শেখ হাসিনার স্বদেশযাত্রা: কী ট্র্যাজিক কী মহাকাব্যিক: ২য় পর্ব
(পূর্ব প্রকাশের পর)
ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে যখন রক্তগঙ্গা বয়ে যাচ্ছে শেখ হাসিনা তখন ব্রাসেলসে। জার্মানিস্থ বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর বিশেষ আমন্ত্রণে তাঁর সফরসঙ্গী হিসেবে তিনি ছোটবোন রেহানাসহ সপরিবারে বেলজিয়ামে বেড়াতে এসেছিলেন ১৩ আগস্ট। ড. ওয়াজেদ লিখেছেন:৮
১৫ই আগস্ট সকালে আমাদের প্যারিসের উদ্দেশে রওনা দেয়ার কথা ছিল। এই কারণে ১৪ই আগস্ট রাতে (বেলজিয়ামস্থ বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত) সানাউল হক সাহেবের বাসায় আমাদের জন্যে আনুষ্ঠানিক ডিনারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।...১৫ই আগস্ট (১৯৭৫) শুক্রবার সকাল সাড়ে ছয়টায় ঘুম ভাঙে ম্যাডাম রাষ্ট্রদূতের ডাকে।
অল্পক্ষণের মধ্যেই সেই ভয়ঙ্কর সংবাদটি জেনে যান শেখ হাসিনা। (তবে সেটি ছিল ডুবোপাহাড়ের চূড়া মাত্র!) আর অভাবনীয় এক অনিশ্চিত যাত্রার সূচনালগ্নেই তাঁকে মুখোমুখি হতে হয় আরও এক কদর্য অভিজ্ঞতার- যা হয়ত আমৃত্যু তাঁকে তাড়িয়ে বেড়াবে। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে যে-মুখ বা মুখগুলি ছিল আবেগে-আন্তরিকতায়-আতিথেয়তার গদগদ, মুহূর্তে বদলে যায় সেইসব মুখের ভাষা ও ভঙ্গি। তবে সবাই অবশ্যই নয়। আর একেবারে নতুনও নয় এ অভিজ্ঞতা। বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি তিনি আগেও হয়েছেন বহুবার।৯
যখন স্কুলে ভর্তি হই, শিক্ষকরাও খুব আদর করতেন। (যুক্তফ্রন্ট সরকারের) মন্ত্রীর মেয়ে হিসেবে ভর্তি হয়েছি কদরটাই আলাদা ছিল। খুব আদর-যত্ন পেতাম। কিন্তু যেদিন থেকে আব্বা জেলে গেলেন, সেদিন থেকে সব বদলে গেল। আদর-যত্ন শেষ। সকলে ঠিক না, কয়েকজন শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রীর আচরণ কখনও ভুলতে পারব না। অন্য ক্লাসের শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রীরাও অহেতুক বকাঝকা করতেন। নানা কটুক্তি করতেন। স্কুলে যাওয়ার আগ্রহটাই হারিয়ে যেত। পড়াশোনায় মন বসত না। এ কষ্ট আমাদের সকলকেই পেতে হয়েছে। এমনকি পরবর্তীকালে আমাদের ছেলেমেয়েরাও এহেন আচরণের শিকার হয়েছে।
একদিকে পিতা-মাতা-ভাই-ভাবীসহ নিকটজন হারানোর অমোচনীয় ক্ষত, অন্যদিকে বদলে যাওয়া মুখগুলোর বীভৎস অভিজ্ঞতাকে সঙ্গী করে আদিঅন্তহীন এক অনিশ্চয়তার সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে ১৯৭৫-এর ২৫শে আগস্ট তাদের ‘হালভাঙা পাল ছেঁড়া’ জীবনতরী এসে ভেড়ে ভারতের রাজধানী দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে। মাঝখানে ১০টি দুঃসহ দিন কীভাবে কেটেছে তার মর্মস্পর্শী বিবরণ আছে ‘হাসিনা: এ ডটার’স টেল’ নামক পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রামাণ্যচিত্রে।১০ আমি সবাইকে সবিনয়ে সেটি দেখতে অনুরোধ করি। বিবরণ আছে এম. এ. ওয়াজেদ মিয়ার লেখা ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’১১ গ্রন্থেও। সেই কঠিন সময়ে যে মহানুভব মানুষটি অকৃত্রিম সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী:১২
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে পরিবারের ১৮ জন সদস্যসহ হত্যা করা হয়। আমরা দুবোন সে সময় জার্মানিতে ছিলাম। আমাদের দেশে ফিরতে বাধা দেওয়া হয়। ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী আমাদের ভারতে নিয়ে আসেন এবং আশ্রয় দেন।
ঢাকায় আসলে কী ঘটেছে তার সবটুকু তখনো তাদের জানা ছিল না। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতেই পুরো বিষয়টি প্রথম জানতে পারেন তাঁরা। তীব্র ঝড়ো বাতাসেও ক্ষীণ আশার যে-প্রদীপটি স্বজনহারা বিপন্ন এ বঙ্গকন্যার অন্তরের অন্তস্থলে তখনো মিটিমিটি জ্বলছিল সেটিও নিভে যায় দপ করে। কান্নায় ভেঙে পড়েন শেখ হাসিনা। শ্রীমতি গান্ধীই তখন তাঁকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন:১৩
তুমি যা হারিয়েছো তা আর কোনোভাবেই পূরণ করা যাবে না। তোমার একটি শিশু ছেলে ও মেয়ে রয়েছে। এখন থেকে তোমার ছেলেকেই তোমার আব্বা এবং মেয়েকে তোমার মা হিসেবে ভাবতে হবে। এ ছাড়াও তোমার ছোট বোন ও তোমার স্বামী রয়েছে তোমার সঙ্গে। এখন তোমার ছেলে-মেয়ে ও বোনকে মানুষ করার ভার তোমাকেই নিতে হবে। অতএব এখন তোমার কোনো অবস্থাতেই ভেঙে পড়লে চলবে না।
আরও একটি মানুষ নির্বাসিত নিরাশ্রয় জীবনে সার্বক্ষণিকভাবে বটবৃক্ষের ছায়া দিয়েছিলেন বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনাকে। তিনি হলেন ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী। সেসঙ্গে অনিবার্যভাবে এসে যায় এ বাংলার মেয়ে প্রণব মুখার্জীর স্ত্রী শ্রীমতী শুভ্রা মুখোপাধ্যায়ের নামটিও। শেখ হাসিনা লিখেছেন:১৪
স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে যখন আমরা হাহাকারময় জীবন কাটাচ্ছি, তখন এই পারিবারিক পরিবেশ, তাঁদের স্নেহের পরশ পাওয়াটা আমাদের জন্য অনেক স্বস্তির ছিল, মহামূল্যবান ছিল।
আশীর্বাদের এ হাত কখনোই অপসৃত হয়নি শেখ হাসিনার মাথার ওপর থেকে। দেশে ফিরে আসার পর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রুদ্ররোষে আবারও বিপন্ন হয়ে পড়ে তাঁর জীবন তখনো ভরসার বটবৃক্ষ ছায়া হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন ভারতীয় রাজনীতির সর্বজনশ্রদ্ধেয় এই ব্যক্তিত্ব।১৫
এ সময় প্রণব দাদা রেহানা এবং আমার ছেলেমেয়েদের খোঁজখবর নিতেন। তাদের সাহস ও সান্ত্বনা দিতেন। আমার মুক্তির ব্যাপারেও তিনি আন্তরিকভাবে প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। তাঁর অবদানের কথা সব সময়ই আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।
৬
অনুমান করা কঠিন নয় যে মাতৃস্বরূপা শ্রীমতী গান্ধীর কথাগুলোকে শিরোধার্য করেছিলেন শেখ হাসিনা। সর্বোপরি, বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে- রাজনীতির মাঠের নিবেদিতপ্রাণ কর্মী হিসেবে- তাঁর সারাজীবনের শিক্ষা তো ছিলই।১৬
আমি ম্যাট্রিক পাস করে কলেজে ভর্তি হই। কলেজ ইউনিয়নের ভাইস প্রেসিডেন্ট (ভিপি) পদে নির্বাচন করি। তখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও পূর্বপাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খাঁন এ নির্বাচনকে খুব গুরুত্ব সহকারে নেয়। আমি যাতে নির্বাচিত হতে না পারি সে প্রচেষ্টা চালায়। তাদের যুক্তি হলো ‘শেখ মুজিবের মেয়ে যদি নির্বাচনে জিতে যায়, তবে মানুষের মনে একটাই ধারণা হবে যে, ৬ দফার প্রতি জনগণের সমর্থন রয়েছে।’ একটা কলেজ ইলেকশন- সরকারি কলেজ তাই তাদের প্রচেষ্টা ছিল আমাকে নির্বাচনে পরাজিত করার। কিন্তু আমি বিপুলভাবে জয়লাভ করি।
সেই সাহস সেই অভিজ্ঞতাকে সম্বল করে জীবন বাজি রেখে প্রায় অর্ধযুগের অশ্রুসিক্ত নির্বাসন শেষে শেখ হাসিনা দেশে ফেরেন ১৯৮১ সালের ১৭ মে। লাখো জনতার হৃদয়ে জমে থাকা বিপুল বেদনা ও অপরিমেয় ভালোবাসার বৃষ্টিতে ভিজতে দেশের মাটিতে পা রেখেছিলেন তিনি। কিন্তু সেই প্রত্যাবর্তনও সহজ ছিল না। শেখ হাসিনা লিখেছেন:১৭
৬ বছর বাংলাদেশে ফিরতে পারি নাই। ১৯৮১ সালে যখন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আমাকে সভাপতি নির্বাচিত করে আমি অনেক বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করে দেশে ফিরে আসি।
শেখ হাসিনা যে ‘বাধা-বিঘ্ন’-এর কথা বলেছেন অনুচ্চ স্বরে, বাস্তবতা হলো, তার বিবরণ লিপিবদ্ধ করতে গেলে আরেকটি ‘বিষাদ সিন্ধু’ রচনা করতে হবে আমাদের। পাথরের মতো ভারী নির্বাসনের সেই দিনগুলো কীভাবে কেটেছে তা একমাত্র তিনিই জানেন। প্রথমে ছিলেন দিল্লির ডিফেন্স কলোনীর নিচতলার ছোট্ট একটি ফ্ল্যাটে। পরে তাদের ঠাঁই হয় ‘ইন্ডিয়া গেট’-এর নিকটবর্তী পান্ডারা রোডের দোতলা একটি সরকারি বাড়ির ওপরতলার দুই শয়নকক্ষের একটি ফ্ল্যাটে। নিরাপত্তাজনিত কারণে তাদের গতিবিধি ছিল একেবারেই নিয়ন্ত্রিত। গোপন করতে হয়েছিলে নিজেদের পরিচয়ও। শ্বাসরুদ্ধকর সেই দিনগুলোর কিছুটা বর্ণনা রয়েছে এম. এ. ওয়াজেদ মিয়ার লেখায়:১৮
...বাড়ির চত্বরের বাইরে না যাওয়া, সেখানকার কারোরও নিকট আমাদের পরিচয় না দেওয়া কিংবা দিল্লীর কারও সঙ্গে যোগাযোগ না করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিলো আমাদের সকলকে। অতএব, নিঃসঙ্গ অবস্থায় ঐ বাড়ির অতি ক্ষুদ্র চত্বরের মধ্যে আবদ্ধ থাকি আমরা সকলেই। আমি রাতে শুয়ে সারাক্ষণ জেগে থাকতাম এক রকম নিরাপত্তা প্রহরীর মতো। মাঝে মাঝে জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে বাইরের গেটের দিকে তাকাতাম। রাতে কয়েক ঘন্টা পর পর গেটে প্রহরারত দারোয়ানের সঙ্গে বাইরের লোকের ফিসফিস কথা বলা সন্দেহের উদ্রেক করতো।
একদিকে বহির্জগতের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা ও সর্বক্ষণিক উৎকণ্ঠা, অন্যদিকে ভারতীয় আণবিক শক্তি কমিশন প্রদত্ত ড. ওয়াজেদের পোস্ট ডক্টরাল ফেলোশিপের যৎসামান্য অর্থ দিয়ে যেভাবে সে দিনগুলো তিনি কাটিয়েছেন সেটা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ছাড়া আর কারও পক্ষে সম্ভব ছিল বলে মনে হয় না। সুবিদিত যে অবর্ণনীয় এ দুঃখভোগ ও কষ্টসহিষ্ণুতার শিক্ষা তিনি শৈশবেই পেয়েছিলেন পিতার কাছ থেকে। প্রিয় পাঠক, চলুন পাখির চোখে একবার দেখে আসা যাক বাংলাদেশ বদলে দেওয়া অনন্য মানুষটির সেই শৈশব।১৯
আমার বাবা শেখ মুজিবুর রহমান রাজনীতি করতেন। বেশিরভাগ সময় তাঁকে তখন জেলে আটকে রাখা হতো। আমি ও আমার ছোট ভাই কামাল মায়ের সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে দাদা-দাদির কাছে থাকতাম। আমার জন্মের সময় বাবা কলকাতায় পড়তেন, রাজনীতি করতেন। খবর পেয়েও দেখতে আসেন বেশ পরে।
ভাবুন তো একবার, প্রথম সন্তানের জন্ম হবে। বাবা যথাসময়ে উপস্থিতও থাকতে পারেননি! কী করছিলেন আপাদমস্তক মমতায় ভরা শেখ মুজিব নামের সেই মানুষটি তখন? তিনি তখন প্রথম সন্তানের মুখদর্শনের দুনির্বার আকর্ষণকে দমন করে উদয়াস্ত ছুটছিলেন কখনো কলকাতার দাঙ্গাপীড়িত মানুষকে বাঁচাতে, কখনো-বা দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের সেবায়। সেটা করতে গিয়ে তিনি নিজেও গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। কিন্তু কখনোই সংকল্পচ্যুত হননি। কী সেই সংকল্প? কী সেই ব্রত? সর্বজনবিদিত যে দুঃখী ও দুর্গত মানুষের সেবাকেই তিনি নিজের জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। আর সংকল্প করেছিলেন নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে ফোটাবেন। তাঁর কাছে আর সবই ছিলই তুচ্ছ।
বস্তত একটি-দুটি নয়, এমন অজস্র বেদনাবিধুর অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে বেড়ে উঠেছেন শেখ হাসিনা। ছোটভাই কামালের যখন জন্ম হয় বাবা তখন জেলে। বাবার গল্প শুনেছে, কিন্তু বাবা নামক মানুষটিকে না দেখেই কথা বলতে শিখে গেছে শিশুটি। শেখ হাসিনার মুখে সেই অভিজ্ঞতার বিবরণ শুনতে শুনতে আমাদেরও চোখ ভিজে আসে:২০
একবার একটা মামলা উপলক্ষে আব্বাকে গোপালগঞ্জ নিয়ে যাওয়া হয়। কামাল তখন অল্প অল্প কথা বলা শিখেছে। কিন্তু আব্বাকে ও কখনও দেখেনি, চেনেও না। আমি যখন বার বার আব্বার কাছে ছুটে যাচ্ছি ‘আব্বা আব্বা’ বলে ডাকছি ও শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে। গোপালগঞ্জ থানায় একটা বড় পুকুর আছে, যার পাশে বড় খোলা মাঠ। ঐ মাঠে আমরা দুই ভাইবোন খেলা করতাম ও ফড়িং ধরার জন্য ছুটে বেড়াতাম। আর মাঝে মাঝেই আব্বার কাছে ছুটে আসতাম। অনেক ফুল-পাতা কুড়িয়ে এনে থানার বারান্দায় কামালকে নিয়ে খেলতে বসেছি। ও হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘‘হাসু আপা তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি।” কামালের সেই কথা আজ যখন মনে পড়ে আমি তখন চোখের পানি রাখতে পারি না।
৭
মাত্র ৫৫ বছরের জীবন। তার মধ্যে প্রায় ১৫ বছরই কেটেছে কারাগারে। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির জন্ম হয়েছিল ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট। আর বঙ্গবন্ধুর জেলজীবন শুরু হয়েছিল ১৯৪৯ সালে। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয় তখনো তিনি কারাগারে। মাঝখানে দুবার ফাঁসিকাষ্ঠের সম্মুখীনও হতে হয়েছিল তাঁকে। একবার ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায়, দ্বিতীয়বার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালে। কবরও খোঁড়া হয়েছিল তাঁর চোখের সামনে। দুবারই আঁটঘাট বেঁধে ষড়যন্ত্র ফেঁদেছিল পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। জনজোয়ারে ও বিশ্ব জনমতের চাপে সব ভেসে গেলেও আসল ঝড়টি তো বয়ে গিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর পরিবারের ওপর। তার অর্থনৈতিক বিড়ম্বনার দিকটি হয়তো ব্যাখ্যাযোগ্য, কিন্তু এ কারণে শিশু-কিশোর বয়সী সন্তানদের উপর্যুপরি যে মানসিক ট্রমার মুখোমুখি হতে হয়েছিল তা ব্যাখ্যাতীত।
বাবা এক কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ঘরে আসেন যেন আরেক কারাগারে যাওয়ার জন্য! পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে জন্মের পর থেকেই শেখ হাসিনাকে দেখতে হয়েছে পুলিশি তা-ব। বলা বাহুল্য, সেই দুর্ভোগ সেই মানসিক নিপীড়ন কখনোই একা আসতো না, সঙ্গে নিয়ে আসতো আরও কিছু অনিবার্য উৎপীড়ন- যার অভিঘাত ছিল সুদূরপ্রসারী:২১
১৯৫৮ সালে আব্বাকে যখন গ্রেফতার করে নিয়ে যায় জামাল তখন সাড়ে তিন বছরের। রেহানা খুবই ছোট ছিল। কোনো কিছু সেভাবে বুঝতে পারত না। বিপুলসংখ্যক পুলিশ আমাদের বাড়ি ছেয়ে ফেলে এবং বাসা তল্লাশি করতে থাকে। সব জায়গায় তল্লাশি চালাতে থাকে। জিনিসপত্র তছনছ করে ফেলে। এতে ছোট দুই ভাইবোন খুব ভয় পেয়ে যায়। ...তারপর যে ঘটনা ঘটল তাতে আমাদের সকলের মানসিক কষ্ট আরও বাড়ল। মাত্র তিনদিনের নোটিশ দিয়ে আমাদের বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হলো। একদিকে পিতার স্নেহ বঞ্চিত হওয়া, অপরদিকে ঘরবাড়ি ছাড়া হয়ে যাওয়া। এর প্রভাব তো শিশুদের উপর পড়বেই।
শেখ হাসিনা পঁচাত্তরপরবর্তী কালে দেশে প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইটির ভূমিকা লিখতে গিয়ে কারাভ্যন্তরে তাঁর পিতার ওপর নিপীড়নের যে মর্মস্পর্শী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন প্রসঙ্গত সেটিও লক্ষ করা যেতে পারে:২২
দীর্ঘ কারাবাসের ফলে তাঁর (বঙ্গবন্ধুর) শরীর যে মাঝে মাঝে অসুস্থ হয়ে যেত তিনি সে কথা আমাদের কখনো জানতে দেন নাই। আমি এই ডায়েরিটা পড়বার পর অনেক অজানা কথা জানার সুযোগ পেয়েছি। ভীষণ কষ্ট হয় যখন দেখি অসুস্থ- সেবা করার কেউ নেই, কারাগারে একাকী বন্দি অর্থাৎ Solitary confinement. কখনো কোনো বন্দিকে এক সপ্তাহের বেশি একাকী রাখতে পারে না। যদি কেউ কোনো শাস্তি পায়, সেই শাস্তি হিসেবে এই এক সপ্তাহ রাখতে পারে। কিন্তু বিনা বিচারেই তাঁকে একাকী কারাগারে বন্দি করে রেখেছিল। তাঁর অপরাধ ছিল তিনি বাংলার মানুষের অধিকারের কথা বার বার বলেছেন।
(চলবে)
তথ্যসূত্র:
৮. এম. এ. ওয়াজেদ মিয়া, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ (ইউপিএল, ১৯৯৭), পৃষ্ঠা ২৪৪)
৯. শেখ হাসিনা, “অন্তরের রক্তক্ষরণ: একটি রাষ্ট্রের জন্ম”, ‘মুজিব বাংলার বাংলা মুজিবের’ প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৬৭
১০. পিপলু খান পরিচালিত শেখ হাসিনার জীবনভিত্তিক পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রামাণ্যচিত্র। ২০১৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রটি যৌথভাবে প্রযোজনা করেছে সিআরআই ও অ্যাপলবক্স।
১১. প্রাগুক্ত
১২. শেখ হাসিনা, “এ এক নতুন তীর্থযাত্রা: শান্তিনিকেতনে বাংলাদেশ ভবন”, ‘মুজিব বাংলার বাংলা মুজিবের’ প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৯৩
১৩. এম. এ. ওয়াজেদ মিয়া, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৫১-২৫২
১৪. শেখ হাসিনা, “প্রণব দাদা: বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু”, ‘মুজিব বাংলার বাংলা মুজিবের’, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৬১
১৫. ঐ, পৃষ্ঠা ৬৩
১৬. শেখ হাসিনা, “অন্তরের রক্তক্ষরণ: একটি রাষ্ট্রের জন্ম”, ঐ, পৃষ্ঠা ৭১-৭২
১৭. শেখ মুজিবুর রহমান, ‘কারাগারের রোজনামচা’, (বাংলা একাডেমি, ২০১৭), পৃষ্ঠা ১০
১৮. এম. এ. ওয়াজেদ মিয়া, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৫১
১৯. শেখ হাসিনা, “স্মৃতির দখিন দুয়ার-২”, ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৫৫
২০. শেখ হাসিনা, “শেখ মুজিব আমার পিতা”, ঐ, পৃষ্ঠা-৩০)
২১. শেখ হাসিনা, “অন্তরের রক্তক্ষরণ: একটি রাষ্ট্রের জন্ম”, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৬৯-৭০
২২. শেখ মুজিবুর রহমান, ‘কারাগারের রোজনামচা’, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৩
পড়ুন সূচনা পর্ব : শেখ হাসিনার স্বদেশযাত্রা: কী ট্র্যাজিক কী মহাকাব্যিক
ঢাকা/তারা