মহাবিজয়ের মহানায়ক
নাসরীন জাহান লিপি || রাইজিংবিডি.কম
দীর্ঘকালের আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে সম্পৃক্ত, ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ এক অবর্ণনীয় সত্তার অভিন্ন রূপ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহানায়ক, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ছাড়া বাংলাদেশের জন্ম হতো না। আবার বাংলাদেশ নামের সবুজ শ্যামল মাতৃভূমি পরম মমতায় গড়ে তুলেছিল তাঁর সন্তান শেখ মুজিবুর রহমানকে, তাঁর নেতা হয়ে ওঠাটা অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিল।
বঙ্গবন্ধু ১০ মে, ১৯৭২ সালে পাবনার এক জনসভায় বলেছিলেন, ‘আমি চুঙ্গো ফুইয়াইয়া নেতা হইছি। চুঙ্গো নিয়া আমি গ্রামে গ্রামে ঘুরেছি। সাইকেল নিয়ে আমি গ্রামে গ্রামে ঘুরেছি। রাস্তায় রাস্তায় হেঁটেছি। মহল্লায় মহল্লায় ঘুরেছি। আমি বাংলার গ্রামের থেকে উঠেছি। আমি তো আসমানের থেকে পড়ি নাই এসে। প্রত্যেকটা প্রবলেম আমি জানি।’
বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের প্রধান নেতা আসলেই বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষের আবেগ-ভালোবাসা-স্বপ্ন-চাহিদা-ক্ষোভ এবং অবশ্যই সমস্যাগুলো জানতেন ও চিনতেন। তবে, বঙ্গবন্ধুকে বিশ্ব যেভাবে চিনেছে, শোষক ও শোষিতের পৃথিবী বলে তিনি যেভাবে চিনেছেন বিশ্বকে, তাতে একথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, তাঁর দর্শন বিশ্বকে বদলে দেওয়ার জন্যও অপরিহার্য।
বিশ্ববাসীর কাছে তিনি মুক্তিকামী মানুষের নেতা। মাত্র সাড়ে তিন বছর তিনি সময় পেয়েছিলেন দেশ গড়ে তোলার সময়। অগ্রগতির প্রতিটি প্রেক্ষাপট তিনি রচনা করে গেছেন। ষড়যন্ত্রকারীদের ঘাতকের বুলেটে তাঁর মহাপ্রয়াণ ঘটেছে। বঙ্গবন্ধু যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন সেই স্বপ্নটা তাই অসম্পূর্ণই থেকে গেছে। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে বাংলাদেশের জিডিপির যে ঊর্ধ্ব হার ছিল, অর্থাৎ বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ২৭৮ ডলারের বেঞ্চমার্ক অতিক্রম করতে বাংলাদেশের লেগেছে ৪৬ বছর, আর এই কাজটি করেছেন বঙ্গবন্ধুরই কন্যা শেখ হাসিনা, ২০২১ সালে।
প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। বাংলাদেশ আজ সারা পৃথিবীতে উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার রোল মডেল। ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণসহ বৈদেশিক বাণিজ্য, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি এবং জীবন-মান উন্নয়নের সূচকে অসাধারণ অগ্রগতির উদাহরণ।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে জাতি উদযাপন করছে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার অনন্য এক সময়। বঙ্গবন্ধু জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৭ মার্চ ১৯২০ সালে, সে অনুযায়ী ২০২০ সালকে সামনে রেখে উৎসব মুখর পরিবেশে জন্মশতবার্ষিকী আয়োজনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে ১৭ মার্চ ২০২০ থেকে ২৬ মার্চ ২০২১ পর্যন্ত সময়কে মুজিববর্ষ হিসাবে ঘোষণা করা হয়। ২০২১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্নজয়ন্তীর আনন্দ আয়োজনের সাথে মুজিববর্ষের মিলিত আয়োজনে জাতির পিতার স্মৃতি ও তাঁর মহিমাময় কর্মের প্রতি কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার অর্ঘ্য প্রদানের মধ্য দিয়ে সূচিত হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের লাখো শহিদের আত্মদান, লাখো মায়ের আত্মত্যাগ এবং জাতির পিতার ডাকে মরণপণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশের স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে আনা অসমসাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের জয়গাঁথার অক্ষয় ইতিহাস।
এরকম একটি সময়ে এ উদযাপন আমাদের জন্য পরম সৌভাগ্য আর গৌরবের যে, আমরা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ পালনের ঐতিহাসিক সময়ের অংশীদার হতে পেরেছি। এই উদযাপন আয়োজনে জাতির পিতার স্মৃতি ও তাঁর মহিমাময় কর্মের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার অর্ঘ্য প্রদানের আন্তরিক প্রচেষ্টা ছিলো। এই উদযাপনের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের মানুষ এবং বিশ্বের মুক্তিকামী, স্বাধীনতাকামী মানুষ বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানিয়েছে, আন্তরিক ভালোবাসার প্রকাশ ঘটিয়েছে। ২০২১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্নজয়ন্তীর আনন্দ আয়োজনের সাথে মুজিববর্ষের মিলিত আয়োজন আমাদের জন্য আগামীতে অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।
এসব আয়োজন একদিকে গৌরবের, অন্যদিকে স্মৃতিময় ও উৎসবমুখর। তরুণ প্রজন্মও ব্যাপকহারে এই আয়োজনে সম্পৃক্ত হয়েছেন, যা আনন্দের। তাঁরা এখন বঙ্গবন্ধুর বইগুলো পড়ছেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পাঠে তাদের আগ্রহ বাড়ছে। আমাদের বিশ্বাস বঙ্গবন্ধুর জীবন ইতিহাস থেকে পাঠ নিয়ে আগামী দিনের বাংলাদেশের কুশীলব হিসেবে তারা আবির্ভূত হবেন।
ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার সংগ্রামের পাশাপাশি মুক্তির সংগ্রামেরও ঘোষণা দিয়েছিলেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছেন। দেশগড়ার সংগ্রাম শুরু করার সময় মুক্তির সংগ্রামে বিজয় অর্জনে আহবান জানিয়েছেন বারবার। ‘সাধ না মিটিল, আশা না পুরিল’ সে স্বপ্ন থমকে দাঁড়িয়েছিল, তবে আবার যাত্রা শুরু করতে পেরেছে। আর তাই ২০২০ সালে মুজিববর্ষের উদ্বোধন অনুষ্ঠানের প্রতিপাদ্য ছিল ‘মুক্তির মহানায়ক’।
কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতি, বাঙালির মুক্তির মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানিয়েছে। ২০২১ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২৬ মার্চ ২০২১ পর্যন্ত দশ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালায় ‘মুজিব চিরন্তন’ প্রতিপাদ্যে সাজানো হয়েছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের সকল আয়োজন। আমাদের জীবনাচরণে, প্রাত্যহিকতায় চিরকালীন বাতিঘরের মতো সমুজ্জ্বল প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। নতুন প্রজন্মের কাছে তিনি প্রতিমুহূর্তে আবির্ভূত হচ্ছেন প্রেরণার দীপশিখা হিসেবে। মুজিবের আদর্শের মহত্ব ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়। ঘাতকের বুলেটের আঘাতে তাঁর শারীরিক মৃত্যু সম্ভব করা গেলেও মুজিব আসীন হয়েছেন চিরন্তন ভালোবাসার আসনে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের এই সময়ে এবারের ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস আরও তাৎপর্য বহন করছে। বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর ঐতিহাসিক মুহূর্তে জাতির পিতার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং রক্তস্নাত বিজয়ের আবেগ ও আনন্দ উদযাপন আয়োজনের প্রতিপাদ্য ‘মহাবিজয়ের মহানায়ক’।
ঐক্যবদ্ধ দেশবাসী মুক্তির মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার মাধ্যমে মহাবিজয় অর্জন করতে চায়। আর তাই ২০২১ সালের ১৬ই ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাবিজয়ের স্বপ্ন যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ও দেশবাসী। বিজয় দিবসের এই অনন্য দিনে, বিকেল সাড়ে চারটায় জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা থেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশবাসীকে সঙ্গে নিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে শপথ পাঠ করিয়েছেন। যার যার অবস্থান থেকে জাতীয় পতাকা হাতে বজ্রমুষ্টি শপথে অংশ নিয়েছেন দেশের সর্বস্তরের মানুষ।
এ এক অনন্য অসাধারণ মুহূর্ত। এর স্বাক্ষী হতে পেরেছি বলে আমরা নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের শপথ প্রিয় মাতৃভূমিকে জয়যুক্ত করবে, এ আশাবাদ নিশ্চিতভাবে সফল হবে। বাঙালি শপথ নিয়ে দেশ স্বাধীন করতে পেরেছিল, শপথ নিয়ে দেশকে গড়ে তুলতে পারবে না- তা কি হয়? আমাদের এই দ্বিতীয় যুদ্ধেও আমরা যে সেই তর্জনীর বরাভয় পাচ্ছি, যিনি দৃঢ় কণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন- ‘দাবায়ে রাখতে পারবা না’।
লেখক: প্রধান মিডিয়া কর্মকর্তা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি
/তারা/