ঢাকা     সোমবার   ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ১ ১৪৩১

আশুরা অবিস্মরণীয় বরকতময় এবং মর্যাদাপূর্ণ দিন

মাওলানা মুনীরুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:১৪, ২০ আগস্ট ২০২১   আপডেট: ১২:১৪, ২০ আগস্ট ২০২১
আশুরা অবিস্মরণীয় বরকতময় এবং মর্যাদাপূর্ণ দিন

আরবি ‘আশারা’ শব্দ থেকে ‘আশুরা’র উৎপত্তি। আশারা অর্থ দশ, আর আশুরা অর্থ দশম দিবস। তাই হিজরি সালের প্রথম মাস মহররমের দশম দিবসকে আশুরা বলা হয়।

পবিত্র আশুরা মুসলিম ঐতিহ্যে অনেক বরকতপূর্ণ এবং বিভিন্নভাবে অবিস্মরণীয়। ইসলামপূর্ব যুগেও এই দিন অনেক মর্যাদাপূর্ণভাবে পালন করা হতো। এই দিনে শুধু কারবালা প্রান্তরের হৃদয়বিদারক উপাখ্যান এবং নবী দৌহিত্র হজরত হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর শাহাদাত বরণের ঘটনাই ঘটেনি, বরং সৃষ্টির সূচনা থেকে এই দিনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যময় ঘটনা সংঘটিত হয়েছে।

সাহাবায়ে কেরাম একদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে জানতে চাইলেন, আশুরা এত বেশি তাৎপর্যময় হওয়ার কারণ কী?
আল্লাহর রাসুল বললেন, আল্লাহ তায়ালা আশুরার দিন নভোমণ্ডল সৃষ্টি করেছেন। লওহ-কলম, নদ-নদী সৃষ্টি করেছেন। আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করেছেন, তাঁকে বেহেশতে প্রবেশ করিয়েছিলেন এবং এই দিনেই তাঁর দোয়া কবুল হয়েছিল।

আল্লাহর রাসুল মদিনায় এসে দেখলেন, ইহুদিরা ১০ মহররম রোজা রাখছে। আল্লাহর রাসুল তাদের রোজা রাখার কারণ জানলেন, এই দিনে হযরত মুসা আলাইহিস সালাম সিনাই পাহাড়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাওরাত লাভ করেন। এই দিনেই তিনি বনি ইসরাইলকে ফেরাউনের জুলুম থেকে উদ্ধার করে নিয়ে লোহিত সাগর অতিক্রম করেন। আর ফেরাউন ওই সাগরে ডুবে মারা যায়। তারা মুসা আলাইহিস সালামের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের জন্য এই দিনকে বেছে নিয়েছে।

আল্লাহর রাসুল ভাবলেন, মুসা আলাইহিস সালামের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ। তাই তিনি ওই দিনই রোজা রাখলেন এবং সাহাবিদেরও রোজা রাখতে বললেন। তবে ইহুদিদের থেকে আলাদা করার জন্য ১০ মহররমের আগে পরে একটি রোজা বাড়িয়ে দুটি রোজা রাখতে বললেন। (মুসলিম : ১৯১৮)

মহররম মাসে নফল রোজা রাখার সওয়াব অন্য সব নফল রোজার চেয়ে বেশি। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘রমজানের রোজার পর সর্বোত্তম রোজা হচ্ছে আল্লাহর মাস মহররমের রোজা।’ (মুসলিম : ১৯৮৯) আবু কাতাদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহুর সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আশুরার একদিনের রোজার ব্যাপারে আমি আল্লাহ তায়ালার দরবারে আশা রাখি যে, বিগত এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেবেন।’ (মুসলিম : ১৯৮৩ )

প্রতি বছর আশুরা এলে কারবালার ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমাদের সমাজে অনেক ধরনের কুসংস্কার দেখা যায়। তার মধ্যে মাতম মর্সিয়া গাওয়া অন্যতম। মর্সিয়া অর্থ, নবী দৌহিত্র হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর শোক প্রকাশে নিজের শরীরে আঘাত করা, রক্তাক্ত করা, জামা-কাপড় ছিঁড়ে ফেলা ইত্যাদি। এগুলো সবই ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ড। আল্লাহর রাসুল এ ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি [শোকে-দুঃখে] চেহারায় চপোটাঘাত করে, জামার বুক ছিঁড়ে  ফেলে এবং জাহেলি যুগের মতো হায়-হুতাশ করে, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ (বুখারি : ১২৯৭)

নিম্নে আশুরার দিন সংঘটিত কিছু ঐতিহাসিক ও তাৎপর্যময় ঘটনার তালিকা দেওয়া হলো: 
১। পবিত্র আশুরার দিনে আল্লাহ তায়ালা সাগর, পাহাড়, প্রাণীকুল, আসমান-জমিন ও লওহ-কলম সৃষ্টি করেন।
২। আল্লাহ তায়ালা আরশে আজিমে সমাসীন হন।
৩। আল্লাহ তায়ালা আদি পিতা হজরত আদম আলাইহিস সালামকে তাঁর খলিফা নিযুক্ত করেন এবং তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করান।
৪। আদম আলাইহিস সালাম ও হাওয়া আলাইহাস সালামের ভুলের কারণে পৃথিবীতে নির্বাসনের পর আরাফার ময়দানে তাঁদের দু’জনের পরিচয় করান এবং এই দিনেই দীর্ঘ দিন ক্ষমা প্রার্থনা শেষে দু’জনের তাওবা কবুল করেন।
৫। পৃথিবীর প্রথম হত্যাকাণ্ড হাবিল কাবিলের ঘটনা সংঘটিত হয়।
৬। হজরত নুহ আলাইহিস সালাম সদলবলে মহাপ্লাবন শেষে জুদি পাহাড়ে অবতরণ করে পৃথিবীকে নতুন করে সাজিয়ে তোলেন।
৭। আল্লাহ তায়ালা হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করেন।
৮। ইবরাহিম আলাইহিস সালামের প্রিয়পুত্র ইসমাঈল আলাইহিস সালামকে আল্লাহর জন্য কোরবানি করেন।
৯। আবার এই দিনেই হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম ক্ষমতাশালী মূর্তিপূজারী নমরুদের অগ্নিকাণ্ড থেকে উদ্ধার হন।
১০। হজরত আইয়ুব আলাইহিস সালাম কুষ্ঠরোগ থেকে আরোগ্য লাভ করেন।
১১। হজরত দাউদ আলাইহিস সালামের গুনাহ মাফ হয়।
১২। মারিয়াম আলাইহাস সালামের গর্ভ থেকে হজরত ঈসা আলাইহিস সালামের পৃথিবীতে আগমন ঘটে।
১৩। হজরত আছিয়া শিশুপুত্র মুসা আলাইহিস সালামকে এই দিনই ফেরত পান।
১৪। হজরত মুসা আলাইহিস সালাম সিনাই পাহাড়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাওরাত লাভ করেন।
১৫। মুসা আলাইহিস সালাম তৎকালীন মিসরের বাদশাহ ফেরাউনের নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে পড়লে এই দিনে তিনি বনি ইসরাইলকে সঙ্গে নিয়ে নীল নদ পার হয়ে যান, আর নদীর মাঝপথে পানি চাপা পড়ে ফেরাউনের সলিল সমাধি ঘটে।
১৬। হজরত ঈসা আলাইহিস সালামকে আল্লাহ তায়ালা নিজ করুণায় এই দিনে আসমানে তুলে নেন।
১৭। এই দিনই রহমতস্বরূপ আসমান থেকে প্রথম বৃষ্টি নামে।
১৮। এই দিনে কারবালা প্রান্তরে ইসলামের ইতিহাসের মর্মান্তিক ঘটনা সংঘটিত হয়।
 (বুখারি : ১৯০০, মুসলিম : ২৬৫৩, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ১/১৩২, আল কামেল ফিত তারিখ : ১/১২২, উসদুল গাবাহ : ১/২১)

আশুরা সর্বাধিক প্রসিদ্ধ ৬১ হিজরির আশুরাতে কারবালা প্রান্তরে ফোরাত নদীর তীরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রিয় দৌহিত্র ইমাম হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু সপরিবারে শাহাদাত লাভের ঘটনার জন্য। হজরত ইমাম হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু হক ও ইনসাফ চলমান রাখার লক্ষ্যে কারবালা প্রান্তরে ত্যাগের অপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। যুগ যুগ ধরে যা মানুষকে ন্যায় ও সত্য সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রেরণা যুগিয়ে যাবে।

সেই দিন ইমাম হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু ও তাঁর ৭২ জন সঙ্গীকে কারবালার প্রান্তরে ইয়াজিদ বাহিনি অত্যন্ত নির্মমভাবে শহীদ করেছিল। এ জন্য এই দিনটি মুসলিম জাতির কাছে যেমন বেদনার বার্তা বয়ে নিয়ে আসে, তেমনি সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে জীবনযাত্রার আশার আলোও সঞ্চারিত করে।

হজরত হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন অসাধারণ ঈমানি চরিত্রের অধিকারী। তিনি দৃঢ়চেতা ও আপসহীন মনোভাব পোষণ করতেন। খেলাফতে রাশেদার পুনর্জীবনের গভীর আবেগে তিনি সংকল্পবদ্ধ হয়েছিলেন। তিনি বলতেন, ‘লাঞ্ছনা ও অপমান সহ্য করার চেয়ে মৃত্যুই ভালো।’ প্রতি বছর আশুরা এসে ত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত হতে সেই সংবাদই আমাদেরকে দিয়ে যায়।

লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম
 

ঢাকা/তারা


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়