ঢাকা     শুক্রবার   ১৫ নভেম্বর ২০২৪ ||  অগ্রহায়ণ ১ ১৪৩১

বাংলা একাডেমির বইমেলা: কার লাভ কার ক্ষতি

ড. তানভীর আহমেদ সিডনী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৩৫, ৬ এপ্রিল ২০২১  
বাংলা একাডেমির বইমেলা: কার লাভ কার ক্ষতি

বাংলা একাডেমি আয়োজিত বইমেলা বাঙালির ‘প্রাণের উৎসব’। এবারের কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে বইমেলা তার চরিত্র হারিয়েছে। প্রকাশকদের চাপে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও বাংলা একাডেমি এবার বইমেলা করতে বাধ্য হয়েছে। এই আয়োজনের মধ্য দিয়ে কার লাভ এবং কার ক্ষতি হলো- সেটা ভাবনার বিষয় বটে!

প্রকাশক ও বই ব্যবসায়ী আমার কাছে কখনো এক নয়। লেখকের চিন্তাকে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন প্রকাশক। লেখা ও লেখকের অভিভাবক হিসেবে প্রকাশকদের বিবেচনা করি। তিনি একইসঙ্গে সমাজচিন্তকের কাজ করেন। সমাজচিন্তক হিসেবে রাষ্ট্র ও জনগণের প্রতি তার দায় আছে। এটা সত্য, বাংলাদেশের প্রকাশনাক্ষেত্রে স্বাধীনতার পর নানামাত্রিক কাজ হয়েছে। বিষয় বৈচিত্র ও আঙ্গিকের দিক থেকে এদেশের প্রকাশকরা মানসম্পন্ন অসংখ্য গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। তাদের হাতেই এদেশের প্রকাশনা-শিল্প নির্মিত হচ্ছে। মানছি, বই পণ্য। তবে তা আলু, পটল কিংবা শাড়ি নয়। পাঠকের চিন্তা কর্ষণে ভূমিকা রাখে বই। তাই প্রকাশক মানে কিন্তু আলু পটলের দোকানদার নয়। প্রকাশক কাজ করে জাতির চিন্তার বিকাশ নিয়ে। সন্দেহ নেই কাজটি দূরহ।

ভাষার মাসে বাংলা একাডেমি বইমেলা আয়োজিত হয়। বই বাজার নয়, একাডেমির নেতৃত্বে বইমেলার একটি রূপ কিন্তু তৈরি হয়েছে। গত কযেক বছর দেখা গেছে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাহিত্যিক, গবেষক বইমেলায় অতিথি হিসেবে যোগ দিয়েছেন। অমর্ত্য সেন, ক্লিনটন বি সিলি, ফাদার পল দ্যতিয়েন, অধ্যাপক পবিত্র সরকার, উইলিয়াম রদিচে, মহাশ্বেতা দেবী প্রমুখ বাংলা একাডেমি বইমেলার উদ্বোধনী আয়োজনে বক্তৃতা দিয়েছেন। বইমেলা উপলক্ষ্যে একাডেমি মাসব্যাপী সেমিনারের আয়োজন করে। দেশ ও দেশের বাইরের খ্যাতকীর্তি পণ্ডিতেরা সেমিনারে অংশ নেন। এই সেমিনার জাতির মনন নির্মাণে ভূমিকা রাখে- এ কথা বলা যায়। বইমেলার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও এই মেলার বিশেষ বৈশিষ্ট্য, সারাদেশ থেকে সাংস্কৃতিক সংগঠন ও শিল্পীরা এই অনুষ্ঠানে অংশ নেয়। শুধু তাই নয়, শিশু-কিশোরদের জন্য বেশ কয়েকটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। একই সঙ্গে ২১শে ফেব্রুয়ারির কবিতা পাঠের আসরে যোগ দিতে সারা দেশের কবিরা আসেন। বাংলা একাডেমির ‘লেখক বলছি’ আয়োজনও মেলাকে ভিন্ন মেজাজ দিয়েছে। তার মানে একুশে বইমেলা মানে বই বেচাকেনা নয়, বরং বাঙালির চিন্তা বিস্তারের কেন্দ্র। লেখক এখানে আসবেন, আড্ডা দেবেন, প্রকাশকের সঙ্গে ভাব বিনিময় করবেন। কিন্তু দুঃখজনক হলো- এবারের বইমেলা অনেকাংশে সেই চরিত্র হারিয়েছে। দেখা যাচ্ছে যে, বইমেলা নয়, এটি বইবাজারে পরিণত হচ্ছে। বইমেলার এই রূপ ১৯৮৪ সালের পর আর দেখা যায় নি।

কোভিড পরিস্থিতি বিবেচনায় বাংলা একাডেমি ফেব্রুয়ারিতে বইমেলা করতে আগ্রহী ছিল না। একাডেমির বিবেচনায় মেলার চেয়ে মেলায় অংশগ্রহণকারীদের স্বাস্থ্য গুরুত্ব পেয়েছে। প্রকাশক নেতৃবৃন্দের চাপের কারণে বাংলা একাডেমি বইমেলার আয়োজন করে। মেলা আয়োজনের যুক্তি হিসেবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই বলার চেষ্টা করেছেন- মার্কেট খোলা, ওয়াজ চলছে তাহলে বইমেলা কেন চলবে না? তারা এই বিবেচনা করে দেখেননি, মেলার ফলে করোনাভাইরাস দ্রুত সংক্রমিত হবে। মেলা কখনো স্বাস্থ্যবিধি মেনে আয়োজিত হতে পারে না। সে যা হোক, মেলা আয়োজনের আগে ১৬ই মার্চ সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘যদি কোভিড-১৯ সংক্রমণ পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, মেলা চালানোর মতো আর সুযোগ না থাকে, সেক্ষেত্রে আমাদের নতুন করে সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। মহামারিকে আমন্ত্রণ জানানো যাবে না।’

মেলা শুরুর কয়েকদিনের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা বিবেচনায় একাডেমি কর্তৃপক্ষ মেলার সময়সীমা কমিয়ে দেয়। প্রকাশকদের একাংশ এর সমালোচনা করেছেন; তারা যেন মহামারিকেই আমন্ত্রণ জানাতে চেয়েছেন। অর্থাৎ বাংলা একাডেমির বইমেলার বিশেষ বৈশিষ্ট্য যেটি আছে সেটি তারা ভুলে গেছেন। স্বাভাবিকভাবেই এবার বিক্রি শুরু থেকেই কম। যদি মেলা ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে তাহলেও এটা একুশের বইমেলার চরিত্র পাবে না। জানি না মেলার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা এটা উপলব্ধি করতে পেরেছেন কি না। মেলা শুরুর পর মেলা কমিটির সদস্যসচিবসহ বাংলা একাডেমির বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা কোভিড আক্রান্ত হয়েছেন। কয়েকজন প্রকাশকের আক্রান্তের খবরও পাওয়া গেছে। এর দায় কে নেবে? এক বছর মেলা আয়োজিত না হলে খুব বেশি ক্ষতি হতো কি? আমরা তো এই মহামারিকালে অনেক কিছুই বদলে নিয়েছি, তাহলে মেলা আয়োজন বাদ দিলে বোধহয় আমাদের ক্ষতির পরিমাণ বেশি হতো না। বরং বই বিক্রির জন্য প্রকাশকরা ভিন্ন চিন্তা করতে পারতেন। এখন যখন দেশের সব মার্কেট, শপিংমল বন্ধ তখনও বইমেলা চলছে, আর প্রকাশক নেতৃবৃন্দ চুপ করে দেখছেন। মেলা বিষয়ে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, যেহেতু প্রকাশকদের অনুরোধে এই মেলা আয়োজিত হয়েছে সেহেতু মেলা বন্ধের জন্য তাদের চিঠি দিতে হবে।

মেলা আয়োজনে কার লাভ হলো? আমার মনে হয়, কারো লাভ হয়নি। অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে প্রকাশকদের। এখন পর্যন্ত তারা যা বিক্রি করেছেন, তাতে মেলায় যে খরচ হয়েছে তা আয় করা সম্ভব হবে না। বাংলা একাডেমির এবারের বইমেলা প্রকাশকদের মনোবেদনার কারণ হয়ে থাকবে অনেকদিন। আর সরকারের যৌক্তিক কঠোর অবস্থার কারণে বিক্রি প্রতিদিনই কমবে। একইসঙ্গে মৃত্যুঝুঁকি বাড়বে। প্রকাশকদের এখুনি হিসাব করতে বসা উচিত- এই মেলা থেকে তারা কী লাভ করতে পেরেছেন? বরং বড়ো একটা অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছেন তারা। তাদের ভাবনার দরজা-জানলা খুলতে হবে। না হলে হয়তো আরও বড়ো কোনো ক্ষতির মুখোমুখি হবে এদেশের প্রকাশনা শিল্প।

লেখক: নাট্যকার ও গবেষক, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়
 

ঢাকা/তারা


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়