তিনিও অদম্য
অজয় দাশগুপ্ত, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক || রাইজিংবিডি.কম
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা পঁচাত্তর বছরে পা দিলেন। আর এ বছরটিই পালিত হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী। বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবর্ষ আমরা পালন করেছি গত বছর। এ বছরেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে ৪০ বছর পূর্ণ করেছেন তিনি।
১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনার জন্ম হয়েছিল গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মাস দেড়েক আগে— ১৪ আগস্ট। বঙ্গবন্ধু ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে লিখেছেন: ‘আব্বা, মা ও রেণুর সাথে কয়েকদিন থেকে সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকা এলাম।’ [পৃষ্ঠা ৮৩]
ঢাকা আসার অন্যতম কারণ ছিল ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠনের সভায় অংশগ্রহণ। এ সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে এমএ প্রথম বর্ষে ভর্তি হন।
শেখ হাসিনা বেড়ে ওঠার বছরগুলোতে পিতার সান্নিধ্য পাননি। বঙ্গবন্ধু হয় পাকিস্তানের জেলে দুঃসহ জীবন কাটাচ্ছেন কিংবা বাংলার পথে-প্রান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন জনগণকে জাগিয়ে তোলার জন্য অথবা মোকাবিলা করছেন একের পর এক মামলা। বাবার কাছে থাকার জন্য ৭ বছর বয়সে (১৯৫৪) মা ফজিলাতুন নেছা মুজিব এবং দুই ভাই কামাল ও জামালের সঙ্গে ঢাকা আসেন। কিন্তু ‘নতুন জীবন’ শুরু হতে না হতেই বঙ্গবন্ধু কারাগারে।
এখন অনেকেই শেখ হাসিনা সম্পর্কে বলবেন, সদা হাস্যোজ্জ্বল এক প্রাণময়ী নারী, পুরুষোত্তম পিতার সংগ্রামী আদর্শ আর সর্বংসহা মাতার অসীম ধৈর্য যার এগিয়ে যাওয়ার পুঁজি। কিন্তু এগিয়ে চলার পথ সহজ ছিল না তাঁর। কিন্তু পিতার মতোই অদম্য তিনি; সব বাধা জয় করেছেন দৃঢ়সংকল্পে।
চার দশক আগে শেখ হাসিনা যখন বঙ্গবন্ধুর দলের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখনও ১৫ আগস্টের রক্তের দাগ রয়ে গেছে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের ৮৭৭ নম্বর বাসভবনে। দায়িত্ব লাভের ঠিক তিন মাস পর তিনি ফেরেন প্রিয় স্বদেশে, মানিক মিয়া এভিনিউয়ের বিশাল প্রান্তরে বৃষ্টিস্নাত লাখ লাখ নারী-পুরুষের সমাবেশে অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে যখন বলেছিলেন: ‘সব হারিয়ে আপনাদের মাঝে ফিরে এসেছি’ তখন লাখ লাখ নারী-পুরুষের কান্নায় আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠেছিল।
১৯৮১ সালের ১৩-১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ইডেন হোটেলে বাংলাদেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন নতুন নেতৃত্বের জন্য। ক্ষমতায় স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমান। ১৯৭৯ সালের ৫ এপ্রিল জাতীয় সংসদে জিয়াউর রহমানের উদ্যাগে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বিল পাস হয়, যাতে খুনি মোশতাকের সামরিক আইন জারিসহ সব অবৈধ কাজের বৈধতা মেলে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচার করা যাবে না — এ জন্য আত্মস্বীকৃত খুনিদের দেওয়া হয় ইনডেমনিটি বা দায় মুক্তি।
শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ ছিল না। একটানা ৬ বছর ছিলেন নির্বাসিত জীবনে। সামরিক শাসকরা বঙ্গবন্ধুর পরিবারের বিরুদ্ধে নানা কুৎসা রটনা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভূলুণ্ঠিত। রাজনৈতিক অঙ্গনে জিয়াউর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যার সহযোগী আলবদর-রাজাকারদের দল জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগ পুনর্বাসিত। ১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, সৌদি আরব প্রভৃতি দেশ পাকিস্তানের বাঙালি নিধনযজ্ঞে সমর্থন দিয়েছিল। ১৫ আগস্টের পর তারা জিয়াউর রহমানের পাশে সমর্থন-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) অর্থনৈতিক ও সামাজিক নীতি নির্ধারণে কর্তৃত্বের ভূমিকায়। সে সময়ে বলা হতো — কোন খাতে কত কর বসবে, কোন জমিতে কী ফসলের চাষ হবে, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান — ব্যাংক-শিল্পকারখানা মালিকানা কোন ব্যক্তির হাতে যাবে সেটা নির্ধারণ করে দিত বিশ্বব্যাংক। এমনকি কোন দম্পত্তি কতটি সন্তান নেবে, সরকার সে নির্দেশনাও পেত বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে।
অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ বিপর্যস্ত। নেতৃত্বের মধ্যে নানা মত। একদল হাত মিলিয়েছে খুনি মোশতাক কিংবা জিয়াউর রহমানের সঙ্গে। সামরিক শাসকদের প্রলোভনের ফাঁদে তারা পা দিয়েছে। সামরিক ফরমান জারি হয়েছিল — বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের কথা কেউ বলতে পারবে না। এমনকি তাঁর নামও নেওয়া যাবে না। কিন্তু আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছিল নিবেদিতপ্রাণ কর্মীরা, যারা বঙ্গবন্ধুকে ভোলেনি, একাত্তরের চেতনা ভোলেনি। ১৫ আগস্টের পর সেই দুঃসময়ের দিনগুলোতে প্রতিবাদী ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকার সময় এর প্রমাণ পেয়েছি। বঙ্গবন্ধুকন্যা অবশ্যই এদের মনের কথা বুঝতে পেরেছিলেন — কিছু নেতাকে হয়ত বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে তোলার কাজে পাবেন না, কিন্তু কর্মী-সমর্থকরা থাকবে। তারাই গড়ে তুলবে দল।
তিনি ফিরে এলেন ১৭ মে, ১৯৮১। তখন বিমান বন্দর ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের পাশে, বর্তমান প্যারেড গ্রাউন্ড এলাকায়। সেখান থেকে মানিক মিয়া এভিনিউ পর্যন্ত এলাকা প্রবল বৃষ্টির মধ্যেও লোকে লোকারণ্য! জিয়াউর রহমান এবং তার দোসররা ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টিতে সব কিছু করেছে। ‘শেখ হাসিনার আগমন প্রতিরোধ কমিটি’ গঠিত হয়েছে। তারা কুৎসাপূর্ণ লিফলেট-পোস্টার বিতরণ করেছে। কিন্তু কোনো ষড়যন্ত্র কাজে আসেনি।
শেখ হাসিনা চরম ঝুঁকি নিয়েই এসেছিলেন। এ কারণে স্বামী ও দুই সন্তান এবং বোন শেখ রেহানা তাঁর সঙ্গী হতে পারেননি। আরও সমস্যা ছিল — কোথায় থাকবেন? ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাড়িটি জিয়াউর রহমান সরকারের দখলে। ১৭ মে সন্ধ্যায় মানিক মিয়া এভিনিউ-এর জনসভা শেষে সেখানে থাকা তো দূরের কথা, শ্রদ্ধা নিবেদন ও মিলাদ পড়ার জন্য পর্যন্ত যেতে পারেননি। পরের দিনগুলো তাঁর কেটেছিল অনেকটা উদ্বাস্তুর মতো — আজ এ বাসায় তো, কাল অন্য বাসায়। সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার মতো পরিবারের অভাব ছিল না। তবে সহজ-সরল জীবন যাপনে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন। বাবা-মা, দু’জনের কাছ থেকেই এ শিক্ষা পেয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালের প্রথম দিকে শেরে বাংলা নগরে নতুন গণভবন গড়ে তোলা হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন-অফিস হিসেবে। বঙ্গবন্ধু সেখানে অফিস শুরু করেন। কিন্তু বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব সেখানে থাকার প্রস্তাব নাকচ করে দেন। তিনি বলেন, ‘সরকারি ভবনের আরাম-আয়েশে প্রতিপালিত হলে ছেলেমেয়েদের মন-মানসিকতা ও আচার-আচরণে অহমিকাবোধ ও উন্নাসিক ধ্যান-ধারণা সৃষ্টি হবে। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছ থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।’ [ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ, পৃষ্ঠা ১৭৪]
কেমন জীবন কাটাতেন বঙ্গবন্ধুকন্যা, তার বিবরণ আমরা পাই এ গ্রন্থের ২৪৩ পৃষ্ঠায়। ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসের প্রথম দিকে (বঙ্গবন্ধু তখন রাষ্ট্রপতি, বাকশাল চেয়ারম্যান) ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া জার্মানিতে অবস্থান করছেন। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা রয়েছেন সেখানে। তিনি লিখেছেন: ‘এক বিকেলে হাসিনা, রেহানা ও বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে কার্লসরুয়ে শহরের প্রধান বিপণী কেন্দ্র পরিদর্শনে যাই। ...একটি জুতার দোকানে গিয়ে দেখি সেখানে হ্রাসকৃত মূল্যে জুতো পাওয়া যাচ্ছে। প্রত্যেকের জন্য জুতা নির্বাচন করার সময় হাসিনা জয়ের জুতার একই ডিজাইন ও রংয়ের এক জোড়া জুতা নেয় রাসেলের জন্য।’
একবার ভাবুন তো — জাতির পিতা ও রাষ্ট্রপতির কন্যা, খ্যাতিমান পদার্থবিজ্ঞানীর স্ত্রী পরিবারের সদস্যদের জন্য জুতা কিনছেন সস্তার দোকান থেকে, আমাদের হকাররা যেমন বলে, ‘হাফ দাম হাফ রেট’।
এই গ্রন্থ থেকে আমরা জানতে পারি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সেই অভিশপ্ত দিনের সপ্তাহ দুয়েক আগে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা যখন জার্মানি যান, তখন তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি পেয়েছিলেন ২৫ ডলার করে সঙ্গে নেওয়ার জন্য। [পৃষ্ঠা ২৪৭]
সেনাবাহিনী প্রধান এইচ এম এরশাদ ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সামরিক আইন জারি করে ক্ষমতা দখল করেন। তাকে গণতান্ত্রিক শক্তি চ্যালেঞ্জ করেছিল। সে সময়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৫ দল এবং খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ৭ দলীয় জোট সক্রিয় হয়। দেখা গেছে, শেখ হাসিনা জনসভা করছেন মানিক মিয়া এভিনিউয়ের বিশাল প্রাঙ্গণে এবং খালেদা জিয়ার সভাস্থল গুলিস্তান গোলাপ শাহের মাজার এলাকা। এরশাদবিরোধী হরতাল-মিছিল-সমাবেশে ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগ সামনের সারিতে। শেখ হাসিনাসহ ১৫ দলের নেতাদের ১৫ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার করে দীর্ঘদিন আটক রাখা হয়েছে ক্যান্টনমেন্টে। নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার তারা। খালেদা জিয়াও ক্যান্টনমেন্টে, তবে সেনাবাহিনী প্রধানের বাসভবনে — নিরাপদ ও আরামদায়ক জীবনে।
রাজপথে সক্রিয় হওয়ার পরবর্তী দিনগুলোতে শেখ হাসিনার পথ চলা সহজ ছিল না। দল কেবল গুছিয়ে তুলছেন। এ সময়েই ‘বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার নয়, আদর্শের উত্তরাধিকার’ —এ চটকদার স্লোগান দিয়ে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ বিভক্ত করা হয়। আওয়ামী লীগের কয়েকটি জেলা কমিটির প্রায় পুরোটাই চলে যায় ‘বাকশাল-এ’। স্বাধীনতার পর জাসদ ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের’ নামে ছাত্রলীগ ভাগ করেছিল। এক দশক পর গুছিয়ে ওঠা এ সংগঠনে আবার বিভাজন। নিষ্ঠাবান অনেক কর্মী হয়ে ওঠে প্রতিপক্ষ।
১৯৮৬ সালের ৭ মে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নেয়। খালেদা জিয়া নির্বাচন বর্জনের ডাক দেন। দেখা গেল, নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনের মধ্যে অন্তত ২০০ আসন দখল করতে চলেছে। এইচ এম এরশাদ প্রমাদ গোণেন। তিনি নির্বাচনের ফল স্থগিত করে দিয়ে পরে বেতার-টিভিতে মনমতো ফল ঘোষণা করেন, যা ভোট ডাকাতি ও মিডিয়া ক্যু’র নির্বাচন নামে পরিচিতি পায়। এইচ এম এরশাদ এ সময় পাশে পেয়েছেন খালেদা জিয়াকে।
নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানেও শেখ হাসিনা নেতৃত্বের আসনে। রাজপথের সভা-সমাবেশে তাঁর অনুসারীরাই প্রবলভাবে উপস্থিত। কিন্তু ১৯৯১ সালেল ২৭ ফেব্রুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফল যায় সামরিক ছাউনির সমর্থিত দল বিএনপির ঘরে, যদিও জনগণের বড় অংশের সমর্থন পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন এবং ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে এই জনসমর্থনের জোরেই তিনি ক্ষমতায় আসেন। তিনি প্রতিকূল সময়ে সাহস করে নৌকার হাল ধরেছিলেন এবং তার ফল পেয়েছেন। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির প্রহসনের নির্বাচনী ফল বাতিলের জন্য মার্চ মাসে পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলনে খালেদা জিয়া নতি স্বীকার করতে বাধ্য হন। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান আমলে বারবার সফল সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে স্বায়ত্তশাসনের যে ছয় দফা কর্মসূচি দিয়েছিলেন — মাত্র ৫ বছরের মধ্যেই তার বাস্তবায়ন ঘটেছিল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। শেখ হাসিনা চরম দুঃসময়ে আওয়ামী লীগের হাল ধরেছিলেন। খেলাধুলার ক্ষেত্রে যেমন বলা হয় ‘ভাঙাচোরা’ একটি দল — এই দলকে তিনি প্রবল পরাক্রমশালী দলে পরিণত করেন। একের পর এক সফল আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দেন।
অন্যদিকে, ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসেবে যে খালেদা জিয়াকে প্রতিষ্ঠার প্রাণান্ত চেষ্টা একটি মহল বিভিন্ন সময়ে চালিয়েছে, তার পাশে কিন্তু জনগণ দাঁড়ায়নি। বারবার তিনি চেষ্টা করেছেন শেখ হাসিনার সরকারকে ফেলে দিতে। কিন্তু শেষ বিচারে দেখা গেছে ‘গৃহকর্মী’ ফাতেমা ছাড়া কেউ নেই পাশে। ২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর তাঁর ‘মার্চ ফর ডেমোক্রাসি’ স্লোগানে এমনকি দলের স্ট্যান্ডিং কমিটির কোনো সদস্যও সাড়া দেননি। ২০১৫ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে তিনি অনির্দিষ্টকাল হরতাল-অবরোধ ডেকেছিলেন সরকারের পতনের দাবিতে, যা শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়। ২০১৩ সালের ৫ মে কিংবা ২০২১ সালের ২৬-২৭ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর অনুষ্ঠান ধর্মান্ধ চরমপন্থিদের সাহায্য নিয়ে ভণ্ডুল করার অপচেষ্টাতেও তিনি অসফল। তাঁর সংকল্প ছিল দৃঢ়, সন্দেহ নেই। কিন্তু জনগণকে পাশে পাননি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ। এটা যথার্থভাবেই বলা হয়, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্যই এ দলটির আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। দলটির দুর্বলতা নেই, ভুল করে না কিংবা স্বার্থান্বেষী-সুবিধাবাদীরা এ দলে ঠাঁই করে নেয়নি — এটা বলা যাবে না। দলের ভেতরে থেকেও একটি মহল অনেকটা নির্বিঘ্নে ষড়যন্ত্র করে যেতে পারে। কিন্তু নিবেদিতপ্রাণ অগণিত কর্মী-সমর্থক এ দলকে মাথায় তুলে রেখেছেন সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে। তারা যোগ্য নেতৃত্ব বেছে নিতে ভুল করেনি কখনও। ১৯৮১ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারিতে শেখ হাসিনার হাতে তারা যখন দলের নেতৃত্ব তুলে দেয় — হয়ত কারও কারও সংশয় ছিল — এত কম বয়স, অভিজ্ঞতা নেই — তিনি পারবেন তো! কেউ কেউ বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর দল নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। শেখ হাসিনা প্রমাণ করেছেন — তিনি কেবল দলকে নয়, দেশকেও যথাযোগ্য নেতৃত্ব দিতে পারেন। বিশ্বসমাজও অবাক বিস্ময়ে দখছে — উন্নত দেশসমূহ ও বিশ্বব্যাংক কর্তৃক তলাবিহীন ঝুড়ি কিংবা বাস্কেট কেস হিসেবে উপহাস করা স্বল্পোন্নত এবং সবার পিছে সবার নিচে থাকা দেশটি আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। এগিয়ে চলেছে উন্নত বিশ্বের সারিতে আসন গ্রহণের মহান লক্ষ্যে।
লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক
ঢাকা/তারা