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।
দেশি ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়।
নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশ ন যায়।।
মাতা পিতামহ ক্রমে বঙ্গেত বসতি।
দেশি ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি।।
অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে মধ্য যুগেও বাংলা ভাষা হুমকির মুখে পড়েছিল। তখন সম্ভ্রান্ত মুসলিমরা আরবি-ফারসি-উর্দুর প্রতি আসক্ত ছিলেন। বাংলাকে অবজ্ঞা করতেন। তাদের পারিবারিক ভাষাও ছিল ফারসি আর উর্দু, দাপ্তরিক ভাষা ফারসি আর ধর্মের ভাষা আরবি। এদেরকেই কবি উপরের কথাগুলো বলেছিলেন। অন্যদিকে সে সময় সম্ভ্রান্ত হিন্দুদের ভাষা ছিল সংস্কৃত ঘেষা। ব্রাহ্মণ-কায়স্তরা বাংলাকে অবজ্ঞা করতেন। একেবারে সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা ছিল বাংলা। সাধারণ মানুষেরাই এই বাংলা ভাষা বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। এ ভাষাতে সাহিত্যচর্চাও হতো। যুগে যুগে তো সাহিত্যিকরাই সাধারণ মানুষ এবং তাদের ভাষা বাঁচিয়ে রাখে।
ফয়জুন্নেসা চৌধুরাণী উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সাধারণ মানুষের মুখের এই বাংলা ভাষাকে নিজের জমিদারির দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্থান দিয়েছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে তা স্বীকৃতি পায়নি। নিজের জমিদারির দপ্তরের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ ছিল। আমরা জানি, সাতচল্লিশ-এ দেশ ভাগের পর আঘাত এসেছিল ভাষার উপর। তখনও সাধারণ মানুষই প্রতিরোধ করেছিলেন। প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন বাংলা ভাষার সম্মান। এখন আমরা বাংলাদেশের মানুষ। ভাষার কারণেই দেশের নাম বাংলাদেশ। অথচ, আজও ভাষাকে সম্মান দেওয়ার জন্য চিৎকার করতে হচ্ছে। ভাষা দূষণের প্রতি, ভাষার অসম্মানের প্রতি নজর নেই কারো। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ছাড়া বেশির ভাগ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি ভাষায় কাজ চলছে (বিদেশের সাথে বা বিদেশিদের সাথে অবশ্যই ইংরেজিতে যোগাযোগ হবে। এতে কোনো দ্বিমত নেই।)। সরকারি আদেশ অমান্য করে দোকান-রেস্তোরাঁর নামও ইংরেজিতে লেখা হচ্ছে। বাংলাদেশে এটা কাম্য নয়।
এবারে আসি প্রতিদিনের ভাষা ব্যবহারের প্রসঙ্গে। প্রতিদিন প্রতিক্ষণে কথা বলার সময় ভাষাকে দূষণ করে চলেছে বাংলাদেশের মানুষ। বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম। বিশ শতকের তারুণ্য ভাষা রক্ষা করেছিল, একুশ শতকের তারুণ্য ভাষা ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে! প্রশ্ন হলো কীভাবে? আজকের তরুণ সমাজ কথা বলবার সময় বাংলার ভেতরে অবলীলায় অহেতুক ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে। যেমন: অ্যান্ড, বাট, সো, অলসো, অলদো, অ্যাকচুয়ালি ইত্যাদি শব্দ। এই শব্দগুলো বাংলা কথার মধ্যে না আনলেও চলে। বরং এগুলোর মাধ্যমে ভাষা দূষণ করা হয়। শুধু তরুণরাই নয়, সব বয়সী মানুষের মধ্যেই এই প্রবণতা দেখা যায়। যেন বাংলার মধ্যে একটু-আধটু ইংরেজি না বললে জাতে ওঠা যায় না। আবার অনেকে বাংলা ভাষায় কথা বলতে বলতে এক/দু’বাক্য ইংরেজিতে বলে নিজের পাণ্ডিত্য জাহির করতে চান। এটাও ভাষার দূষণ। কই যখন তারা ইংরেজি বলেন, তার মধ্যে তো দু’একটা বাংলা শব্দ ঢুকিয়ে দেন না। অর্থাৎ যখন বাংলায় বলছি পুরোটাই বাংলায় বললাম, আর যখন ইংরেজিতে বলছি পুরোটাই ইংরেজিতে বললাম- এমন কি হয় না? নিশ্চয়ই হয়। তাহলেই বাংলা ভাষার স্বরূপ ঠিক রাখা সম্ভব।
এমনিতেই বাংলায় অনিবার্যভাবে বিদেশি ভাষা অনেক ঢুকেছে। যেগুলো না ঢুকিয়ে উপায় নেই। এখনও ঢুকছে। যেমন: ইন্টারনেট, মোবাইল, টিভি, ওভেন, ফ্রিজ- এ রকম শব্দগুলো। এগুলো এখন বাংলা ভাষারই অংশ। তাহলে যে শব্দগুলো না বললে চলে, সেগুলো কেন বলবো?- এ হলো এক রকম দিক।
অন্যদিকে কিছু মানুষ আছেন যারা ইংরেজির দিকে প্রবলভাবে ঝুঁকেছেন। বাড়িতে শিশুদের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলেন। তারা বাচ্চাদের রসগোল্লা, সন্দেশ, চমচম, পায়েশ- সব কিছুকেই সুইট বলে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। বাংলার বৈচিত্র্য সন্তানদের শেখাচ্ছেন না। এমনকি বাংলার ইতিহাসও তারা জানান না। বাংলাকে পুরোপুরি অবহেলা করে চলেছেন। অথচ বাংলার রূপ-রস, আলো-হাওয়া পান করেই তারা বড়ো হচ্ছেন। এই দল বাংলা ভাষার জন্য প্রচণ্ডভাবে ক্ষতিকর। আরেক দল আছেন, যাদের বাচ্চারা হিন্দি চ্যানেল দেখে দেখে হিন্দিতে কথা বলতে শুরু করেছে। আবার তারা নিজেরাও বাচ্চাদের সঙ্গে হিন্দিতে কথা বলেন। ইংরেজি, হিন্দি বা অন্য কোনো ভাষা তারা শিখতেই পারেন; ভাষা শেখা অনেক ভালো বিষয়। কিন্তু মাতৃভাষা বাংলাকে অবজ্ঞা করে নয়- এটাই আমার বলবার বিষয়।
আমাদের ভাষা দু’রকম। একটি মান বাংলা, অন্যটি আঞ্চলিক বাংলা। দুটোই আমাদের সম্পদ। প্রত্যেকটি আঞ্চলিক ভাষাকেই আমরা সম্মান করবো। আর সব অঞ্চলের মানুষের বোধগম্য করার জন্য এবং সব দিক দিয়ে ভাষাকে সুন্দর উপস্থাপনের জন্য মান বাংলা শিখবো, বলবো। কোনো অবস্থাতেই বাংলা ভাষাকে দূষিত করবো না- এ রকমই আমাদের মানসিকতা হওয়া উচিত। কিন্তু কিছু উর্ধ্বতন ব্যক্তিবর্গ বাংলাভাষী মানুষদের এতোটাই অবজ্ঞা করেন যে, তাদের উচিত দেশ ত্যাগ করে চলে যাওয়া।
এবার তারুণ্যের কাছে ফিরি। তারুণ্যই বুকের রক্ত দিয়ে ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছিল, তারুণ্যই জীবনের বিনিময়ে দেশের স্বাধীনতা এনেছিল, তারুণ্য এখনও আছে। তারা কী করছে? তারা কি জানে ভাষার প্রতি তাদের দায়িত্বের কথা? বর্তমানে তরুণ এবং যুব সমাজই সবচেয়ে বেশি দূষিত করছে বাংলা ভাষা। তারা বাংলা এবং ইংরেজি মিশিয়ে এক জগাখিচুরি ভাষা তৈরি করছে। তারা মান বাংলা এবং আঞ্চলিক বাংলার সঙ্গে আরোপিত কিছু শব্দ যোগ করে এক শ্রুতিকটূ ভাষা তৈরি করছে। ভয় হয় এই ভাষাই না স্থায়ী হয়ে যায় সমাজে-সাহিত্যে। তাহলে বিশ্বের সবচেয়ে শ্রুতিমধুর বাংলা ভাষা মাধুর্য় হারিয়ে ফেলবে। হায়! বাংলা ভাষা!
এমনি নেতিবাচক পরিবর্তনের দিকেই ধাবিত হবে কি বাংলা ভাষা? এ থেকে উত্তরণের পথ কি নেই? নিশ্চয়ই আছে। পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র সবাইকেই এর দায় নিতে হবে। দায় নিতে হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও। বিশুদ্ধ বাংলার চর্চা করতেই হবে। এর একমাত্র পথ মাতৃভূমি এবং মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা। পরিবারে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে ফিরতে হবে বাঙালি সংস্কৃতির কাছে। রাষ্ট্র অনেক অনুষ্ঠান করে, যার বেশিরভাগই দায়সারা। তা করলে চলবে না। সংস্কৃতির কাছে দায়বদ্ধ হতে হবে। আকাশ সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকে দেশের মানুষ বাঙালি সংস্কৃতিকে ভুলতে বসেছে। আবার যারা বাধ্য হয়ে দেশীয় ঐতিহ্যের বিভিন্ন অনুষ্ঠান করছে তাদের কাছে আনুষ্ঠানিকতাই হয়ে উঠেছে প্রধান, তার সঙ্গে আত্মীক সম্পর্ক নেই (সবাই নিশ্চয়ই নয়। কিছু নির্দিষ্ট মানুষ তো ভালোবাসেন বাঙালি সংস্কৃতি)।
তাই আমাদের সমৃদ্ধ বাঙালি সংস্কৃতিকে আবার মানুষের উঠোনে পৌঁছে দিতে হবে। শুধু কথার ফুলঝুড়ি নয় হৃদয় দিয়ে হৃদয়কে অনুভব করা জরুরি। এখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, তাই আইন করে হলেও বাংলা ভাষার দূষণ রোধ করা এবং সব জায়গায় বাংলার প্রচলন করা প্রয়োজন। পরিবারের বড়োরা যারা নতুন প্রজন্মের দায়িত্বহীনতা দেখে কষ্ট পাচ্ছেন, তাদেরও দায়িত্ব নিতে হবে। তবেই সম্ভব এই পরিস্থিতিতে উত্তরণ ঘটানোর।
প্রতিটি যুগেই বাংলা ভাষা দুঃখিনী। চর্যাপদের সময় বাংলাকে বিতারিত করা হয়েছিল। রাষ্ট্রীয়ভাবে অবজ্ঞা করা হয়েছিল মুসলিম শাসনামলে, ইংরেজ শাসনের সময়, পাকিস্তানি শাসনের সময়। এমনকি বর্তমান বাংলাদেশেও বাংলাকে দূষিত করা হচ্ছে। অথচ এ ভাষা বাঙালির প্রাণের ভাষা। এ ভাষার জন্যই পূর্বপুরুষরা প্রাণ দিয়েছিলেন। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে- জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধু বাংলায় ভাষণ দিয়েছিলেন। তাই বাংলা ভাষাকে সঠিক মর্যাদা দেওয়ার দায়ভার আমাদেরই নিতে হবে।
বাংলা ভাষার জয় হোক।
লেখক: নাট্যকার ও গবেষক; সহকারী অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকা/তারা