সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাছ: অক্সিজেনটুকু থাক
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক মানুষ যখন শ্বাসকষ্টে মারা যাচ্ছে, ঠিক সেই সময় আরো একটি দুঃসংবাদ সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাছ কেটে তৈরি হচ্ছে রেস্টুরেন্ট!
রাজধানী ঢাকা ইট-কাঠ, পাথরের শহর। যে হারে মানুষের বসবাস এখানে, সে হারে গাছ নেই। একটু শীতল ছায়ার জন্য নগরবাসীকে হাপিত্যেশ করতে হয়। একটু প্রশান্তি পেতে যেতে হয় নগরীর উদ্যানগুলোতে। সবগুলো উদ্যান যে ভালো রয়েছে, গেলেই সেখানে নিশ্চিত দু’দণ্ড শান্তি মিলবে এমনও নয়। তারপরও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ছিল কিছুটা স্বস্তির। তাছাড়া এই উদ্যানের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আমাদের বিজয়-সংগ্রামের ইতিহাস। উদ্যানের গাছ কাটার মধ্য দিয়ে সেই ইতিহাসের মূলেও কুঠারাঘাত করা হচ্ছে।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ কাটাকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। গণমাধ্যমেও এ বিষয়ে লেখালেখি হচ্ছে। বৃক্ষপ্রেমীরা গাছ কাটার বিরুদ্ধে উদ্যানে নেমে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কিন্তু তাতে কর্তৃপক্ষের টনক নড়বে কিনা জানি না। তাছাড়া ঐতিহাসিক এই স্থানের গাছ কেটে কি উন্নয়ন ও সৌন্দর্যবর্ধন হবে তা আমাদের বোধগম্য নয়। গাছ রেখে কি সৌন্দর্যবর্ধন ও স্থাপনা নির্মাণ করা যেত না! আমার মনে হয় অবশ্যই যেত। তবে বর্তমান গাছকাটার ঠুনকো যুক্তি ও উৎসব দেখে মনে হচ্ছে গাছ নিয়ে আমাদের এক শ্রেণির মানুষ বিপদে পড়েছেন। গাছ তাদের গলার কাঁটা! এখন তারা সেই কাঁটা সরিয়ে ফেলতে চাইছেন।
উদ্যানের সাইনবোর্ডের তথ্যানুসারে সেখানে বড় করে লেখা রয়েছে: ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থাপনা শীর্ষক প্রকল্পের কাজ চলছে’। স্থাপত্য অধিদপ্তর থেকে দেওয়া নকশা অনুযায়ী উদ্যানের মধ্যে সাতটি রেস্টুরেন্ট তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। স্থাপনা নির্মাণের জন্য এসব গাছ কাটা হচ্ছে। ইতোমধ্যে অনেক গাছ কাটাও হয়েছে। ২০০৯ সালের ৮ জুলাই স্বাধীনতা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত স্থান, বধ্যভূমিসহ সংশ্লিষ্ঠ ঐতিহাসিক স্থান সংরক্ষণে রায় দিয়েছিলেন সরকার। সেই রায়ের ধারাবাহিকতায় এই গাছ কেটে রেস্টুরেন্ট নির্মাণের কাজ চলছে। পাশাপাশি নির্মাণ হবে থিম পার্ক, ৫৭০টি গাড়ি রাখার ভূগর্ভস্থ পার্কিং, লাইট এন্ড সাউন্ড শো, ফোয়ারাসহ অন্যান্য (তথ্যসূত্র : ৬ মে, ২০২১, সমকাল)।
১৬১০ সালে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে ঢাকা নগরী প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এই উদ্যান (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) গড়ে ওঠে। বর্তমানে রাজধানী ঢাকার প্রায় দুই কোটি মানুষের ‘ফুসফুস’ হিসেবে এই উদ্যানের পরিচিতি রয়েছে। বলাবাহুল্য এই পরিচিতির কারণ উদ্যানের বহুবর্ষী পুরনো গাছ। এই বৃক্ষরাজির সঙ্গে যেমন আমাদের ইতিহাস জড়িত, ঠিক তেমনিভাবে অনেক পশুপাখির আবাসস্থল এটি। উদ্যানটির আগে নাম ছিল রেসকোর্স ময়দান। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্থানটির নামকরণ করেছিলেন প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নামানুসারে- সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। এবারে আসি এই উদ্যান আমাদের জাতীয় জীবনের কী কী ইতিহাস বহন করে সেই আলোচনায়।
১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধু এই উদ্যান থেকেই প্রথমবারের মতো ঘোষণা দিয়েছিলেন এই ভূ-খণ্ডের নাম হবে ‘বাংলাদেশ’। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি এই উদ্যানেই বঙ্গবন্ধু জেল থেকে মুক্তি পেলে এক নাগরিক সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। সেদিন শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন তৎকালীন ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ তৎকালীন ডাকসু ছাত্রনেতা আ.স.ম. আব্দুর রব বঙ্গবন্ধুকে ‘জাতির জনক’ উপাধিতে ভূষিত করেন এক জনসভায় এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসকি ভাষণ দিয়েছিলেন এই উদ্যানে দাঁড়িয়েই। যে ভাষণ বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ ও উদ্বুদ্ধ করেছিল স্বাধীনতার জন্য। সেই ভাষণ এখন বিশ্ব ঐতিহ্যের সম্পদ।
এই উদ্যানেই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল। বিশ্বে বাংলাদেশ নামক একটা রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল সেদিন। পাকিস্তানের শোষণ থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন বঙ্গবন্ধু। এই উদ্যানেই সেদিন তিনি ভাষণ দিয়েছিলেন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ অনুষ্ঠিত এক বিরাট জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বক্তব্য রেখেছিলেন। এই উদ্যানের একপাশেই রয়েছে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সমাধী। ১৯৯৯ সালে এই উদ্যানে তৈরি করা হয় ‘শিখা চিরন্তন’।
ঐতিহ্যের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ইতিহাস আমাদের উজ্জীবিত করে। এই জায়গাটিতেই রয়েছে আমাদের শিকড়, সংগ্রাম ও মুক্তি অর্জনের ইতিহাস। এমন একটি জায়গায় হঠাৎ করে ৭টি রেস্টুরেন্ট আমাদের ঐতিহ্যকে কীভাবে সমৃদ্ধ করবে বোধগম্য নয়। তাছাড়া সৌন্দর্যবর্ধন যদি করতেই হয় গাছ কেটে নয়, গাছ রেখেই করা উচিত। যাই হোক, শুরুতে বলছিলাম করোনাসৃষ্ট পরিস্থিতির কথা। এমন দুর্দিনেও আমরা যদি গাছের প্রয়োজনীয়তা না বুঝি তবে আর কবে বুঝবো?
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক
ঢাকা/তারা