ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ১১ ১৪৩১

তালেবানের প্রত্যাবর্তনে বাংলাদেশকে সতর্ক থাকতে হবে

মর্তুজা হাসান সৈকত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৪৭, ২৩ আগস্ট ২০২১  
তালেবানের প্রত্যাবর্তনে বাংলাদেশকে সতর্ক থাকতে হবে

দুই দশকের সামরিক উপস্থিতির অবসান ঘটানোর মার্কিন সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর আফগানিস্তানে পুনরায় তালেবানের উত্থান ঘটতে যাচ্ছে- এটা অনুমিতই ছিল। কিন্তু সেটা যে এতো দ্রুত ঘটবে, তা হয়তো অনেকেই ভাবেননি। ২০০১ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর অভিযানের মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানের ক্ষমতা থেকে উৎখাত হয়েছিল যে গোষ্ঠী, গত বেশ কিছু দিনের সামরিক অভিযানে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় তারাই এখন আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।

তালেবানরা অবশ্য তাদের পুনরুত্থানের জানান দিচ্ছিল বেশ ক’বছর আগে থেকেই। গত জুলাই মাসের ২ তারিখ কাবুল থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বাগরাম বিমানঘাঁটি মার্কিনিরা ত্যাগ করার পরই মূলত কাবুলের পতন স্পষ্ট হয়ে যায়। মার্কিন সেনারা ওই ঘাঁটি থেকে তালেবান ও জঙ্গিদের বিরুদ্ধে বিমান হামলা পরিচালনা করতো।

আফগানিস্তানের শাসনক্ষমতা পুনরায় যখন তালেবানের হাতে যাচ্ছে, তখন সামনের দিনগুলোতে কী অপেক্ষা করছে- এটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে এসেছে। কারণ, অতীতের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিলে বলা যায়, আফগানিস্তান দক্ষিণ এশিয়ায় সহিংস উগ্রবাদের নতুন কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে। এর আগে ১৯৯৬ সালে তালেবান যখন ক্ষমতা গ্রহণ করে, তখনই বিশ্ব তাদের শাসনের বিভৎস রূপ দেখেছিল। ওই সময় তালেবান সরকার আফগানিস্তানে মানবাধিকারের কোনো তোয়াক্কা করেনি, তারা নারী শিক্ষা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছিল। দেশে কোনো বিচার ব্যবস্থা ছিল না। তাছাড়া সে সময় দেশটিতে ভিন্নমত ও ভিন্ন ধর্মও চরমভাবে আক্রান্ত হয়েছে।

আরো পড়ুন:

অন্যদিকে, আফগান ফেরত ও তালেবান মতাদর্শে উদ্বুদ্ধরা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও একটা সর্বনাশা প্রভাব ফেলে। সেটা যে কতটা ভয়ঙ্কর তার একটা তিক্ত অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের রয়েছে। বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের ব্যাপক প্রচার ও প্রসার হয় আফগান জিহাদ ফেরত যোদ্ধাদের মাধ্যমে। বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে পাকিস্তান আর আফগানিস্তান থেকে বাংলাদেশে এই তালেবানপন্থী জঙ্গিদের ব্যাপকভাবে অনুপ্রবেশ ঘটে। হরকাতুল জিহাদ জেএমবিসহ জঙ্গিনেতাদের আফগান যোগের বিষয়টি মিডিয়ায় প্রচার পায়। দেশে ফিরেই তারা রাজনৈতিক সন্ত্রাস চালায়৷ তখন তাদের স্লোগান ছিল ‘আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান।’ একটা সময় বাংলাদেশেও তারা তালেবান শাসন কায়েমের রঙিন স্বপ্ন দেখেছে। কথায় কথায় মুক্তবুদ্ধির লোকেদের গলা কেটেছে। শেখ হাসিনা সরকারের বড় একটা সময় এই জঙ্গিদের প্রতিহত করতে কেটেছে।

একটা সময় বাংলাদেশ থেকে জঙ্গি মতাদর্শীদের আফগানিস্তানে যাওয়ার প্রবণতা থাকলেও মধ্যপ্রাচ্যে আইএস-এর উত্থানের পর গন্তব্য ঘুরে হয়ে যায় সিরিয়া-ইরাক। কিন্তু আইএস-এর পতনের কয়েক বছর পর তালেবানের পুনরুত্থানে আগের চিত্রই ফিরে আসার খবর মিলছে। অতীতের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে তালেবানের শাসন উপমহাদেশ তথা বাংলাদেশে কী ধরনের প্রভাব ফেলে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

আমরা এরই মধ্যে দেখেছি যে, বাংলাদেশ থেকে বেশ কিছু তরুণ আফগানিস্তান গিয়েছে। আবার পুলিশের তৎপরতার কারণে আফগানিস্তানে যাওয়ার পরিকল্পনার পর্যায়ে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারও হয়েছে এমনও রয়েছে বেশ কয়েকজন। কাজেই নতুন করে যোগাযোগের যে ক্ষেত্র স্থাপন হচ্ছে, সেটা সম্পূর্ণ পরিষ্কার। বাংলাদেশ থেকে আফগানিস্তানে যাওয়ার এই খবর উদ্বেগজনক। এই সংবাদের পাশাপাশি তালেবানের আগের শাসনামলের জঙ্গিবাদকে হিসেবে রাখলে বলা যায়, এবারও নতুন করে মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ায় হুমকি তৈরি হবে।

যেহেতু বাংলাদেশের জঙ্গি পরিস্থিতির সঙ্গে আফগানিস্তানের তালেবানের সরাসরি যুক্ততা ও প্রভাব রয়েছে ফলে বাংলাদেশের জন্য দুশ্চিন্তা থেকেই যায়। এ কারণেই কাবুলে তালেবানের ক্ষমতা দখলের বিষয়টিকে উদ্বেগ ও শঙ্কার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন। অন্যদিকে, আফগানিস্তানে তালেবানের নতুন করে ক্ষমতা দখল একটি গোষ্ঠীকে আবার নতুন করে উজ্জীবিত করতে পারে। মিয়ানমার থেকে আগত রোহিঙ্গাদের নিয়ে এমনিতেই বাংলাদেশ সংকটে রয়েছে। এর সঙ্গে আফগানিস্তানে তালেবানের উত্থানও নতুন সংকট তৈরি করতে পারে। কারণ যেসব রোহিঙ্গা তরুণ ক্যাম্পগুলোতে অবস্থান করছেন, তাদের মধ্যে নিশ্চিতভাবেই কট্টর মতবাদে বিশ্বাসী অনেকেই আছেন। তালেবানের বিজয় তারা কীভাবে দেখছেন, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া এই ক্যাম্পগুলোয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ খুব শিথিল।

বিশ বছর পর তালেবানের এই উত্থানের পেছনে মোটাদাগে সহযোগিতা করেছে দুটি বড় দেশ চীন এবং রাশিয়া; পেছনে থেকে কলকাঠি নেড়েছে পাকিস্তান। আফগানিস্তানের এই দ্রুত পট পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় সুফল সম্ভবত এই দেশটিই ঘরে তুলবে। দেশটি আগাগোড়াই তালেবানের পাশে আছে। তারা যদি এভাবে পাশে না থাকতো, তাহলে তালেবানরা এই অবিশ্বাস্য ঝড়ের গতিতে সামরিকভাবে অগ্রসর হতে পারত কিনা প্রশ্ন রয়েছে। মূলত, পাকিস্তান থেকে প্রাপ্ত অর্থ ও অস্ত্রের জোরেই তালেবানরা দ্রুত শক্তিশালী বাহিনী হিসেবে গড়ে উঠেছিল এবং যে যাই বলুক আসল কথা হচ্ছে, এখনও তালেবান জঙ্গিদের শক্তির প্রধান উৎস এই দেশটি।

পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আরেকটি বড় অভিযোগ হচ্ছে, দেশটি আফগানিস্তানের তালেবান ও তাদের মিত্র হাক্কানি নেটওয়ার্ককে পাকিস্তানে ‘নিভৃত আবাস’ গড়ে তোলার সুযোগ করে দিয়েছিল। তাছাড়া সরকারি নীতি যাই হোক, তালেবানদের সঙ্গে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই’র যোগাযোগ বরাবরই ছিল এবং আছে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার পর আল-কায়েদার আশ্রয়-প্রশ্রয়দানকারী তালেবান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সরকার সামরিক অভিযান পরিচালনা করে। অথচ দেখা গেলো বহু বছর পর বিন লাদেন লুকিয়ে আছে পাকিস্তানের একটি সামরিক আবাসিক এলাকায়।

অন্যদিকে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ভেতরের একটি অংশ জঙ্গিদের হয়ে কাজ করছে বলেই সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের জোর বিশ্বাস। বিশেষ করে বিন লাদেন পাকিস্তানের একটি সামরিক আবাসিক এলাকাতে বছরের পর বছর নিরাপদে বসবাস করার পর সেই বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়েছে। অন্যদিকে, তালেবানদেরও অবাধ যাতায়াত রয়েছে পাকিস্তানে।

আফগানিস্তানের সঙ্গে পাকিস্তানের এই সখ্য কাশ্মিরে প্রভাব ফেলতে পারে। সশস্ত্র কর্মকাণ্ড বেড়ে যেতে পারে সেখানে। অনেকের মতে, তালেবান এবং পাকিস্তান–সমর্থিত গোষ্ঠীগুলো আবার কাশ্মীরে সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। আফগান-সোভিয়েত যুদ্ধে সোভিয়েতের পরাজয়ের পরপরই জম্মু-কাশ্মীরে ভারতবিরোধী কর্মকাণ্ডে পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী মুজাহিদীনদের যেভাবে কৌশলগত শক্তি হিসেবে ব্যবহার শুরু করেছিলো, ঠিক একইভাবে এখন তালেবান জঙ্গিদেরও ব্যবহার করতে পারে। ভারত অবশ্য তালেবানের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। তবে তাদের এ উদ্যোগ কতটুকু সফল হবে, সেটা এক বড় প্রশ্ন।

আফগানিস্তানের ক্ষমতা ফের তালেবানের দখলে নেওয়া কেবল উপমহাদেশের জন্যই নয়, বিশ্বের জন্য উদ্বেগ উৎকণ্ঠা ও পর্যবেক্ষণের বিষয়। দেশের প্রায় সব নিরাপত্তা বিশ্লেষকই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এ উদ্বেগ যুক্তিসংগত। বিশ্বের জঙ্গিরা তালেবানের এই জয়কে নিজেদের জয় হিসেবে দেখে উজ্জীবিত হওয়ার চেষ্টা করবে৷ বাংলাদেশও এই ঝুঁকি থেকে মুক্ত নয়৷ 

তবে বিগত বছরগুলোতে আমাদের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর সক্ষমতা অনেক বেড়েছে। কট্টরপন্থীদের নিয়ন্ত্রণে সরকারও উল্লেখযোগ্য সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে। তবে অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, তালেবানের শাসনের একটা সর্বনাশা প্রভাব আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে পড়তে পারে। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কোনো উগ্রবাদী গোষ্ঠী যেন পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে না উঠতে পারে সে ব্যাপারে আমাদের নীতিনির্ধারকদের সতর্ক থাকার পাশাপাশি একটা শক্তিশালী নিরাপত্তা কৌশলও বির্নিমাণ করতে হবে। 

লেখক: প্রাবন্ধিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
 

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত বিষয়:


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়