ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন এবং নতুন নির্বাচন কমিশন ভাবনা
বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে রাজনীতির মাঠ এখন থেকেই গরম হওয়া শুরু করেছে। বরাবরের মতো এবারও দেশের রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি বিদেশী রাষ্ট্রদূতগণও আগামী নির্বাচন নিয়ে তাদের নিজেদের মতো মন্তব্য করছেন। সম্প্রতি কূটনৈতিক প্রতিবেদকদের এক আলোচনা অনুষ্ঠানে ঢাকায় নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের মান্যবর রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি বেশ জোরের সাথেই বলেছেন, যেহেতু তাঁরা সব দেশেই মানবাধিকার এবং গণতন্ত্র সমুন্নত দেখতে চান। তাই তারা বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংস্দ নির্বাচনের দিকেও দৃষ্টি রাখছেন।
মাননীয় রাষ্ট্রদূতের এই বক্তব্য বেশ তাৎপর্যপূর্ণ এবং ইঙ্গিতবহ। এরকম এক পরিস্থিতিতে দেশে একটি নয়া নির্বাচন কমিশন নিয়ে আলোচনার ডামাডোল শুরু হয়েছে। যদিও দেশের আগামী পার্লামেন্ট নির্বাচনের জন্য আরো দুই বছরেরও বেশি সময় হাতে রয়েছে। কিন্তু ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হবে। ফলে এক ধরনের সাংবিধানিক এবং আইনগত বাধ্যবাধকতার কারণেই বর্তমান সরকারকে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গেই ভাবতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের পক্ষ থেকে এ নিয়ে নানা বিবৃতি দিতে হচ্ছে। সরকারী দল বলছে, ইসি গঠনে আইন পরে হবে। এবার সার্চ কমিটির মাধ্যমেই হবে নির্বাচন। বিরোধী দলগুলো বলছে, এখনই সংসদে আইন পাস করে ইসি গঠনের আইন প্রণয়ন করা হোক এবং সে অনুযায়ী ইসি গঠন করা হোক। এ নিয়ে দুপক্ষের তর্কের সুরাহা এবারের নির্বাচনের আগে সম্ভব বলে মনে হচ্ছে না।
অন্যদিকে, সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদ অনুসারে নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন প্রণয়নের নির্দেশনা চেয়ে করা রিট আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। গত ৩১ অক্টোবর বিচারপতি মো: মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মো: কামরুল হোসেন মোল্লার সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। সুতরাং ইসি গঠনের আইন যে এবার প্রণীত হচ্ছে না- বিষয়টি এখন বেশ স্পষ্ট।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৪ অক্টোবর ২০২১ গণভবনে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৬তম অধিবেশনে অংশগ্রহণ-পরবর্তী এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, সার্চ কমিটি করেই নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে। মানুষের আস্থা-বিশ্বাস নিয়েই আওয়ামী লীগ ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় থাকতে চায়। এ সময় তিনি আরো উল্লেখ করেন, নির্বাচনে কোন দল প্রতিযোগিতা করবে, সে বিষয়ে ভাবে না আওয়ামী লীগ।
এর আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, রাষ্ট্রপতি সবার সঙ্গে আলোচনা করে সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন। তিনি আরো বলেন, নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ থাকলে নির্বাচনও নিরপেক্ষ থাকবে। শাসক দলের এসব মন ভোলানো বিবৃতি যে, এক ধরনের রাজনৈতিক কৌশল সেটি বিগত দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চেহারা থেকেই দেশের ভোটারদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। এমনকি সম্প্রতি দেশের ইউপি নির্বাচনসমূহে অনিয়ম, কারসাজি, পক্ষপাতিত্ব, অন্যায় হস্তক্ষেপ এবং নির্বাচন ঘিরে সহিংসতা সাধারণ শান্তিপ্রিয় মানুষের মনকে ভোট ব্যবস্থার প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তুললে অন্যায় হবে না। ইউপি নির্বাচনকালে পত্রিকাসমূহের দিকে দৃষ্টিপাত করলেই এই ভয়ানক পরিস্থিতি সহজেই অনুধাবন করা যায়।
নির্বাচন কমিশনকে জনগণের আস্থাহীন এবং কার্যতঃ একটি ক্ষমতাহীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। এটি করা হয়েছে, শুধু স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে লুটপাটতন্ত্রের রাজনীতিকে এক ধরনের ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ দেওয়ার জন্য। যাতে দেশে এক শ্রেণির লুটেরা রাজনীতিকরা জনগণের টাকা, জাতীয় সম্পদ লুটপাট করে দেশে-বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলতে পারে। দুঃখজনক হলো, এ ধরনের রাজনীতিকরা তাদের সহযোগী হিসেবে সব সময় পাশে পেয়েছে এক শ্রেণির দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাদের। বলতে দ্বিধা নেই, এদের দুঃশাসনের স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে একটি ব্যর্থ কিংবা রোগাক্রান্ত নির্বাচন ব্যবস্থা বেশ মানানসই।
সে কারণে দেশের প্রধান বিরোধী শক্তি বিএনপি-জামাত জোট বর্তমান সরকারের ক্ষমতা হরণ করতে চায়। কিন্তু তারা নির্বাচন ব্যবস্থার কোনো গঠনমূলক পরিবর্তন আনতে চায় না। কারণ, দেশের সম্পদ লুটের ক্ষেত্রে তারাও সিদ্ধহস্ত। একইসঙ্গে সরাসরি এবং পরোক্ষ দুই পথেই দেশে সেনা শাসনের যাঁতাকল চাপিয়ে দিয়ে, রাইফেলের জোরে অবৈধ পথে ক্ষমতা দখল করে সেনাশাসক জিয়া শুরুতেই বাংলাদেশে গণতন্ত্রের কবর রচনা করেছিলেন। সেই গণতন্ত্রের কবরে তিনি উড়িয়েছিলেন পতিত পাকিস্তানী ভাবাদর্শের জলপাই রঙের নিশান। সুতরাং তাদের কাছে গণতন্ত্রের সবক শোনা আহাম্মকি ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না।
শুধু ভোটের অধিকারই কেন? জিয়া সরকার আইন করে মানুষ হত্যার বিচার চাওয়ার অধিকারও কেড়ে নিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ঠেকাতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি এর জ্বলন্ত উদাহরণ। কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি ঘোষণা করা, বিরোধী দলগুলোর উপর ব্যাপক নির্যাতন থেকে শুরু গণতন্ত্রের টুঁটি চেপে ধরতে এমন কোনো ন্যাক্কারজনক কাজ নেই যে জিয়া সরকার সেসময় করেনি। সুতরাং শাসক দল আওয়ামী লীগ এবং দেশের প্রধান বিরোধী শক্তি বিএনপি-জামাত জোটের কাছে একটি কার্যকর নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন আশা করা সোনার পাথর বাটি মাত্র। কারণ, সেটি তাদের শ্রেণি স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
অপরদিকে, দেশের সাধারণ মানুষ, গণতন্ত্রকামী শান্তিপ্রিয় জনগণ বরাবরই একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও সে কথাই বলে। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছরেও নির্বাচন কমিশন গঠনে একটি গ্রহণযোগ্য আইনি ব্যবস্থার দিকে ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণকারী কোনো দলই আগায়নি। তবে বাংলাদেশের ছাত্র সমাজ একমাত্র রাজনৈতিক শক্তি যারা সকল সামরিক-বেসামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের সংগ্রামের সূচনা করেছে। এ ছাড়া সিপিবি এবং নাগরিক সমাজের একটি অংশ একইসঙ্গে টেকসই গণতন্ত্রের লক্ষ্যে বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের লিখিত রূপরেখা জাতির সামনে এবং বিভিন্ন সময়ে দেশের ক্ষমতাসীন সরকারের কাছে পেশ করেছে। কালো টাকা, সন্ত্রাস, ধর্মীয় উন্মাদনা এবং প্রশাসনের প্রভাবমুক্ত একটি নির্বাচন ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য যুগ যুগ ধরে নিষ্ঠার সঙ্গে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ধারাবাহিকভাবে সংগ্রাম করে আসছে। ফলে বিদ্যমান নির্বাচন ব্যবস্থার অসাড়তা এবং সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা চালুসহ বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কারের দাবি এখন জনপ্রিয় দাবিতে পরিণত হয়েছে।
এদিকে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের আগাম প্রস্তুতি হিসেবে কিছু প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কিন্তু সেসব প্রক্রিয়া শুধু বাগাড়ম্বরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সকলেই জানেন, সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের নিয়োগকর্তা রাষ্ট্রপতি। যে সার্চ কমিটির কথা এখন বলা হচ্ছে সে ধরনের ‘সার্চ কমিটি’র সুপারিশের মাধ্যমে বিগত দুটি নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়ছিল। ওই দুটি কমিশন নিয়োগের আগে রাষ্ট্রপতি দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বর্তমান প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে দুটি সার্চ কমিটি গঠন করেছিলেন। ওই দুটি সার্চ কমিটির সুপারিশে গঠিত হয়েছিল রকিবউদ্দিন কমিশন ও নুরুল হুদা কমিশন। সেসব কমিশনের সক্ষমতা এবং ব্যর্থতা আজ দেশবাসীর কাছে স্পষ্ট।
তাছাড়া সার্চ কমিটি নিয়েও মানুষের মধ্যে আস্থার সঙ্কট রয়েছে। সে কারণে আজ এই দাবিও উঠেছে নির্বাচন কমিশ গঠনের জন্য একটি স্থায়ী আইন প্রণয়নের। বাংলাদেশের সংবিধানে নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন প্রণয়নের কথা উল্লেখ করা হলেও সেই আইনটি এখনও হয়নি। ইতিপূর্বের ক্ষমতাসীন দলগুলোর মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও এরকম একটি আইন প্রণয়নের জন্য কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। এই সঙ্কট সমাধানে অপেক্ষাকৃত পরিপক্ক সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশ ভারতের নির্বাচন কমিশনের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়া যেতে পারে।
বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনকালে কেয়ারটেকার সরকার রাষ্ট্র চালানোর সুযোগ নেই। তবে চলমান সরকার নির্বাচনকালে কয়েকটি ক্ষেত্রে তাদের দায়িত্ব সীমিত করে বিরোধীদের সরকারে শরিক করার সুযোগ আছে। কিন্তু আজকের পরিস্থিতিতে কি উপায়ে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ এবং বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন এদেশে অনুষ্ঠিত হবে এবং একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে- এ বিষয়ে জনগণের সম্মিলিত ইচ্ছার কার্যকর প্রতিফলন এবং জাতীয় ঐক্যমতের কোনো বিকল্প নাই। দুঃখজনক হলেও সত্য, সেই বিকল্পই এখন মরীচিকায় পরিণত হয়েছে। বিদেশি লবিস্ট গ্রুপ এবং নানা দূতিয়ালির ব্যর্থতার জ্বলন্ত নজির থাকার পরও রাজনীতিবিদগণ এখনো সেই একই মোহে মোহাবিষ্ট। যার সুযোগ নিতে পারে অসাংবিধানিক কিংবা কোনো অন্ধকারের শক্তি।
লেখক: লেখক: সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, বিশ্লেষক ও কলাম লেখক
ঢাকা/তারা