তেলের দাম কমাতে নাকি ভাড়া বাড়াতে এই ধর্মঘট
দীর্ঘ ৫ বছর পর দেশে বাড়লো ডিজেল ও কেরোসিনের দাম। তবে দাম বাড়ার প্রতিবাদে পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই গতকাল শুক্রবার থেকে পরিবহন ধর্মঘটে বিপাকে পড়েছে দেশ। ধর্মঘটে পণ্য পরিবহন চলাচল বন্ধে কেন্দ্রীয়ভাবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা থাকলেও গণপরিবহন বন্ধের বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা দিচ্ছেন না পরিবহন মালিক নেতারা। ধর্মঘট নিয়ে পরিবহন মালিক নেতাদের মধ্যে রয়েছে ভিন্ন মত। সরকারের পক্ষ থেকে সময় চাওয়া হলেও কয়েকটি পক্ষ ডিজেলের মূল্য কমানোর দাবি আদায় করতে ধর্মঘটকে কাজে লাগাতে চাচ্ছে। আবার কোনো পক্ষ পরিবহনের ভাড়া বাড়ানোতেই জোর দিচ্ছে। এ নিয়ে দ্বন্দ্ব চলার মধ্যেই জিম্মি হয়ে পড়েছেন সাধারণ যাত্রীরা।
তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই মূল্য বৃদ্ধি স্বল্প সময়ের জন্য, দাম কমে আসলে আবার সমন্বয় করা হবে। কিন্তু এই সময়ে গণপরিবহন বন্ধ রেখে যারা জনগণের ভোগান্তি সৃষ্টি করছে তারা কোন উদ্দেশ্য নিয়ে এটি করছেন তা বোধগম্য নয়।
এ দিকে আগামীকাল রবিবার বিকেলে বাসের ভাড়া বাড়ানোর বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সঙ্গে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। কারণ বাস মালিক সমিতি চাচ্ছে বাসের ভাড়া বাড়ানো হোক, আর পণ্য পরিবহন মালিকদের মূল দাবি ডিজেলের মূল্য কমানো।
তেলের দাম বাড়ানো নিয়ে সরকারি ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য ঊর্ধ্বগতির কারণে পার্শ্ববর্তী দেশসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশ জ্বালানি তেলের মূল্য নিয়মিত সমন্বয় করছে। কল্যাণকর রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ সবসময় জনগণের ক্রয় ক্ষমতা বিবেচনায় রেখে সাশ্রয়ী মূল্যে জ্বালানি তেল ভোক্তা পর্যায়ে সরবরাহ করতে বদ্ধপরিকর। সরকার ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে দেশে ডিজেলের মূল্য লিটারপ্রতি ৬৮ টাকা নির্ধারণ করেছিল। পরে ২০১৬ সালের এপ্রিলে ডিজেলের মূল্য লিটারপ্রতি ৩ টাকা কমিয়ে ৬৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
বিগত সাড়ে পাঁচ বছরে দেশে ডিজেল, কেরোসিনের মূল্য অপরিবর্তিত ছিল এবং ইতোমধ্যে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) ১০ হাজার কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিয়েছে।
এতে আরও বলা হয়, চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেতে থাকায় সর্বাধিক ব্যবহৃত ডিজেলের ক্ষেত্রে বিপিসি লোকসানের সম্মুখীন হয়। ডিজেলে চলতি বছরের জুন মাসে লিটার প্রতি ২.৯৭ টাকা, জুলাই মাসে ৩.৭০ টাকা, আগস্ট মাসে ১.৫৮ টাকা, সেপ্টেম্বর মাসে ৫.৬২ টাকা এবং অক্টোবর মাসে ১৩.০১ টাকা বিপিসির লোকসান হয়। সে হিসাবে গত সাড়ে পাঁচ মাসে সর্বাধিক ব্যবহৃত ডিজেলের ক্ষেত্রে বিপিসির মোট লোকসানের পরিমাণ প্রায় ১,১৪৭.৬০ কোটি টাকা। যা সরকার কর্তৃক ভর্তুকি দিয়ে সমন্বয় করতে হবে। তাছাড়া জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে প্রায় ৩৩ হাজার ৭৩৪.৭৮ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাংলাদেশ পেট্টোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) গ্রহণ করেছে। এ অবস্থায় বিপিসি লোকসানে চলে গেলে এসব উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হবে, যা জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য হুমকির সম্মুখীন হতে পারে।
ব্যাখ্যায় বলা হয়, সার্বিক প্রেক্ষাপটে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে সরকার গত ৪ নভেম্বর থেকে দেশে ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্য পুনঃনির্ধারণ করেছে। যদিও আশেপাশের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ডিজেলের মূল্য এখনও কম। গত ৩ নভেম্বর ভারতের কলকাতায় ডিজেলের মূল্য ছিল ১০১.৫৩ রুপি প্রতি লিটার বা ১২৪.৩৭ টাকা। তেলের ভেজালরোধে কেরোসিনের মূল্য ডিজেলের সমান রাখা হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাস পেলে সরকার পুনরায় ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্য সমন্বয়ের উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দামের সঙ্গে সমন্বয় এবং ভারতে মূল্য কম হওয়ায় পাচার রোধে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে ডিজেলের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে ৫ নভেম্বর থেকে বাস চালানো বন্ধ করে দিয়েছে মালিকরা। লঞ্চ মালিকরা ভাড়া দ্বিগুণ করার প্রস্তাব দিয়েছে যা একেবারেই অযৌক্তিক ও অন্যায়।
কারণ কল্যাণকর রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ সবসময় যেখানে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বিবেচনায় রেখে সাশ্রয়ী মূল্যে জ্বালানি তেল ভোক্তা পর্যায়ে সরবরাহ করতে বদ্ধপরিকর সেখানে জনগণের ভোগান্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে যানবাহন বন্ধ করে। শেখ হাসিনা সরকারের আন্তরিকতা এবং শুভবুদ্ধির উপর নির্ভর করা সকলেরই কর্তব্য। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দামের ঊর্ধ্বগতির কারণে পার্শ্ববর্তী দেশসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে জ্বালানি তেলের মূল্য নিয়মিত সমন্বয় করা হচ্ছে।
সরকার ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে দেশে ডিজেলের মূল্য লিটারপ্রতি ৬৮ টাকা নির্ধারণ করেছিল, সেসময় ভারতে দাম ছিল ৭০ টাকার বেশি। ২০২১ সালের ৪ নভেম্বর যখন ডিজেলের দাম ৮০ টাকা করা হয়েছে তখন ভারতে এর দাম ১২৪ টাকা। অর্থাৎ ৪৪ টাকা বেশিতে ভারতে বিক্রি হচ্ছে ডিজেল।
প্রায় দুই বছরের করোনাকালে সরবরাহব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়েছে। চাহিদা ছিল কম, উৎপাদনও কম। কিন্তু এখন অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে। তবে আগের সমস্যাগুলো রয়েছে, কিন্তু বেড়েছে চাহিদা। সবচেয়ে বেশি প্রভাব জ্বালানি তেলে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দর এখন প্রতি ব্যারেল ৮৫ ডলার ছাড়িয়েছে। মূলত ২০১৪ সালের পরে প্রথম দাম ৮৫ ডলার ছাড়াল। অথচ গত বছরের এপ্রিল মাসেও জ্বালানি তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ‘শূন্য’ ডলারের নিচে নেমে গিয়েছিল। আর এখনকার যে প্রবণতা, তাতে দর ১০০ ডলারের কাছাকাছি যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। মূলত প্রায় দেড় বছরের বেশি সময় কম দামে বিক্রির ক্ষতি পুষিয়ে নিতেই তেল উত্তোলনকারী দেশগুলো দাম বাড়ানোর কৌশল হিসেবে দৈনিক তেল উত্তোলন কমাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর সংগঠন ওপেক কম উত্তোলনের এ ধারা আরও কিছুদিন অব্যাহত রাখবে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন দেশের চাহিদা অনুযায়ী প্রতি বছর অপরিশোধিত এবং পরিশোধিত তেল আমদানি করে। বিশ্ববাজারে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত তেলের মূল্যের উত্থান-পতন রয়েছে। বিশ্বব্যাপী তেলের মূল্য হ্রাস পাওয়ায় সরকারকে ২০১৬ এবং ২০১৮ অর্থবছরের মধ্যে ভর্তুকি দেওয়ার দরকার পড়েনি। তবে ২০১৯ অর্থবছরের জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়তে শুরু করায় বিপিসি আবারও ফার্নেস তেল ও ডিজেলে লোকসান দিতে শুরু করে। ফলে, দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোসহ অন্যান্য দেশের ন্যায় পরিবর্তনশীল বাজারের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ডিজেল, ফার্নেস তেল এবং অন্যান্য জ্বালানিসমূহের মূল্য নিয়মিতভাবে সমন্বয় করতে হচ্ছে। বস্তুত বিশ্বজুড়ে সংকটের কারণে বেড়েই চলেছে জ্বালানির দাম। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম সাত বছরের রেকর্ড অতিক্রম করেছে।
আমদানি করা তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দর বৃদ্ধি চাপে ফেলেছে জ্বালানি বিভাগকে। তবে এই সংকট ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। এদিকে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি পণ্যের দর বাড়ায় বহুজাতিক কোম্পানিগুলোরও বাংলাদেশমুখী হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে অগভীর সমুদ্রে ভারতের জাতীয় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি ও এনজিসির দুই ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনায় সাগরে গ্যাস-তেল অনুসন্ধানে গতি ফিরবে বলে মনে করে সরকারের জ্বালানি বিভাগ। জ্বালানির দরস্ফীতিতে যেন ভোক্তাদের ওপর পড়া প্রভাব সীমিত রাখা যায়, সরকারি পর্যায়ে সে চেষ্টাই চলছে। কারণ ভোক্তারা ব্যয় সংকোচনে বাধ্য হলে ব্যাহত হবে মহামারি থেকে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার।
সার্বিক প্রেক্ষাপটে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার ৪ নভেম্বর দেশে ডিজেল-কেরোসিনের দাম বাড়িয়েছে। তবে আশপাশের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ডিজেলের মূল্য এখনও কম। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় তেলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে দেশে। এ ছাড়াও সরকার প্রতিদিন ২০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে।
বর্তমানে জ্বালানি তেল আমদানি থেকে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পায়। ডিজেল আমদানিতে সরকার সব মিলিয়ে কর পায় ৩৪ শতাংশ, কেরোসিনে ৩৪ শতাংশ এবং অপরিশোধিত তেলে ২৮ শতাংশ। সরকার করের পরিমাণ কমালে সাধারণ মানুষ কিছুটা স্বস্তি পেত। এতে সরকারের আয় কিছুটা কমত, কিন্তু ভোক্তাদের ওপর দায় কিছুটা কমে যেত। ভারত সরকার কর কমিয়ে ঠিক এ কাজটাই করেছে।
আবার এটাও মনে রাখতে হবে, সরকারকে অস্থিতিশীল করতে একটি চক্র সবসময় ব্যস্ত থাকে। চলমান জনভোগান্তির এই ধর্মঘট সেই অশুভ কোনো চক্রের কাজ নয় তো?
বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। বিশ্বের চোখে এখন বিনিয়োগের উৎকৃষ্ট দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। তাই এই উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হবে। আশাকরি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার তা পারবে।
লেখক: সাংবাদিক, যুগ্ম সম্পাদক, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে)
ঢাকা/তারা