ঢাকা     সোমবার   ০৬ জানুয়ারি ২০২৫ ||  পৌষ ২৩ ১৪৩১

কোয়াড জোটে বাংলাদেশের লাভ-ক্ষতি

হাসান তারিক চৌধুরী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:৩১, ১৮ জুন ২০২১  
কোয়াড জোটে বাংলাদেশের লাভ-ক্ষতি

এ সময় ‘কোয়াড’ নামে একটি চারদেশীয় জোটে বাংলাদেশের যোগদান উচিত কি অনুচিত তা নিয়ে গনমাধ্যমসমূহ বেশ সরগরম হয়ে উঠেছে। চীন এই জোটকে ব্যাপক সমালোচনা করেছে এবং এর উদ্দ্যেশ্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে। তারা নানাভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছে নিজেদের সামরিক অভিলাষ পূরণের উদ্দেশ্যেই গঠিত হয়েছে এ কোয়াড জোট।

অন্যদিকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান মিত্র রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ এই জোটকে ‘এশিয়ার ন্যাটো’ আখ্যা দিয়ে এর তীব্র সমালোচনা করেছেন। বাংলাদেশের এবং বিদেশের বিভিন্ন ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়া নিয়মিত এই কোয়াড নিয়ে নানা খবর প্রকাশ করছে। এসব খবরের ভিড়ে নানা রাজনৈতিক উস্কানির দাপটে বাংলাদেশের স্বার্থের প্রসঙ্গটি প্রায় হারিয়ে যাবার উপক্রম। সঙ্গত কারণেই এখন বিবেচনা করার সময় এসেছে, এশিয়ার ন্যাটো কথার মানে কী? ন্যাটো বর্তমান দুনিয়ায় শান্তি নাকি অশান্তির কারণ? অপরদিকে, বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক পরাশক্তি চীনকে বাদ দিয়ে যদি কোনো এশিয়ান জোট গঠিত হয়, আর সে জোটে যদি বাংলাদেশ শামিল হয়, তাহলে সেটা দেশের বিরাট উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে কিনা?

কোয়াড নিয়ে কর্পোরেট মিডিয়ার নানা কারসাজি সত্ত্বেও দেশপ্রেমিক বাংলাদেশী নাগরিকদের দায়িত্ব কোয়াড জোটে নিজের দেশের স্বার্থ কতোখানি সেদিকে নজর রাখা। সে নজরদারি না রাখতে পারলে আধিপত্যবাদি বিদেশী শক্তি অনায়াসেই বাংলাদেশকে নিজেদের ভূ-রাজনৈতিক খেলার পুতুলে পরিণত করবে। একইসঙ্গে বাংলাদেশকে কার্যত নিজেদের নয়া-উপনিবেশে পরিণত করবে। বাংলাদেশে বিদেশী সেনাঘাঁটি জন্ম নেয়াও অস্বাভাবিক কিছু হবে না। ফলে এক্ষেত্রে প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মীদের বিশেষ দেশপ্রেমিক দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। কারণ, দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতি সে দায়িত্ব পালনের বদলে নিজেদের শ্রেণী চরিত্রের কারণে বিদেশী আধিপত্যবাদী শক্তির কাছে সহজেই নতি স্বীকার করতে পারে। এর বিনিময়ে তাদের লুটপাটের ধারা, কানাডা কিংবা মালয়েশিয়ায় বেগমপাড়া তৈরির প্রক্রিয়া আরও জোরদার হবে।

সবাই জানে, কোয়াড জোটে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত। শক্তির ভারসাম্যের হিসাবে সঙ্গত কারণেই এ জোটের মাতব্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যদিও এ জোটের আনুষ্ঠানিক ঘোষণায় বলা হয়েছে, “স্বাধীন এবং মুক্ত প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল এবং নিয়মতান্ত্রিক সমুদ্রগামিতার অধিকার রক্ষা” এর লক্ষ্য। ভারতের সামরিক বাহিনীর প্রধান এম এম নারাভানে যদিও বলেছেন কোয়াড জোট নিয়ে ভয় পাওয়ায় কিছু নেই। এটি শান্তির লক্ষ্যেই কাজ করবে। কিন্তু, বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা।

শান্তি ও সহযোগিতার ললিত বাণীর পাশাপাশি এই কোয়াড জোট ক্রমশঃই এক ভয়ানক সামরিক অক্ষশক্তিতে পরিণত হচ্ছে। যা কি না বাংলাদেশ এবং সমগ্র এশিয়া অঞ্চলের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের জন্য বিরাট হুমকি স্বরূপ। দক্ষিন এশিয়ার অনেক কূটনীতিক এবং বিশেষজ্ঞ কোয়াড জোট নিয়ে যে রকম উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তা থেকে এই হুমকির ব্যাপারটি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ভারতের বিখ্যাত কূটনীতিক শ্রী মহারাজা কৃষ্ণ রাশগোত্র তাই যথার্থই বলেছেন, মার্কিন নেতৃত্বে এইসব জোট এ অঞ্চলে “এশিয়ান শতাব্দী” সৃষ্টির বদলে “এশিয়ায় মার্কিন শতাব্দীর” জন্ম দেবে। কোয়াড জোটের নানা শীর্ষ বৈঠক ও সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্য এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নানা তৎপরতা থেকে এখন একটি বিষয় অতি স্পষ্ট যে, এই কোয়াড জোট পুরোপুরিভাবেই একটি ভয়ানক ধরনের সামরিক জোট। এ অঞ্চলে উক্ত চারটি দেশের সামরিক আধিপত্য চিরস্থায়ী করা এবং চীনকে ঘিরে ফেলার সামরিক কৌশলের পরিণতিই হলো এই জোট।

এই জোটের জন্মের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করলেই এর আধিপত্যবাদী এবং আগ্রাসী চেহারাটি ফুটে ওঠে। ২০০৭ সালে মার্কিন প্রশাসনের বিশ্বস্ত এশিয় মিত্র জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মিঃ শিনজো আবে’র উদ্যোগে এই জোটের সূচনা। পর্দার সামনে জাপানী প্রধানমন্ত্রী আবেকে রাখা হলেও এর মূল কারিগর ছিলো মার্কিন সামরিক চক্র। এ প্রক্রিয়ার অন্যান্য কুশীলবরা ছিলেন যথাক্রমে মার্কিনের কুখ্যাত যুদ্ধবাজ রাজনীতিক তৎকালীন মার্কিন উপরাষ্ট্রপতি মি. ডিক চেনী, অস্ট্রেলিয়ার সেসময়ের প্রধানমন্ত্রী জন হাওয়ার্ড এবং ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং। সে সময় একদিকে চলছিল কোয়াডের বৈঠক এবং অপরদিকে চলছিল মার্কিন সশস্ত্রবাহিনীর নেতৃত্বে কোয়াডের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর যৌথ সামরিক মহড়া। যার নাম দেয়া হয়েছিলো, ‘মালাবার মহড়া’। 

শুধু এই মালাবার মহড়াই নয়, অস্ট্রেলিয়ার উপর ভর করে মার্কিন মেরিন সেনারা অস্ট্রেলিয়ার ডারউইন অঞ্চলে প্রবেশ করে এবং সেখান থেকে তিমোর সাগরে এবং লম্বুক প্রণালীর উপর সামরিক তৎপরতা চালায়। এরপর এই জোটের বিরুদ্ধে নানা সমালোচনা শুরু হয়। বিশেষ করে ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার শান্তি আন্দোলনের কর্মীরা এই জোটের বিরুদ্ধে বিরাট প্রচারনা চালায়। তারপর এই জোটের সংলাপ প্রক্রিয়া কিছুদিন স্তিমিত থাকে। ২০১৭ সালে ফিলিপাইনের ম্যানিলায় আসিয়ান সম্মেলনের সময় তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প, জাপানের শিনজো আবে, ভারতের নরেন্দ্র মোদী এবং অস্ট্রেলিয়ার ম্যালকম টার্নবুলের নেতৃত্বে এই কোয়াড প্রক্রিয়ার পুনঃজাগরণ ঘটানো হয়। বাস্তবিক অর্থে এটি ছিলো, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ‘এশিয়ায় সামরিক প্রভাব বৃদ্ধিকরণ’ নীতির সম্প্রসারিত নীতির অংশ। যার প্রধান প্রতিপক্ষ হলো, চীন। 

যে কারণে, বিভিন্ন সামরিক বিশ্লেষকগণ একে এক “নয়া স্নায়ুযুদ্ধ” বলে অভিহিত করেছেন। ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় জো বাইডেন অধিষ্ঠিত হবার পর এই কোয়াড জোট প্রক্রিয়ার বিশেষ কোনো হেরফের হয় নি। বরং একই বছর মার্চ মাসের ১২ তারিখ কোয়াড জোটের যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। হোয়াইট হাউস থেকে প্রচারিত কোয়াডের এই যৌথ বিবৃতিতে স্পস্ট করেই বলা হয়, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে কোয়াডের আসল উদ্দ্যেশ্য কী? এই বিবৃতিতে করোনা অতিমারি মোকাবিলায় কোয়াড জোটের সদস্য দেশগুলোর দৃঢ় প্রত্যয়ের কথ বেশি করে বলা হলেও দুনিয়ার মানুষ সাক্ষী ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়কার মার্কিন প্রশাসন কীভাবে সারা দুনিয়ায় করোনা মোকাবিলার ক্ষেত্রে বাঁধার সৃষ্টি করেছে। করোনা মোকাবিলার জন্য কিউবার মেডিক্যাল টিম ও মানবিক সাহায্যের বিমান মার্কিন বাঁধার সম্মুখীন হয়েছিল। করোনা অতিমারির সৃষ্টির জন্য চীনকে দায়ী করে জঘন্য এক রাজনীতির সূচনা করেছিল তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যার ফলশ্রুতিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাসচিব ড. টেড্রস আধানম ঘেব্রেইয়েসাস তখন মার্কিন প্রেসিডেন্টকে রোগ নিয়ে রাজনীতি না করার জন্য আহবান জানিয়েছিলেন। এক পর্যায়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বের হয়ে যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই করুণ ইতিহাস সকলেরই জানা। 

অন্যদিকে, ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউটের উৎপাদিত করোনার টীকা নিয়ে ভারতের বর্তমান হিন্দু জঙ্গিবাদী মোদী সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে কী পরিমাণ অসহযোগিতা করছে দক্ষিণ এশিয়ার পত্র-পত্রিকাগুলো তার সাক্ষী। বাংলাদেশ করোনার টীকার জন্য ভারতকে টাকা দিয়েও চুক্তি অনুযায়ী টীকা পাচ্ছে না। এমনকি ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল অভিযোগ করছে দুর্নীতিতে নিমজ্জিত মোদী সরকার করোনা মোকাবিলার বদলে নিজের গদি রক্ষায় বেশি টাকা খরচ করতে ব্যস্ত রয়েছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, গত ১২ মার্চ আমেরিকার হোয়াইট হাউস থেকে কোয়াডের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো ‘দ্য স্পিরিট অফ দ্য কোয়াড’ নামের যে যৌথ বিবৃতিতে করোনা মোকাবিলায় যে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে, শুরুতে নিজেরাই সে অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছে। 

অপরদিকে, চীন নিজ দেশে সফলভাবে করোনা অতিমারি মোকাবিলা করেছে। পাশাপাশি সারা দুনিয়ায় এবং বাংলাদেশে দফায় দফায় মানবিক সাহায্য ও বিশেষজ্ঞ দল পাঠিয়েছে। বর্তমানে চীন বাংলাদেশে ৫০ মিলিয়ন ডোজ করোনার টীকা সরবরাহের প্রক্রিয়াও শুরু করেছে। ফলে খুব সঙ্গত কারণেই বিবেচনা করা দরকার, করোনা মোকাবিলায় চীনের টীকা বেশি জরুরি কিনা? নাকি কোয়াডের মতো মার্কিন নেতৃত্বাধীন ছদ্মবেশী সামরিক জোটের চামচা হয়ে বাংলাদেশের বিরাট উন্নয়ন অংশীদার চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব নষ্ট করা জরুরি?

এ কথা ঠিক যে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে চীন আমাদের স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিল এবং পাক-মার্কিন হানাদারদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। কিন্তু আজকের পরিস্থিতি ভিন্ন। চীন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের এক উল্লেখযোগ্য অংশীদার। চীনের উদ্যোগে শুরু হওয়া ওয়ান বেল্ট-ওয়ান রুট এবং এশিয় অবকাঠামোগত বিনিয়োগ ব্যাংকে বাংলাদেশ যুক্ত হয়েছে। চীনের সহযোগিতা পেলে রোহিঙ্গা শরণার্থী সঙ্কটের মতো বিরাট অর্থনৈতিক চাপ থেকে বাংলাদেশ মুক্ত হতে পারে। গত এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশ সফর করে রাষ্ট্রপতি এডভোকেট আব্দুল হামিদ সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাত শেষে চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জেনারেল ওয়েই ফেঙ্গে একই মত ব্যক্ত করে গেছেন। সুতরাং বাংলাদেশের স্বার্থ কোয়াডে কতখানি রয়েছে সহজেই অনুমেয়। 

সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, রাষ্ট্রীয় সংবিধান এবং পররাষ্ট্র নীতির সঙ্গে কোয়াডে সম্পৃক্ততা সাংঘর্ষিক বলে বিবেচিত হবে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রের যে পররাষ্ট্রনীতি বর্ণিত হয়েছে তা কোয়াডের মতো জোটে যাওয়ার বিপক্ষে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল- পরাশক্তির বাইরে থেকে জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাই ছিলেন, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন বা ন্যাম-এর সোচ্চার কণ্ঠ। আজকের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কতটা বঙ্গবন্ধুর জোট নিরপেক্ষ পথে থাকবে আর কতটা সাম্রাজ্যবাদ আর আধিপত্যবাদের অনুগামী হয়- সেটাই এখন দেখার বিষয়। 

লেখক: আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক, বিশ্ব গণতান্ত্রিক আইনজীবী পরিষদের সম্পাদক এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী   
                               
 

ঢাকা/তারা


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়