তেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং অযৌক্তিক ধর্মঘট কার স্বার্থে
দেশে করোনা পরিস্থিতি বলতে গেলে এখন নিয়ন্ত্রণে। পণ্যের উৎপাদন এবং সরবারহ সবই স্বাভাবিক আছে, নেই কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগও। কিন্তু তারপরও বাড়ছে দ্রব্যমূল্য। নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের আমিষের জোগানের বড় উৎস আসে ডিম এবং ব্রয়লার মুরগি থেকে। অবস্থা এখন এমন হয়েছে যে, এগুলোও এখন নাগালের বাইরে। অতিধনী, ধনী এবং উচ্চ মধ্যবিত্তদের জীবনে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি তেমন কোনো প্রভাব না ফেললেও করোনার কষাঘাত সামলে ওঠা নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের কাছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।
এই পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করেছে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ঘোষণা। কোনো প্রকার পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই গত ৪ নভেম্বর আকস্মিকভাবে দেশে বহুল ব্যবহৃত জ্বালানি তেল ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। ফলে ভোগ্যপণ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও জনদুর্ভোগ বহুগুণে বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, জ্বালানি তেলের দামের বিষয়টি সরাসরি জনস্বার্থ তথা ব্যবসা-বাণিজ্য ও সামগ্রিক অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত। তেলের দাম বাড়লে বিদ্যুৎ ও পরিবহণ ব্যয় বেড়ে যায়। বৃদ্ধি পায় পণ্যের উৎপাদন মূল্য। বাজারে এর প্রভাব পড়ে সরাসরি।
অন্যদিকে, কৃষি পণ্য উৎপাদনে ডিজেলের ব্যবহার অপরিহার্য। বোরো মৌসুম চলছে। কিছুদিন পরেই সেচের প্রয়োজন হবে জমিতে। দেশে ধান উৎপাদনে মোট সেচের ৯৩ ভাগ সেচ প্রয়োজন বোরো মৌসুমে। এই সেচের জন্য ব্যবহৃত সেচ যন্ত্রের অধিকাংশ ডিজেল চালিত। ফলে এবার বোরো চাষের উৎপাদন ব্যয়ও বেড়ে যাবে অনেক। ফলশ্রুতিতে বাড়বে চালের দাম। তদুপরি, দেশের কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লান্টের অনেকগুলোতেই জ্বালানি হিসেবে ডিজেল ব্যবহার করে। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয়ও বৃদ্ধি পাবে। এর পাশাপাশি, কেরোসিনের অতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধি খেটে খাওয়া গবির মানুষের জীবন মানের ব্যয় বৃদ্ধি করবে। কারণ, দেশের প্রান্তিক জনপদের গরিব মানুষ মূলত কেরোসিন ব্যবহার করে। এই মূল্যবৃদ্ধি তাদের চলমান অভাব ও দুঃখ কষ্টকে আরও বাড়িয়ে দেবে। মোদ্দাকথা এই যে, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর এই সমস্ত ধকল সাধারণ মানুষের উপর দিয়েই যাবে।
করোনার কারণে দেশের মানুষের আয় ও ক্রয়ক্ষমতা কমলেও নিত্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। এ অবস্থায় জ্বালানি তেলের এই দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কারণ, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে বাড়বে পরিবহণ ব্যয়, বাড়বে পণ্যের উৎপাদন খরচ। তবে এতে উদ্যোক্তা বা পরিবহণ মালিকদের তেমন কোনো ক্ষতি হবে না। এর কারণ হচ্ছে, তারা ঠিকই দাম বাড়িয়ে নিজেদের খরচ সমন্বয় করে নেবেন। ফলে শেষ পর্যন্ত জ্বালানির এই মূল্যবৃদ্ধির খেসারত সাধারণ মানুষ কিংবা ক্রেতা-ভোক্তাকেই দিতে হবে। তাদেরকে আনুপাতিক হারের চেয়েও বেশি দামে পণ্য কিনতে হবে এবং সেবা নিতে হবে। যা আসলে জীবনযাত্রার ব্যয় অত্যধিক বৃদ্ধি ঘটাবে। ফলে নাভিশ্বাস উঠবে তাদের। তাছাড়া উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে দেশীয় পণ্য প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কার বিষয়টিও আমাদের মনে রাখতে হবে।
মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়তে থাকায় জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিপিসি প্রতিদিন ২১ কোটি টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে। তারা লোকসান কমানোর যুক্তি দেখিয়ে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে। কিন্তু কথা হচ্ছে, কিছুদিন গেলেই তো তেলের এই দাম ঊর্ধ্বমুখী থাকবে না। সরকার কি তখন দাম সমন্বয় করবে? করবে না। অতীত ইতিহাস বলে, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম অনেক কমে গেলেও অতীতের লোকসানের দোহাই তুলে দেশে তা আর সমন্বয় করা হয় না।
এ প্রসঙ্গে এখানে উল্লেখ্য যে, আন্তর্জাতিক বাজারে টানা বেশ কয়েক বছর জ্বালানি তেলের দাম কম ছিল। একপর্যায়ে অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৪০ ডলারেও নেমেছিল। সে সময় প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ অনেক দেশেই জ্বালানি তেলের দাম উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমানো হলেও আগের লোকসান পুষিয়ে নেওয়ার কথা বলে বাংলাদেশে তেলের দাম কমানো হয়নি। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমার সুফল থেকে বঞ্চিত হয়েছে দেশের ভোক্তারা। দু’একবার যা-ও কমানো হয়েছিল তাতে দাম বৃদ্ধির কারণে পরিবহণ ব্যয়, পণ্যের উৎপাদন খরচসহ যেসব খাতে ব্যয় বেড়ে গিয়েছিল পরবর্তী সময়ে তা আর কমানো যায়নি। তাই, জনজীবনের এই বিপর্যস্ত অবস্থায় সরকার ভর্তুকিটা অব্যাহত রাখতে পারতো। কারণ, যখন সরকারের সক্ষমতা অনেক কম ছিল তখনও বড় অঙ্কের ভর্তুকি দিয়ে বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ভূমিকা রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে শুক্রবার থেকে সারা দেশে বাস-ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান ধর্মঘট চলছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা গেছে, পরিবহন খাতের বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, ভাড়া বৃদ্ধি না করার ঘোষণা দেওয়ার আগ পর্যন্ত পরিবহন বন্ধ রাখা হবে। তারা ভাড়া ৫০ শতাংশ বৃদ্ধির দাবি তুলেছেন। অন্যদিকে, দেশের বিভিন্ন নৌপথে চলাচলকারী লঞ্চের ভাড়া দ্বিগুণ করতে চান লঞ্চ মালিকরা। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে ধর্মঘটের কথা বলা হলেও মূলত ধর্মঘট ডাকা হয়েছে ভাড়া বাড়ানোর দাবিতে। সব মিলিয়ে ইক্যুয়েশেন বলছে, জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির এই কোপটা শেষপর্যন্ত সাধারণ জনগণের উপরেই পড়ছে। এরই মধ্যে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে বাস ভাড়া ১০ থেকে ১৫ টাকা করে বেশি নেওয়া হচ্ছে। আশঙ্কা রয়েছে, কম্প্রেসড ন্যাচারাল গ্যাস বা সংকুচিত প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করে যেসব পরিবহণ চলে এই সুযোগে তারাও ভাড়া বাড়িয়ে নেবে। যদিও জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কমই।
বিগত কয়েক বছরে চাকরিজীবীদের বেতন এক টাকাও বাড়েনি। শ্রমজীবীদেরও বাড়েনি আয়। তার উপরে মহামারিকালে বেড়েছে দারিদ্র্যের হার। সম্প্রতি ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এবং পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) একটি যৌথ জরিপে জানানো হয়েছে, দেশে করোনাকালে ৩ কোটি ২৪ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। এর মধ্যে এ বছরের এপ্রিল মাস থেকে দেওয়া করোনা বিধিনিষেধের কারণে গত ছয় মাসে ৭৯ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়েছে। এমন একটি জটিল পরিস্থিতিতে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি জনজীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনমানের ধারা অবনমন করবে। তাই এ ক্রান্তিকালে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত থেকে সরকার সরে আসবে এটাই প্রত্যাশা। এতে দেশের অর্থনীতি ও জনগণই লাভবান হবে।
লেখকঃ প্রাবন্ধিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
ঢাকা/তারা