ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ৯ ১৪৩১

কেমন আছে, কতোটা এগিয়েছে কুমিল্লা

ড. কাজল রশীদ শাহীন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৩৪, ৮ নভেম্বর ২০২১   আপডেট: ১৩:৫৯, ৮ নভেম্বর ২০২১
কেমন আছে, কতোটা এগিয়েছে কুমিল্লা

আলোকচিত্র: সংগৃহীত

(কুমিল্লা নিয়ে চার পর্বের বিশেষ নিবন্ধ, আজ প্রথম পর্ব)

ফিরছি যখন কুমিল্লা থেকে, নিজের ভেতরে-বাইরে তখন এক আকাশসম প্রশ্ন। নানা যুক্তি-নানা প্রসঙ্গে একটাই জিজ্ঞাসা কেবল- ভালো আছে তো কুমিল্লা, সময় পরিক্রমায় সে কি এগিয়েছে, নাকি কেবলই স্থাপনার সংখ্যা আর চাকচিক্যই বাড়িয়েছে, ভুলতে বসেছে তার ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি?

অর্বাচীন কোনো জনপদের শহর নয় কুমিল্লা। এর রয়েছে হাজার বছরেরও অধিক সময়ের সমৃদ্ধ অতীত। বাংলাদেশ-বাংলা, সাহিত্য-বাংলা ভাষাকে বুঝতে হলে এর ভেতর-বাহির ও শেকড় জানতে হলে এখানে ঢুঁ দেওয়া ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। বৌদ্ধ- হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের যে সংহত প্রকাশ তার সঙ্গে এই মৃত্তিকার রয়েছে গভীরতর সম্পর্ক। শালবন বিহার-রূপবান মুড়া-কৌটিলা মুড়া-ইটাখোলা মুড়া-চারপত্র মুড়া, আনন্দ বিহার, ভোজ রাজার বাড়ি, রাণী ময়নামতির প্রাসাদ ও মন্দিরের প্রাপ্ত- জ্ঞাত নিদর্শন সাক্ষ্য দেয় বৌদ্ধ ধর্মের বিকাশকালে এই অঞ্চল কতোটা সমৃদ্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে ছিল সর্বজন স্বীকৃত ও মান্য।

শুধু বৌদ্ধ ধর্ম-সংস্কৃতি ও সভ্যতার সমৃদ্ধ আধার নয় কুমিল্লা, হিন্দুধর্মের সঙ্গেও রয়েছে এর নিবিড় সম্পর্ক। কুমিল্লার অনেকেই স্বীকার করেন এই শহর এখনও অনেকাংশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে ত্রিপুরার রাজাদের বদান্যতার বদৌলতে। তারা ভালোবেসে আপন করে নিয়েছিলেন এই জনপদ ও তার মানুষজনকে। কোনো সাম্প্রদায়িক বিভাজন ছিল না তাদের। কাজে ও কর্মে, দানে ও সেবায় শুধু হিন্দু বা সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষ নয়, অন্যান্য ধর্মের মানুষও পেয়েছে বিস্তর উপকার, বেঁচে থাকার উপাদান-উপকরণ ও অবলম্বন। এ কারণে এখনও কুমিল্লার অনেক মানুষ, তা তারা যে ধর্মের অনুসারীই হোন না কেনো, এক বাক্যে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন ত্রিপুরার রাজাদের। আক্ষরিক নয়, মন থেকেই বলেন- এই শহর, এই জনপদ, কুমিল্লাবাসী ঋণী ত্রিপুরার রাজাদের কাছে। কারণ তারা মানুষকে দেখেছিলেন মানুষ হিসেবে, ধর্ম- গোষ্ঠী-সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি রূপে নয়।

কুমিল্লা শহর এবং এর আশেপাশে একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় এর দেহাবয়বে হিন্দুরা এখন লঘু হয়ে গেলেও, অস্থিতে রয়েছে তাদের নিরব কিন্তু প্রবলতর উপস্থিতি। এলাকা, রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজার, সড়ক, প্রতিষ্ঠান, শিক্ষালয়সহ অনেক জায়গার নামেই তারা রয়ে গেছেন আজও, এবং সেটাই সংগত। যদিও সেই সংগতকে করা হচ্ছে ধ্বস্ত ও উদোম। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তপণায় ও দখলদারি সংস্কৃতির উল্লম্ফনে হিন্দু জনগোষ্ঠী সংখ্যায় কেবল কমছে না, তাদের ভিটেমাটিই শুধু অন্যের হয়ে যাচ্ছে না, তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য-অবদান-অনুদান ও সহযোগিতায় বেড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানসমূহ থেকেও তাদের নিশ্চিহ্ন করা হচ্ছে, এবং সেটা প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য দু’ভাবেই।

মা, মাটি, মাতৃভাষার গুরুত্ব সর্বাগ্রে এবং গুণীজনরা একে অবহেলা করতে নিষেধ করেছেন। কারণ একে অবহেলা করার অর্থ হলো নিজের অস্তিত্ব, শেকড় অস্বীকার করা। অথচ ইদানীং আমরা মনে হয়, অনেকাংশেই এই তিনটি বিষয় অবহেলা করে চলেছি। মাকে অবহেলা করছি তার প্রমাণ দেশে বৃদ্ধনিবাস বা বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা বাড়ছে দ্রুত। এটা তো একটা মাত্র উদাহরণ; এ রকম উদাহরণ রয়েছে অসংখ্য। আমরা মাতৃভাষা অবহেলা করছি, তার প্রমাণ দেশে ইংরেজি মাধ্যম ও ভার্সনের স্কুলের সংখ্যা বাড়ছে-মাদ্রাসা শিক্ষা প্রসারিত হচ্ছে এবং এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলা মাধ্যমের শিক্ষাব্যবস্থা কেবলই দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। উচ্চশিক্ষায় বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে যাচ্ছে।

মাটি অর্থ হলো মাতৃভূমি-স্বদেশ। এই মাতৃভূমির প্রতিও আমাদের প্রেম-ভালোবাসা ক্রমশ গৌণ হয়ে আসছে। দেশ ছেড়ে অভিবাসী হওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে ফি-বছর। আবার স্বেচ্ছা অভিবাসীর সঙ্গে রয়েছে অনিচ্ছাকৃত বা বাধ্য হয়ে, চাপে পড়ে, জীবন বাঁচানোর লক্ষ্যে অভিবাসী। তাদের সংখ্যা নেহাতই কম নয়। ফলে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার যেখানে ঊর্ধ্বমূখী হওয়া শ্বাশত ও সংগত, সেখানে কেনো হিন্দু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমতে কমতে এই পর্যায়ে এসেছে- তা নিয়ে আমাদের কোনো হেলদোল আছে বলে মনে হয় না। অথচ দেশটাকে যদি সত্যিই মায়ের সঙ্গে কল্পনা করি তাহলে মুসলমান-হিন্দু, উভয়েই সেই মায়ের সন্তান। তাহলে এক সন্তান যদি খারাপ থাকে, তাহলে মা কীভাবে থাকে ভালো, সুস্থ ও স্বাভাবিক? আর মা-ই যদি ভালো না থাকে তাহলে কোনো সন্তানের পক্ষেই যে ভালো থাকা সম্ভব নয়, ভালো থাকা যাবে না, সেটা আমরা কবে বুঝব আর কবে সেই বুঝকে বাস্তবায়ন করার জন্য আন্তরিকভাবে নিজেদেরকেই করব নিবেদন-উৎসর্গীকৃত প্রাণ? এই প্রশ্ন বারবার উত্থিত হয়েছে কুমিল্লা দর্শনে এবং ফিরে আসার পরও।

কোনো প্রকার গবেষণা কিংবা সাত-পাঁচ না ভেবেই এ কথা সহজেই এবং সাধারণ সূত্রে বলা যায়, মাকে-মাতৃভূমিকে ভালোবাসার দায়িত্ব সেই সন্তানের ওপরই বেশি বর্তায়, যার সক্ষমতা বেশি। সক্ষমের ধর্মই হলো যে সক্ষম নয়, যে পিছিয়ে রয়েছে, যে দুর্বল তাকে সহযোগিতা করা। তা না হলে যে ভারসাম্য বজায় থাকবে না, সমতা রক্ষিত হবে না। এসব যদি না থাকে তাহলে নিজেরাই যে ডেকে আনছি সমূহ এক সর্বনাশ!

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দুর্গাপূজায় অনাকাঙ্ক্ষিত এক ঘটনা সংঘটিত হয়, জেলা শহর কুমিল্লার নানুয়ার দীঘির পাড়ে। সেখানে থেকে দারোগা বাড়ির মাজার ও মসজিদ পায়ে হাঁটা পথ। সেখানে আজান দিলে নানুয়ার দীঘির পাড় থেকে শোনা যায়। এখানে উলু দিলে, শঙ্খ বাজালে, ঢাকের বাড়ি দিলে শোনা যায় দারোগা বাড়ি মাজার-মসজিদ থেকেও। যার যার ধর্ম পালন করে আসছে তারা প্রায় দুইশ বছরেরও বেশি সময় ধরে। কারণ, দারোগা বাড়ি মসজিদটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১২১৪ হিজরীতে, রিয়াজউদ্দিন আহমেদ চৌধুরীর পৌরহিত্যে। এত বছরেও দুই সম্প্রদায়ের মানুষ মুসলমান ও হিন্দুর মাঝে কোনো ফাটল দেখা যায়নি, কারও ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগার মতো ঘটনা ঘটেনি। 

দুইশ বছরের ইতিহাসে কত কিছুর সাক্ষী তাদের পূর্ব পুরুষেরা, মুরুব্বিজনেরা। ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তান আমল, ১৮৫৭’র মহাবিদ্রোহ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ১৯৪৬’র গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং, ১৯৪৭’র দেশভাগ, ১৯৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতেও তাদের এই জনপদের মানুষেরা একে অপরের হাত ধরাধরি করে বেঁচেছে, পাশাপাশি থেকে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছে, খুঁজে ফিরেছে বেঁচে থাকার সাহস ও সৌন্দর্য। ধর্ম নয় মনুষ্যত্বের পরিচয় ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছে সর্বাবস্থায়-সকল পরিস্থিতিতে। মানুষ হিসেবে মানুষের পাশে থেকেছে এবং মানুষের সঙ্গেই বেঁধেছে সুখ-দুঃখ, বিপদ-আপদের গাঁটছড়া। মানুষের ওপর থেকে তারা বিশ্বাস হারায়নি কখনও। অথচ আজ হঠাৎ কী হলো এ দেশের, এই সমাজের কিছু মানুষের, যারা মানুষের ওপরই আঘাত করতে উঁচিয়ে ধরছে উদ্ধত সঙ্গীন, মানুষের রক্তেই রঞ্জিত করছে নিজেদের শরীর, মানুষের প্রাণ সংহার করে, মানুষকে নির্যাতন করে, মানুষের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে, বিভৎসা সৃষ্টি করে যারা পুণ্যি খোঁজে তারা ঠিক মানুসের সংজ্ঞায় পড়ে কি না সেই প্রশ্ন তোলা হচ্ছে না প্রবলভাবে। অথচ এই গ্রহণ লাগা সময় পরাজিত করতে হলে, সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ সমূলে উৎপাটন করতে হলে এসবের অনুসন্ধান দরকার, সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ দরকার।

২০২১’র দুর্গাপূজায় নানুয়ার দীঘির পাড়ের ঘটনাটি আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ইতিহাসে অবশ্যই বিচ্ছিন্ন ঘটনা, কিন্তু সেই ঘটনায় যে অনেক বাস্তবতা ও তার পরম্পরা হাজির করেছে, সেসবের তত্ত্ব তালাশ হওয়া জরুরি। এই লেখাতে জারি থাকবে সেসবের অনুসন্ধান এবং ইতিহাস ও মানুষের ভাবনার গতিপ্রকৃতির নির্মোহ অবলোকন চেষ্টা। 

কী ছিল সেদিনের কুমিল্লার ঘটনা, কী হয়েছিল নানুয়ার দীঘি পাড়ের অস্থায়ী এক পূজামণ্ডপে- তা এখন আর কারও অজানা নয়। এই ঘটনা এবং তৎপরবর্তী ধারাবাহিকতায় একটি বিষয় কি স্পষ্ট, আমাদের সহিষ্ণু ক্ষমতা ক্রমশ কমে যাচ্ছে এবং হঠকারিতা পেয়ে বসেছে অস্থিমজ্জায়, চিন্তা ও চেতনায়। ‘হুজুগে বাঙালি’ বলে যে ট্যাগ লাগানো রয়েছে বাঙালির আটপৌরে জীবনে, সেই খাসলতে এখন প্রবলভাবে জেঁকে বসেছে হঠকারিতার বিষবাষ্প। ফলে, কুমিল্লার নানুয়ার দীঘিতে একটি ঘটনা যে কোনো কারণে, যে কোনোভাবেই সংঘটিত হোক না কেনো তারপর সেই জনপদ শান্ত ও স্বাভাবিক হয়ে এলেও উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে-প্রান্তিক অঞ্চলেও।
ঘটনাটিকে কীভাবে দেখছেন কুমিল্লার মানুষ তা নিয়ে জানা গেছে বেশ কৌতূহলোদ্দীপক ও চিত্তাকর্ষক তথ্য। দেখা, শোনা ও মন্তব্যের আলোকে প্রাপ্ত তথ্যের পাঁচটা দিক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেসব নিয়ে বিস্তারিত বলব অবশ্যই, কিন্তু আজ নয়, ধারাবাহিক এই লেখার আগামী পর্বে। 

আজ জানা যাক, কুমিল্লার বিভাগীয় মর্যাদা না-পাওয়ার বিষয়টাকে কীভাবে দেখছেন সেখানকার সর্বশ্রেণীর মানুষ- মোটাদাগে এসব নিয়ে কী ভাবনা তাদের? কারণ আমি যেদিন ওখানে যাই, সেদিনই ঘটেছে ঘটনাটা। ফলে, ব্যাপারটা ছিল কুমিল্লাজুড়ে হট কেক। যে যার মতো বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন, কখনো গভীরে গিয়ে, কখনোবা একেবারে উপরিতল থেকেই। ছোট-বড়ো পেশার সবশ্রেণীর মানুষের কাছে বিষয়টা হাজির করলেই গড়গড় করে বলেছেন নানা কথা। তাতে প্রশ্ন যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে যুক্তি ও প্রাসঙ্গিক তর্কও। সে কথাই বলি আজ; তার আগে অন্যরকম হলেও  প্রাসঙ্গিক একটা বিষয় বলে নেই এ ক্ষণে- স্মরণে নেই চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনের পূন্যনাম।

দেড় দশক আগে কুমিল্লা শহর ও এর আশপাশ দেখেছিলাম নিবিড়ভাবে, পথের গন্ধ-সৌন্দর্য, তার বয়ান-বিবৃতি ও তার ধুলো-কাদা-কংকর-ইটের শরীরের ভাঁজে ভাঁজে থাকা নানা রঙের, নানা বর্ণের, নানা স্তরের গল্প শুনেছিলাম পায়ে পায়ে হেঁটে। যেমনটা দেখেছিলেন চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন চিলমারীর জনপদে। যাই হোক, কুমিল্লায় টমছম ব্রিজ শুধু নামেই রয়েছে, স্থাপনা হিসেবে নয়। সেখানে দাঁড়িয়েই কথা হলো প্রধানমন্ত্রী ও সদরের সংসদ সদস্যের বাহাস, কুমিল্লা বিভাগ করা-না করা ছিল যার মুখ্য বিষয়।

কিন্তু বাহাসের পরিণতি-তাৎপর্য ও আগে-পরের কিছু বিষয় তাদের কাছে খোলাসা না হলেও বিস্তর আনন্দ পেয়েছেন সকলেই, কারণ তাদের এমপি মহোদয় কুমিল্লা বিভাগ করার ব্যাপারে নিজের শক্ত অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। কিন্তু এখানেই এমন আওয়ামী লীগ সমর্থক রয়েছেন যারা যে কোনো কারণেই হোক কুমিল্লা -০৬ (আদর্শ সদর, সিটি করপোরেশন ও সেনানিবাস এলাকা) আসনের সাংসদ আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের ওপর নাখোশ। তাদের বক্তব্য- প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এভাবে তর্কে জড়িয়ে যাওয়া ঠিক হয়নি। তাদের  ধারণা প্রধানমন্ত্রী এ কারণে তার ওপর গোস্বা হলেও হতে পারেন। কিন্তু সিংহভাগ মানুষই খুশি-আনন্দিত- গৌরবান্বিতও। কারণ এমপি মহোদয় তার অবস্থানে ছিলেন শক্ত-কৌশলী ও লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতির প্রতিভূ, পাল্টা যুক্তি দেয়ার চেষ্টা তিনি করেছেন রাজনৈতিক শিষ্টাচার ও সৌজন্যতাকে মান্য করে। 

এসব নিয়ে ঘুরে ফিরে কথা হয় অনেকের সঙ্গে। কান্দির পাড়ের কিছু মানুষ বলেছেন যেমনটা, তারা মনে করেন কুমিল্লা বিভাগের মর্যাদা পাওয়া ন্যায্য এবং যুক্তিসঙ্গত। প্রধানমন্ত্রীকে কেউ না কেউ ভুল বুঝিয়েছেন। তাদের অকাট্য যুক্তি হলো- কুমিল্লা কোনোভাবেই মোস্তাকের নয়, মোশতাকের নামের সঙ্গে কুমিল্লার মিলটা কোথায়? কুমিল্লার মানুষ কুমিল্লাকে মোশতাকের শহর বা জেলা অতীতেও মনে করেনি, এখনও করে না। হ্যাঁ মোশতাক কুমিল্লায় জন্মেছে- এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। মীরজাফরও তো বাংলায় জন্মেছিলেন। এখন মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে কি বাংলার নাম বদলে ফেলা হয়েছে?  পাল্টে দেয়া হয়েছ পলাশীর স্থাননাম। কু-এর প্রতি বিদ্বেষের কারণে কুষ্টিয়া, কুড়িগ্রামের নামও তাহলে বদলে ফেলা হবে? পুরো দেশের যত জায়গায় ‘কু’ দিয়ে নাম আছে সব জনপদের নামই কি পরিবর্তন করা হবে?

কান্দিরপাড় থেকে একটু এগুলেই কথা হলো ধর্মসাগর পাড়ের কয়েকজনের সঙ্গে। তারা মনে করেন, এই বাহাসের মধ্য দিয়ে বিদ্বেষ ও দাবির দিকটা উন্মোচিত হলেও পুরো বিষয়টা পরিষ্কার হয়নি। বিভাগ যদি মেঘনা হয়, তাহলে খোদ কুমিল্লাতেই তো একটা মেঘনা উপজেলা রয়েছে। তাহলে এই বিভাগের প্রশাসনিক কার্যক্রম চালানোর স্থান কি মেঘনা উপজেলাতে হবে? তারা এও যোগ করেছেন যে, মেঘনা উপজেলা কিন্তু হয়েছে মোশতাকের জন্ম উপজেলা দাউদকান্দিকে বিভক্ত করে। তাহলে আমরা কি মোশতাককে তাড়াতে গিয়ে, মোশতাকের ভূতমুক্ত বিভাগীয় প্রশাসন গড়তে গিয়ে আরও বেশি করে মোশতাকের কাছে হাজির হচ্ছি বা নিকটবর্তি হচ্ছি। 

টাউনহলের সামনে দাঁড়িয়ে কিছু মানুষ বেশ যুক্তি দিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, নিজেদের মতামত দিয়েছেন এসব প্রসঙ্গ সামনে রেখে। তাদের যুক্তি হলো, প্রধানমন্ত্রী কুমিল্লা নামে বিভাগ দেবেন না ভালো কথা। ফরিদপুর বিভাগ হবে পদ্মা নামে, কুমিল্লা বিভাগ হবে মেঘনা নামে। নদীমাতৃক বাংলাদেশে এমনটাই হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী নদীর নামের সঙ্গে বাঙালির যে আবেগজড়িত স্বাজাত্যবোধের সংগ্রাম জড়িত সেকথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা’ শ্লোগানের কথাও। সেসব অবশ্যই আমাদের গর্বের ধন, অহঙ্কারের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। কিন্তু সেসবের প্রতি সম্মান-মর্যাদা কি কেবলই বিভাগের নামকরণের মধ্য দিয়েই করতে হবে, নাকি চাইলে তার জন্য খোলা রয়েছে হাজারো পথ-অগণন পন্থা।  

এই লেখায় ফরিদপুর বিভাগ হওয়া না-হওয়া; তার নামকরণ পদ্মা নাকি অন্যকিছু- সেসব প্রাসঙ্গিক নয়। কুমিল্লা প্রসঙ্গে এবং টাউন হলের সামনে দাঁড়িয়ে শোনা মানুষের কথাগুলোই আসুন বোঝার চেষ্টা করি। মেঘনা নামে বিভাগ হলে, এই বিভাগের সদর দপ্তর কোথায় হবে- কুমিল্লায়? যদি কুমিল্লায় হয় তাহলে নোয়াখালী, ফেনীসহ অন্যান্য জেলাগুলো কুমিল্লাকেই মান্য করলো- একটু ঘুরিয়ে এই যা! কথা আরো রয়েছে- প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ না করে, স্থানীয় প্রশাসনকে শক্তিশালী না করে বিভাগ করলেই কি ওই জনপদের ব্যাপক কোনো পরিবর্তন হয় নাকি চেয়ারের সংখ্যা বাড়ে, স্থাপনার বিস্তার ঘটে কেবল। কুমিল্লায় একটা ভালো মানের হাসপাতাল হয়নি এত বছরেও। তাহলে কুমিল্লার যে উন্নয়ন হয়েছে-হচ্ছে, বিভাগ হলে যা বাড়বে আরও, তাতে কি মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন হবে, অসুস্থ হলে কুমিল্লাতেই কি মিলবে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা, নাকি ছুটতে হবে ঢাকায়? এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে চান কুমিল্লাবাসী। 

এসব কথা যারা বলেছেন তাদের বক্তব্য সরাসরি- কোনো হেঁয়ালী নেই। তারা বিভাগের নামকরণের এসব প্রসঙ্গকে জ্ঞান করেন কূটতর্ক হিসেবে। তারা চান কুমিল্লার প্রকৃত উন্নয়ন, আলোকিত এক কুমিল্লা। যে আলোয় উদ্ভাসিত হবে এখানকার সব পেশার-সব বর্ণের-সব ধর্মের মানুষ। তারা বিশ্বাস করেন সেটা হলে এখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার দুষ্টচক্র মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। সেটা কী উপায়ে সম্ভব তাও তারা বলেছেন তাদের মতো করে, যার বিস্তারিত বয়ান থাকবে আগামী পর্বে।

লেখক: সাংবাদিক, লেখক ও গবেষক
 

ঢাকা/তারা


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়