খ্যাতিই কি সাকিবের ক্ষতি করছে?
আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ। বোলার দেশের জনপ্রিয়তম ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান। আবাহনীর অধিনায়ক মুশফিকুর রহিমের বিরুদ্ধে লেগ বিফোর দ্য উইকেটের আবেদনে সাড়া দিলেন না আম্পায়ার। এসব ক্ষেত্রে আম্পায়ারের কাছে বড়জোর ব্যাখ্যা দাবি করে ক্রিকেটাররা, হয়তো সেটা তর্কেও পরিণত হয় অনেক সময়। কিন্তু সাকিব আল হাসান আবেদন করে খুব বেশি অপেক্ষা করলেন না! প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই স্ট্যাম্পে লাথি মারলেন। ক্রিকেটীয় পরিভাষায় যদি বলা যায়, তাহলে বলতে হয় প্রিমেডিটেটেড বিহেভিয়ার বা পূর্বেই ঠিক করে রাখা আচরণ। অর্থাৎ সাকিব কি কোনো কারণে আম্পায়ারের উপর বিরক্ত ছিলেন, যে কারণে মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলেন আম্পায়ারের কোনো দোষ পেলেই এমন আচরণ করবেন?
একজন বোলারের আরাধ্য হলো স্ট্যাম্প। অর্থাৎ উইকেট। এই স্ট্যাম্প তার কাছে পবিত্র হওয়ার কথা। সাধারণত বিশেষ ম্যাচের স্ট্যাম্প কিন্তু ক্রিকেটাররা অনেকটা অনুনয় করে হলেও সংগ্রহে রাখার চেষ্টা করেন। সুতরাং সেই স্ট্যাম্পে লাথি মারা কিন্তু নিজের ক্যারিয়ার বা পেশাকেই এক অর্থে লাথি মারা। ভদ্রলোকের খেলা ক্রিকেটে এই আচরণ কখনও কাম্য নয়। যে কারণে এই ঘটনার পর অনেক সাবেক অধিনায়কও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য সাকিব আল হাসানের এমন আচরণ নতুন নয়। আন্তর্জাতিক ম্যাচেও তিনি অধিনায়ক হিসেবে মেজাজ হারিয়েছেন। একবার দেশের মাঠে দর্শকদের সঙ্গে লেগে গিয়েছিল তাঁর। তাছাড়া নিয়ম না মানার আরও অনেক উদাহরণ তিনি তৈরি করেছেন। এমনকি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের অফিসিয়াল ফটোশেসনেও সময়মত না আসার অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে।
মেধাবী তরুণ প্রজন্ম যে কোনো দেশ বা জাতির জন্য অহঙ্কার। কেননা যা কিছু নতুন বা কঠিন তা অর্জন করার দায়িত্ব কিন্তু এই তরুণদের কাঁধেই বর্তায়। সাকিবের অর্জন নিয়ে সন্দেহ নেই। ক্রিকেট বিশ্বে তিনি পরিচিত ব্যক্তিত্ব। এনে দিয়েছেন অবিশ্বাস্য সব ব্যক্তিগত এবং দলীয় অর্জন। কিন্তু তারপরও তাঁকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হচ্ছে! এতগুলো আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার পরেও তিনি কেন মাঠে চাপ সামলাতে পারবেন না? বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডারের স্বীকৃতির পরেও তিনি কেন ক্রিকেটারের দায়িত্ব বুঝবেন না? নাকি অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস বা অহঙ্কার মনে বাসা বেঁধেছে। এর কারণ কি শুধুই জনপ্রিয়তা? জনপ্রিয় বলেই কি সাকিব মাঠের সবকিছুতেই নিজের কর্তৃত্ব দেখতে চাচ্ছেন? তাহলে তো ঘরোয়া ক্রিকেটের যে দিক নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ার একটি অংশ সাকিবের এহেন আচরণ সমর্থন করছেন, সেই ‘পক্ষপাতমূলক দৃষ্টি’ থেকে তিনি নিজেও রেহাই পাবেন না। তিনি যদি তাঁর জনপ্রিয়তাকে ঢাল করে আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করতে চান, তাহলে এটাও তো আনডিউ ইনফ্লুয়েন্স। অর্থাৎ ঘরোয়া ক্রিকেটের পাতানো ম্যাচ কিংবা বাজে আম্পায়ারিং নিয়ে যারা সোচ্চার তারা সাকিবের আচরণকে সমর্থন করছেন।
সাকিবের এমন আচরণ নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে
এখানে প্রশ্ন হলো, সাকিব কি প্রতিবাদ অন্য উপায়ে করতে পারতেন না? তিনি অন্তত শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ম্যাচে যেভাবে মাঠ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন, সেদিনও এমন করতে পারতেন। তাহলে অন্তত সাকিবকে অভদ্র বলা যেত না। শ্রীলঙ্কার কাণ্ডে সাকিবের ‘শ্রী’ না থাকলেও অভদ্রতা ছিল না। যদিও সেখানেও তাঁর অঙ্গভঙ্গি সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল। কিন্তু মাত্র ৫ মিনিটের ব্যবধানে স্ট্যাম্পে লাথি এবং স্ট্যাম্প তুলে আছাড় মারা সাকিবের অপরিপক্কতারই পরিচায়ক। সাকিবের আচরণ বুঝিয়ে দেয় ম্যাচ সংখ্যা বা ক্যারিয়ারের বয়স দিয়ে আসলেই আচরণ বিবেচনা করা যায় না।
পরিশেষে এটা বলাই যায়, তরুণ প্রজন্ম প্রতিভাবান হলেও তাদের ভেতর সম্মান দেওয়ার প্রবনতা কম। অথবা সিনিয়রদের কাছ থেকে শেখার আগ্রহও কম। আর এসব শিক্ষা কিন্তু প্রতিষ্ঠানের আগে পরিবারই দিয়ে থাকে। আর দেয় স্কুল। সেখানেই শেখানো হয়- দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য! তাই তরুণদের দায়িত্ব নিতে এগিয়ে আসতে হবে অগ্রজদের। তরুণদের আজকের এই প্ল্যাটফর্ম অগ্রজদের হাতে গড়া। সুতরাং খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছে গেলেই পেছনের ইতিহাস ভুলে যেতে নেই। মনে রাখতে হয়, পাবলিক ফিগারদের দায় আরো বেশি। কারণ শুধু দেশ না, বিশ্ব তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। তাদের বিরাট অর্জনে যেমন দেশের সম্মান, তেমনি সামান্য স্খলনে দেশের বিরাট ক্ষতি।
ঢাকা/তারা