মানুষ কখনো হারে না
পৃথিবীজুড়ে এক লড়াই চলছে। বলা চলে, প্রায় অসম লড়াই। বছরের বেশি সময় ধরে এই লড়াইয়ে গোটা পৃথিবীর প্রতিপক্ষ করোনা নভেল ভাইরাস। প্রতিদিনই চারধার থেকে মৃত্যু সংবাদ। দুঃসংবাদের সঙ্গে যেন রোজকার বসবাস!
২০১৯ সালের শেষদিকে চীনে যখন এই ভাইরাস মানুষের প্রতিপক্ষ হয়ে প্রথম কামড় দিলো, তখন বাকি বিশ্ব নিজের সুখ-আনন্দের নিত্যদিনের সূচিতেই আটকে থাকার আয়েশে পড়েছিল। সেই সুযোগে করোনাভাইরাস দ্রুত গতিতে বিশ্বের ১৮২টি দেশের একক প্রতিপক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হলো।
বিশ্বের সাড়ে সাতশ কোটি মানুষের একক প্রতিপক্ষ হয়ে দেঁতো হাসি নিয়ে করোনা বাহু ফোলালো। আণবিকশক্তিতে সক্ষম দেশও এই ভাইরাসের ছোবলে অসহায়ত্ব নিয়ে দু’হাত মেলে আকাশের দিকে তাকালো; করুণার আশায়! করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে এখন বিশ্বের লড়াইটা অস্তিত্বের লড়াই। যে জিতবে- জীবন তার। যে হারবে- তার বিনাশ!
এই লড়াইয়ে নামার পর থেকে বদলে গেছে জীবন, জীবনধারণ ও জীবনাচারণের নিয়ম-কানুন। বলা হচ্ছে, মাস্ক নাকি হতে চলেছে মানুষের জীবনের বাকি সময়ের জন্য চিরায়ত অনুষঙ্গ!
তবু, জীবন থেমে থাকার নয়। কঠিন এই সময়ে আজ রাইজিংবিডির জন্মদিন। অষ্টম বছর পেরিয়ে আমরা পা রেখেছি নবম বর্ষে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণেই আমাদের এই প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পরিমিত আয়োজনে পালন করছি।
করোনাকালের এই কঠিন পরিস্থিতিতে আরো অনেক কিছুর সঙ্গে বদলে গেছে সাংবাদিকতার ধরন-ধারণও। সম্ভবত দুই বছর আগেও হোম অফিসের ধারণাটা কারও কাছে মেলে ধরলে হাসি-ঠাট্টা শুনতে হতো। কিন্তু এখন বিশ্বের সেরা করপোরেট প্রতিষ্ঠান, শিক্ষালয়, সভা-সেমিনার, অফিস-আদালতও ওয়ার্ক ফ্রম হোম-এর আওতাভুক্ত। সাংবাদিকতার কিছু অংশও এই ব্র্যাকেটবন্দি। তবে স্পটে না গেলে রিপোর্ট মিলবে কিভাবে? ভিডিও পাবো কই? সেজন্যই করোনাকালে আরও অনেক পেশার মতো সাংবাদিকরাও এই লড়াইয়ের ময়দানে ফ্রন্ট লাইনার। আর অনলাইন সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ তো আরও বেশি। যখনই ঘটনা, তখনই জানানো। তাৎক্ষণিকভাবে এর সত্যতা যাচাই করাও। দ্রুত সংবাদ প্রকাশ করা, যথাযথভাবে শেয়ার করার আয়োজনও করতে হয়। পাঠক কোন নিউজ বেশি পড়ছে, সেদিকে নজর রেখে তার আগ্রহ বিবেচনায় রেখেই এখানে সামনে বাড়তে হয়। নিজের পছন্দ-অপছন্দের চেয়ে পাঠকের রুচি মেনে সংবাদ খোরাকিই অনলাইন সাংবাদিকতার কঠোর বাস্তবতা।
ক্রিকেটে দলের ভারসাম্যের জন্য যেমন অলরাউন্ডার খোঁজা হয়, মাল্টি মিডিয়া অনলাইনেও ঠিক তেমন মাল্টি টাস্কারের মূল্যায়ন বেশি। শুধু লিখলেই চলবে না। ছবি জোগাড় করতে হবে। ভিডিও করা জানতে হবে। ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে লাইভ করতে হবে। ভিডিও স্টোরি নির্মাণের দক্ষতা থাকতে হবে। অনলাইন সাংবাদিকতা যেমন সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ বাড়িয়ে দিয়েছে, ঠিক তেমনি আবার প্রতিভাবানদের জন্য সুযোগের দুয়ার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এখানে ঠিক যেমন কেউ বেশি দিন বেশি সময় ধরে নিজের অযোগ্যতা লুকিয়ে রাখতে পারে না, তেমনি আবার যে এই কাজে দক্ষ, তাকে খুঁজে পেতেও বেশি সময় লাগে না।
অনলাইন সাংবাদিকতা নিয়ে খুব প্রিয় এক সাংবাদিকের একটি ব্যাখ্যা আমার মনে ধরেছে। সে বলে অনলাইন হলো অজগরের মতো। রোজকার আপনি যা দেবেন, সে হজম করে নেবে। প্রতিদিন এত এত নিউজ করলেন, এত ভালো নিউজ করলেন, কিন্তু পরদিন তার আর কোনো খোঁজ নেই। নতুন দিনের জন্য আবার নতুন করে আয়োজন করা, নতুন তথ্যের ‘খাদ্য’ জোগাড়ে নামা।
এ তো অজগরই বটে!
শুধু কি নিউজ? অনলাইন সাংবাদিকতার মার্কেটিংও এখন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে। তবে গুগল, ফেসবুক, ইউটিউব ও আরও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও যে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে আয়ের অন্যতম উৎস হতে পারে, সেটা মাত্র এক দশক আগে কেই-বা জানতো?
প্রিন্ট ও ব্রডকাস্টসহ সাংবাদিকতার যত দিক-ভাগ রয়েছে, সবক্ষেত্রের জন্য এখন অনলাইন সাংবাদিকতা হলো সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ। ঘটনার সঙ্গে-সঙ্গেই অনলাইনে পুরো বিষয়টা চলে আসছে। ফেসবুকে লাইভ হচ্ছে। মোবাইলের ছোট্ট স্ক্রিনে আপনি পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে সেটা দেখতে পাচ্ছেন। নিজের টাইমলাইনে শেয়ার করতে পারছেন। তাৎক্ষণিক মন্তব্য জুড়ে সেই নিউজের অংশ হতে পারছেন।
পাঠকের এই অংশীদারিত্বই অনলাইন সাংবাদিকতার সবচেয়ে বড় শক্তি। পাঁচ মিনিটের তৈরি একটি ভিডিও রিপোর্ট যখন মাত্র তিন দিনের মধ্যে ৩০ লাখের বেশি দর্শক উপভোগ করে, সেটাই আমাদের সামনে বাড়ার সাহস জোগায়। অনুপ্রাণিত করে।
রাইজিবিডির জন্মদিনে আমাদের প্রতিদিনের অগণিত সেই পাঠক, লেখক, শুভানুধ্যায়ী ও বিজ্ঞাপনদাতাসহ সব অংশীদারের জন্য একরাশ আন্তরিক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা। আপনাদের ভালোবাসা আমাদের পাথেয়। সঙ্গে ছিলেন, সঙ্গে থাকুন। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি- মানুষ কখনো হারে না। হয়তো সে থমকে দাঁড়ায়, কিন্তু ঠিকই জিতে- একটু দেরিতে এই যা!
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, রাইজিংবিডি
ঢাকা/তারা