কোয়াড নিয়ে চীন এত উদ্বিগ্ন কেন?
গত ১০ মে বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং সাংবাদিকদের সঙ্গে ভার্চুয়াল মতবিনিময়ের সময় বলেন— যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার কৌশলগত জোট কোয়াডকে চীনবিরোধী একটি ছোট গোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করে বেইজিং। তাই চীন মনে করে, এতে যেকোনোভাবে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ ঢাকা-বেইজিং সম্পর্ক ‘যথেষ্ট খারাপ’ করবে।
লি জিমিং-এর এ মন্তব্য ছিল অনভিপ্রেত এবং কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত। বাংলাদেশ এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে।
কিন্তু কথা হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলছে, কোয়াড একটি ‘অনানুষ্ঠানিক, অপরিহার্য ও বহুপাক্ষিক প্রক্রিয়া’। এর লক্ষ্য ‘অবাধ ও মুক্ত ভারতীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল’ গঠন। সেটাই যদি হয়, তাহলে চীনের এত উদ্বেগ কেন?
এর আগে কোয়াডের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক। ‘কোয়াড্রিলেটেরাল সিকিউরিটি ডায়ালগ’ বা চতুর্ভুজীয় নিরাপত্তা সংলাপকে সংক্ষেপে কোয়াড বলা হয়। মূলত, ২০০৪ সালে সুনামির পর প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো পারস্পরিক সহযোগিতার বন্ধন তৈরির অভাব অনুভব করে। এর প্রেক্ষিত ২০০৭ সালে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজু আবে এক সংলাপ আহ্বান করেন। তাতে অংশ নেন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি, অষ্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী জন হাওয়ার্ড এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। যুক্তরাষ্ট্রের ভাষ্যমতে, প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সমমনা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহকে নিয়ে সে একটি জোট গঠন করেছে।
কোয়াড জন্মের পর থেকে বেশির ভাগ সময়ই ঘুমিয়ে কাটিয়েছে। কাজের মধ্যে কাজ হয়েছে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সামরিক মহড়া ‘এক্সরাসাইজ মালাবরে’। অষ্ট্রেলিয়া, জাপান ও সিঙ্গাপুর যুক্ত হয়েছে ২০১৫ সাল থেকে। ২০১৬ সালে জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শিনজু আবে ‘অবাধ ও মুক্ত ভারতীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল’ গঠনের আহ্বান জানালে যুক্তরাষ্ট্রও এগিয়ে আসে। মূলত তখন থেকে কোয়াড আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
২০১৭ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর তার চীন বিরোধী নীতির কারণে এ উদ্যোগে নতুন হাওয়া লাগে। কিন্তু ট্রাম্পের অর্থনৈতিক কৌশল এর বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায়। তার নীতি ছিল সহযোগী রাষ্ট্রগুলোও প্রতিরক্ষা ব্যয় সমানভাবে বহন করবে। এর আওতায় দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানে মোতায়েনরত সৈন্যদের ব্যয়স্বরূপ দেশগুলো প্রদেয় অর্থ ৪ গুণ বাড়িয়ে দেওয়ার ঘোষণা দেন ট্রাম্প। এর ফলে উল্লিখিত দু’টো দেশের যুক্তরাষ্ট্রকে বাড়তি আরো কয়েক বিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে।
উল্লেখ্য, বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়ায় সাড়ে ২৮ হাজার ও জাপানে ৫৫ হাজার মার্কিন সৈন্য রয়েছে। এ ঘোষণার কারণে জাপান যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে ফাটল ধরে।
পরবর্তী সময়ে জন বাইডেন ক্ষমতায় এসে আবার এশীয় মিত্রদের কাছে টেনে নেওয়ার জন্য এসব ব্যাপারে শৈথিল্য দেখান। নিরাপত্তা ভাগাভাগি করে নেওয়ার একটি ফ্রেমওয়ার্কও তৈরি করা হয়। বাইডেনের এশীয় মিত্রদের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগে আবার প্রাণ পায় কোয়াড। এ বছরের ১২ মার্চ যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান ও অষ্ট্রেলিয়ার সরকার প্রধানরা এক ভার্চুয়াল সম্মেলনে একত্রিত হন।
এই সামিটে কোভিড-১৯ ছিল মূল আলোচনার বিষয়। কোভিডের ভ্যাকসিনকে নিয়ে চীনের আগ্রাসন রুখে দিতে চার দেশ মিলে একটি উদ্যোগ গ্রহণ করে। এতে ভারত ১ বিলিয়ন সিংগুল ডোজ ভ্যাকসিন তৈরি করবে। এর জন্য যুক্তরাষ্ট্র কারিগরি, জাপান আর্থিক ও অষ্ট্রেলিয়া লজিস্টিক সাপোর্ট দেবে। এই বিপুল পরিমাণ ভ্যাকসিন ‘আসিয়ান’ জোটভুক্ত দেশগুলোকে দেওয়া হবে।
সম্মেলনে মহাসাগরীয় নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা করা হয়। বিশেষ করে পূর্ব এবং দক্ষিণ চীন সাগরে ক্রমবর্ধমান ঝুঁকিকে বিবেচনায় আনা হয়।
এছাড়া উত্তর কোরিয়ার পরমাণু অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণ ও মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থানের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
এসব প্রকাশ্য ঘোষণার বাইরেও অষ্ট্রেলিয়া, জাপান ও ভারত চিনবিরোধী জোট গঠন করেই ক্ষান্ত হতে চায় না, তারা চায় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীন যে আগ্রাসন চালাচ্ছে তা রুখে দিতে যুক্তরাষ্ট্রকে সাহায্য করতে।
কোয়াডকে আপাতদৃষ্টিতে নির্জীব মনে হলেও এর একটি অন্তঃসলিলা প্রবাহ আছে। সম্প্রতি মিয়ানমারে চৈনিক জনগোষ্ঠীর ওপর আক্রমণ এবং জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে ছোট ছোট বিদ্রোহী দলগুলো একাট্টা হওয়ার পেছনে ভারতের হাত আছে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে প্রক্সি যুদ্ধে নেমেছে ভারত। ভারতের পরবর্তী গন্তব্য হচ্ছে ভিয়েতনাম। বাংলাদেশে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনকে হটিয়ে জাপানের প্রবেশও এখানে উল্লেখযোগ্য একটি বিষয়। নরেন্দ্র মোদীর ভাষ্যমতে, কোয়াড আঞ্চলিক ভারসাম্য রক্ষায় একটি খুঁটিঁর কাজ করবে।
সাধারণ শত্রুকে সামনে রেখে এই জোট গঠিত হলেও এর ভবিষ্যৎ নিয়ে বিশ্লেষকরা খুব একটা আশাবাদী নন। একে ‘এশিয়ার ন্যাটো’ বলা হলেও, ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো যে ঐতিহাসিক বাস্তবতায় একত্রিত হয়েছে এবং এদের যে একটি সাধারণ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য আছে সেটা কোয়োডে নেই। বরং ভৌগোলিক বিচ্ছন্নতা একটা বিরাট সমস্যা।
যুক্তরাষ্ট্র সমমনা গণতান্ত্রিক দেশগুলোর জোট বললেও এ অঞ্চলের উত্তম গণতান্ত্রিক দেশ বলে পরিচিত নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ কোরিয়া এ উদ্যোগ থেকে দূরে আছে। আবার ভবিষ্যতে সৌদি আরবকে এ উদ্যোগে সংযুক্ত করার কথা শোনা যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বক্তব্য কী হবে স্পষ্ট নয়।
আরেকটি বিষয়, একমাত্র যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া কারোরই চীনের মুখোমুখি হওয়ার হিম্মত নেই। এর প্রধান কারণ অর্থনৈতিক। অষ্ট্রেলিয়ার বৈদেশিক বাণিজ্যের ৩০ শতাংশ হয় চীনের সঙ্গে। অষ্ট্রেলিয়া ৪০ শতাংশ পণ্য চীনে রপ্তানি করে। একই অবস্থা জাপানেরও। জাপানের এক পঞ্চমাংশ রপ্তানি হয় চীনে। ভারতের সঙ্গে চীনের দীর্ঘদিনের সীমান্ত বৈরিতা থাকার পরও চীনই ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য সহযোগী। তারপরই রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। মজার ব্যাপার, পরের দুটো দেশের সঙ্গে মোট বাণিজ্য চীনের চেয়ে কম।
ভিয়েতনাম, ফিলিপাইনস, ইন্দোনেশিয়ার মতো যুক্তরাষ্ট্রের কাছের বন্ধুদের নিষ্ক্রিয়তা চীনের জন্য বেশ স্বস্তির বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু চীন যেভাবে দিন দিন এশিয়া ও আফ্রিকায় তার অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য বিস্তার করছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্র ও অপরাপর তিনটি দেশ তাদের বাজার দখলের জন্য এ রকম জোট গঠন করা ছাড়া উপায় ছিল না। চীন ঋণের ফাঁদে ইতোমধ্যে আফ্রিকা ও শ্রীলংকার অনেক বন্দর দখল করে নিয়েছে। পাকিস্তানেও সে একটি শক্ত অবস্থান নিয়েছে। গাওদার বন্দরকে কেন্দ্র করে চীন পাকিস্তানে দেড় হাজার কিলোমিটার লম্বা নতুন রাস্তা করে। এর মাধ্যমে চীনের ভূবেষ্টিত দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল থেকে সহজেই আরব সাগর আসা যাচ্ছে। চীন সাগরে তার আগ্রসান নীতির কারণে জাপান ও তাইওয়ান কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। এমন অবস্থায় উত্তরণের পথ তারাও খুঁজছিল।
কিন্তু এই বৃহৎ শক্তিগুলোর মল্লযুদ্ধে বাংলাদেশ এসে গেল কেন? আসলে বাংলাদেশ এখন কৌশলগতভাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থিত। চীন ও ভারত বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে তাদের ভূবেষ্টিত জনপদে সহজে বন্দর সংযোগ স্থাপন করতে পারে। এছাড়া বঙ্গোপসাগর চীনের তেল সরবরাহের প্রধান রুট। এর নিরাপত্তা বিধানের জন্য বাংলাদেশ একটা বিরাট বিষয়। বাংলাদেশের দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও প্রলুব্ধ হওয়ার মতো।
অনেকে বলছেন চীনের জুজু সামনে রেখে অস্ত্র বিক্রিই যুক্তরাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য। চীনের হুমকি মোকাবিলা করার জন্য ভারত ২০২০ সালে ২৫০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৩০ টি ড্রোন কিনেছে। এছাড়া ৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র শস্ত্র কিনেছে। অষ্ট্রেলিয়া ও জাপানেরও অস্ত্র ক্রয়ের প্রধান উৎস যুক্তরাষ্ট্র।
চীন ৪০ বিলিয়ন ডলারের বিশাল বিনিয়োগ পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছে। ইতোমধ্যে সে অর্ধেক ব্যয় করেছে। বাকি অর্ধেক ব্যয় করার জন্য সেও মরিয়া থাকবে। ফলে সামনে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চল পরাশক্তিদের কুরুক্ষেত্র হয়ে দাঁড়ায় কিনা তাই দেখার বিষয়।
তবে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই। এই ভারতই একসময় চীনের সঙ্গে জোট বেঁধে ‘ব্রিক’ গঠন করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের ডলারের আগ্রাসন রুখে দেওয়ার জন্য। এখন সেই বিপরীত অবস্থানে। রাশিয়া কোন দিকে ঝুঁকে তাই দেখার বিষয় এখন।
সূত্র: টাইম ডট কম, ফিনিসিয়াল এক্সপ্রেস ও এনডিটিভি।
ঢাকা/মারুফ