মধ্যবিত্তের দিকে আলাদা দৃষ্টি দিতে হবে
নাভিশ্বাস- শব্দটির সঙ্গে কমবেশি সব বাঙালিরই পরিচয় রয়েছে। নাভিদেশ হতে ওপরের দিকে যে শ্বাস ওঠে, তাকে নাভিশ্বাস বলে। সাধারণত মৃত্যুকালীন, শেষ অবস্থা বোঝাতে শব্দটি ব্যবহার হয়। যত্রতত্র প্রয়োগে শব্দটি মাধুর্য হারাতে বসলেও, করোনাকালীন ও পরবর্তী সময়ে শব্দটি তার যথার্থতা বুঝিয়ে দিচ্ছে। যখন আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সঙ্গতি থাকে না, পকেট ভরে টাকা নিয়ে গিয়ে বাজারের থলি ভরানো যায় না। বিলাস দ্রব্য তো দূরের কথা, সংসারে নিত্যপণ্যের জোগান দিতেই হিমশিম খেতে হয়। নিত্যপণ্যের বাজারে গিয়ে মানুষ অস্বস্তিও বোধ করে, প্রয়োজনের অংশটুকু কিনতেই হাঁপিয়ে ওঠে, সে অবস্থাকেও নাভিশ্বাস বলা যেতে পারে।
বর্তমান সময়ে সত্যিকার অর্থেই শব্দটি তার যথার্থতা, প্রমাণ করতে পেরেছে। নিন্মবিত্ত ও মধ্যবিত্তের বর্তমান অবস্থা বোঝাতে এর চেয়ে যথাশব্দ খুঁজে পাওয়া দুস্কর।
মধ্যবিত্তের পরিবারেই সবসময় থাকে লড়াই-সংগ্রাম, অনিশ্চয়তা, পথ হারিয়ে ফেলার শঙ্কা। করোনাকালীন বৈশ্বিক মহামারির চরম দুর্দিনের নৃংশস শিকার মধ্যবিত্ত। সীমিত আয়, ছোট চাকরি, ছোট ব্যবসা, মাস শেষে বাড়িভাড়া, বাজার খরচ, সন্তানের স্কুলের বেতন, আনুষঙ্গিক আরো অনেক খাতে খরচের মাঝেও হাজারো স্বপ্ন, সাধ কিন্তু সাধ্য থাকে না। টানাটানির জীবনে নতুন সংকট তৈরি হয় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘিরে। সংক্রমণ রোধে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও গত বছরের মার্চের শেষে ছুটি ঘোষণা করে সরকার। এর প্রায় আড়াই মাস পর জীবন বাঁচিয়ে জীবিকা চালু রাখতে সরকার স্বাস্থ্যবিধি মেনেই সীমিত পরিসরে সবকিছু খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ দীর্ঘদিন কাজকর্ম না থাকায় সংকটাপন্ন হয়ে উঠেছিল সাধারণ মানুষের জীবন। মানুষ যেন খাদ্যকষ্টে না পড়ে সেজন্য সরকারের খাদ্যসহায়তা, নায্যমূল্যে খাদ্য সরবরাহের উদ্যোগ থাকলেও উপার্জন না থাকায় দ্রুত ফুরিয়ে আসতে থাকে সাধারণ মানুষের সঞ্চয়। সেই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটেনি।
গত প্রায় এক বছরের শূন্যতাপূরণ মধ্যবিত্তের পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। করোনাকালীন অসংখ্য মানুষ চাকরি হারিয়েছে। রাজধানীতে তারা কোনোরকমে দিন কাটাচ্ছে। তাদের অনেকেই রাজধানী ছেড়েছে। মহামারীকালে দলে দলে মানুষের রাজধানী ছাড়ার দৃশ্য সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে এখন কারো অজানা নয়। এ সময় যখন জীবন বাঁচানোই ছিল সংশয়ের, তখন অনেকেরই বেতন কমেছে। সরকার ঘোষিত ছুটির সময়ে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান কর্মীদের দিয়েছে অর্ধেক বেতন। যা দিয়ে রাজধানীতে টিকে থাকা অসম্ভব। তাই রাজধানী ছাড়ে অনেক পরিবার।
ইতোমধ্যে করোনার প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে। সরকারের ইতিবাচক সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের মানুষ বিনামূল্যে করোনার টিকা নিতে পারছে। পরিস্থিতিও অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে আসছে। প্রতিদিনের করোনাবিষয়ক যে তথ্য সংবাদমাধ্যমে আসছে, তাতেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে ওঠার চিত্রই স্পষ্ট। হয়তো খুব শিগগিরই করোনার আতঙ্ক ও বিপদ কেটে যাবে। কিন্তু নিন্মবিত্ত ও মধ্যবিত্তের জীবনে করোনা যে ভয়াবহ প্রভাব রেখে গেল, তাদের জীবন যেভাবে দুর্বিসহ করলো তার অবসান সহসা হবে কিনা- তা কেউ জানে না। এই না জানার পেছনে রয়েছে নিত্যপণ্যের উর্ধ্বগতি। নিত্যপণ্যের লাগামহীন দাম। যা ক্রমশ মানুষকে অস্থির করে তুলছে। বর্তমানে মানুষের পারিবারিক উপার্জন ৭৪ শতাংশ কমেছে বলে সাম্প্রতিক সময়ে ব্র্যাক, ডেটা সেন্স ও উন্নয়ন সমন্বয় পরিচালিত এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। অর্থাৎ করোনার আগে যে পরিবার ১০০ টাকা আয় করত এখন করছে মাত্র ২৬ টাকা। আর এই পরিবারগুলোই হচ্ছে নিন্ম আয়ের ও মধ্যবিত্ত পরিবার। মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো যে সঞ্চয় ভেঙে খাওয়া শুরু করেছে সে বিষয়টিও স্পষ্ট হয়ে উঠছে বিভিন্ন সময়ে সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে।
এ অবস্থায় প্রতিদিনই বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। মাছে-ভাতে বাঙালির বড় অংশের নিত্যপণ্যের তালিকায় এখন থাকে চাল, মসুর ডাল ও সয়াবিন তেল। অথচ এই তিনটি পণ্যের দাম চার মাস ধরেই বাড়তি। সয়াবিন তেলের দাম তো রেকর্ড স্পর্শ করেছে। অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে সয়াবিন তেল। এছাড়া অন্যান্য পণ্যের দামও বাড়ছে আশঙ্কাজনকহারে। আর যদি কখনো কোনো পণ্যের দাম কমে তো বাড়তে থাকে আনুষঙ্গিক অন্যান্য পণ্যের দাম। ফলে দাম কমার কোনো সুফলই ভোগ করতে পারে না সাধারণ মানুষ। একটি দৈনিক পত্রিকার প্রতিবেদনে একজন ক্রেতা প্রশ্ন রেখেছেন- ‘ফেব্রুয়ারিতেও ৮০ টাকা কেজি দরে কাঁচামরিচ খেতে হবে, ভাবা যায়?’
সত্যিই ভাবা যায় না। আর না ভাবা কাণ্ডকীর্তিই এখন সবখানে। কৃষকের হাতে যখন পণ্য থাকে, তখন পণ্যের দাম মেলে না। কিন্তু কৃষকের হাত থেকে পণ্য যেই হাতছাড়া হয়ে যায়, তখনই তার দাম বাড়ে। সেই বাড়তি দামেরও কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। করোনাকালীন যখন মানুষ ঘরে বন্দি, তখন বাজার থেকে মানুষকে যে দামে আলু কিনে খেতে হয়েছে, তা কি কেউ কখনো কল্পনা করেছে? আলুর দাম বাড়তে বাড়তে কোথায় ঠেকবে, তা যখন অনিশ্চিত তখন বাধ্য হয়ে সরকারকে দাম নির্ধারণ করে দিতে হয়। করোনা মহামারির সময় যখন টোটকা হিসেবে গরম পানিতে আদার রস খাবার পরামর্শ দিচ্ছিলেন অনেকে, তখন আদার দাম বাড়াতে বাড়াতে যেখানে ঠেকানো হয়, তাতে করে নিন্মবিত্ত তো দূরের, মধ্যবিত্তের পক্ষেও আদার নাগাল পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। পেঁয়াজের দামের কথাও আমরা ভুলে যাইনি। আমরা ভুলে না গেলেও প্রতিবছর কোনো না কোনো পণ্যে কারসাজির মাধ্যমে দাম বাড়িয়ে হাতিয়ে নেওয়া হয় বিপুল অর্থ। মাঝখান থেকে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস ওঠে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ জরুরি। বাজার নিয়ন্ত্রণ, বাজার মনিটরিংয়ের কথা বরবারই আলোচনায় থাকে। সরকারও বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়। তারপরও কেনো যেনো বাজারের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয় না। সরকারের দৃঢ়তায়, প্রণোদনায় আমরা করোনা মহামারি সামাল দিয়েছি। কিন্তু বাজার সামাল দেওয়া কেন ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে, তার তত্ত্ব তালাশ করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশসহ বিশ্বই আজ করোনার বিরুদ্ধে জয়ী হয়ে ক্রমশ সচল হচ্ছে জীবন ও জীবিকা। এ বড় আশার খবর, আনন্দের খবর। কিন্তু তার মাঝেও বেদনা ভরা কণ্ঠে বলতে হয়, আমাদের মধ্যবিত্তের জীবনযাপন মৃসণ হয়নি। এখনও এই জীবন অনিশ্চিত। এখানো প্রতি মুহূর্তে চাকরি হারানোর আশঙ্কা। কাজ করেও বেতন না পাওয়ার শঙ্কা রয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। করোনার সংক্রমণের ভয়ে যখন সবাই ঘরে আশ্রয় নিয়েছে, তখনো পাওনা বেতনের দাবিতে মানুষ রাস্তায় নেমেছে। সেই অমানবিক ও বিভৎস দৃশ্য তাড়া করে ফিরবে সভ্যতাকে। আগামীর লড়াইয়ে টিকে থাকার প্রবল প্রতিযোগিতায় আমাদের বিকাশমান মধ্যবিত্ত পরিবারের নিরাপত্তায় সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। মধ্যবিত্তের জীবনে যে সংকট শুরু হয়েছে, তা যদি সামলানো না যায়, তাদের সংকট যদি দীর্ঘ হয়, তাহলে তাদের অনেকেই নিন্ম মধ্যবিত্তের আওতায় চলে আসবে। যা আমাদের অর্থনীতির জন্য কোনোভাবেই ভালো খবর নয়। আমরা নিন্ম আয়ের দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় প্রবেশ করেছি। সেখানে আমাদের অবস্থান ধরে রাখতে এ সময়, এই সংকটে মধ্যবিত্তের দিকে সরকারকে আলাদা দৃষ্টি দিতে হবে।
লেখক: কবি, সাংবাদিক
ঢাকা/তারা