জৈবপ্রযুক্তি এবং করোনা নিয়ে বিশ্ব রাজনীতি
বিশ্বে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব শুরু হয়ে গেছে। মানুষ এখন বিজ্ঞান কাজে লাগিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করছে। এই বিজ্ঞানময় জগতে, বিজ্ঞান শুধু অমৃত দেয় না, সঙ্গে হলাহলের মতো বিষও দেয়। এই বিষ ধারণ করবে কে? নিশ্চয়ই মানুষকেই সেই বিষ পান করতে হবে! ক্রিয়ার বিপরীতে প্রতিক্রিয়া রয়েছে- এ কথা ভুলে গেলে চলবে কী করে?
করোনাভাইরাসের উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক মহলে ধুম্রজাল তৈরি হয়েছে। আসলেই কি করোনাভাইরাস ল্যাবরেটরিতে তৈরি নাকি প্রকৃতি থেকেই এই ভাইরাস মানুষের শরীরে এসেছে। এবং এ নিয়ে বিশ্বে এখন রাজনীতিও শুরু হয়েছে। মাঝখান থেকে প্রাণ গেল কোটি মানুষের।
করোনা মহামারি নিয়ে এসেছে। সব মন্দের যেমন ভালো দিক থাকে, তেমনি এর একটা ভালো দিক হলো পৃথিবী কিছুদিন লকডাউনের কবলে পড়ে নিজের শরীর স্বাস্থ্য একটু হলেও ঝালিয়ে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে। পৃথিবীতে পরিবেশ দূষণের মাত্রা কিছুটা কমেছে। এতে পৃথিবীর অন্তত উপকার হয়েছে। বায়ুমন্ডলের দূষণ কমেছে। ওজন স্তর ক্ষতির পরিমাণ কিছুটা হলেও কমিয়ে আনতে পেরেছে। সমুদ্র দূষণ কমেছে। সৈকতে ডলফিনের আনাগোনা বেড়েছে। প্রকৃতি ফিরছে স্বরূপে।
ইংরেজিতে একটা কথা আছে- ন্যাচারাল ল’ অব রিভেঞ্জ। অর্থ্যাৎ প্রকৃতির প্রতিশোধ। আমরা এত দিন যেমন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য প্রকৃতির উপর অত্যাচার করেছি। প্রকৃতি এবার তার প্রতিশোধ নিচ্ছে। এ কারণে পৃথিবীর মানুষ বাধ্য হচ্ছে লকডাউনে যেতে। হয়তো অনেকে একমত হবেন না। কিন্তু এটাই সত্য, পরিবেশ দূষণের কারণে প্রতিবছর বিশ্বে যত মানুষ ও শিশু বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয় এবং মারা যায়, সে তুলনায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণে মৃত্যুর সংখ্যা কম। চীন শুধু করোনাভাইরাসের উৎপত্তি স্থল নয়, পরিবেশের জন্যও দেশটি ক্ষতিকারক বিভিন্ন গ্যাস ও রাসায়নিক পদার্থ উৎপন্ন করে। লকডাউনের কারণে শুধু চীনে বিশুদ্ধ বায়ু গত বছর একই সময়ের তুলনায় ২১.৫ শতাংশ বেড়েছে। এই তথ্য সেই দেশের বাস্তুসংস্থান ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় প্রকাশ করেছে।
নাসার মতে, পূর্ব ও কেন্দ্রিয় চীনে সাধারণত যে পরিমাণ নাইট্রোজেন ডাই -অক্সাইডের উপস্থিতি দেখা যায়, তার চেয়ে বর্তমানে ১০-৩০ শতাংশ তা কমেছে। ইউরোপে লকডাউনের কারণে মিলান ও উত্তর ইতালির বেশ কিছু অংশে নাইট্রোজেন ডাই -অক্সাইডের পরিমান ৪০ শতাংশ কমেছে। ভেনিস শহরের দূষিত পানি পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাস ছড়াতে শুরু করে ইতালিতে শুরু হওয়ার ৭-৮ দিন পর থেকে। তারাও লকডাউনে ছিল। তখন যুক্তরাজ্যে ৮০ শতাংশ নাইট্রোজেন ডাই -অক্সাইডের নিঃসরণ কমেছিল। আমরা সবাই জানি, এই পরিবেশ দূষণের কারণে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যায়। সেই হিসাব আমরা কেউ মাথায় রাখছি না। চীনে প্রতি বছর ৯০ লাখ মানুষ পরিবেশ দূষণে মারা যায়।
আমরা এবার একটু হাইপোথিসিস করি। মনে করি, চীনের বৈজ্ঞানিকরা (ভাইরোলজিস্ট) তাদের গবেষণাগারে পৃথিবীর তাবৎ মিডিয়ার চোখ ফাঁকি দিয়ে এই নতুন ভাইরাস জৈবপ্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি করেছে জৈব অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের জন্য (পারমাণবিক অস্ত্রের দিন শেষ)। বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারে হয়তো তারা এই অস্ত্র ব্যবহার করবে। তাতে হয়তো চীনের পৃথিবীজুড়ে যে বাণিজ্য হয় সেখানে সাময়িক ভাটা পড়বে। কিন্তু ক্ষমতার লাটাই দেশটির হাতে থাকবে। এটি অনুমান হলেও কথাটি কিন্তু আরো অনেকেই বলেছেন। এবং তারা এর স্বপক্ষে কিছু যুক্তি দিয়েছেন।
তবে ঘটনা যাই হোক, পৃথিবীর মানুষ প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে এই ভাইরাসের প্রভাব দ্বারা আক্রান্ত। তারপরও মানুষের হুঁশ হচ্ছে না। এই জগতের কোনো কিছুই মানুষের জন্য ক্ষতিকারক নয়, যদি না আমরা তার অপব্যবহার করি। পৃথিবীর সম্পদের অপব্যবহার, অপচয় করছে কারা? একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে ধনী রাষ্ট্রগুলোই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে এই মহামারিতে। যারা মারা গেছেন তাদের ৯৫ শতাংশ হলো ধনী। সুতরাং বলা যায় করোনাভাইরাস ধনীদের শরীরে যেভাবে কাজ করে, ঠিক তেমনিভাবে গরিবের শরীরে কাজ করে না। তার কারণ আপনারা ইতোমধ্যে জেনেছেন। মোদ্দা কথা হলো, শরীরে ইমিয়্যুন সিস্টেম যদি খুব ভালো থাকে, তবে সে করোনাভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হলেও তেমন কোনো জটিলতা তৈরি হবে না। অর্থাৎ করোনাভাইরাস চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেল, তোমরা ধনীরা শরীরিকভাবে খুব নাজুক, গরিবের চেয়ে। শরীরিক সুস্থ্যতার মূল চাবিকাঠি হলো শরীরিক পরিশ্রম। বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মদক্ষতা আমাদের শারীরিকভাবে সুস্থ রাখে না। তাই গরিবের প্রতি করোনাভাইরাস অত্যন্ত মানবিক।
আসুন এবার করোনাভাইরাসের টিকা নিয়ে ভাবা যাক। বৈজ্ঞানিকরা বলছেন, পৃথিবীতে করোনার প্রভাব কমছে, ওমিক্রন তেমন ভয়ঙ্কর নয়, স্বাভাবিক সর্দি-জ্বর, কাঁশির মতো; অদূর ভবিষ্যতে করোনা নিয়ে তেমন কোনো ভয় মানুষের মধ্যে থাকবে না। কিন্তু ইতোমধ্যেই চীনের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে- এবার করোনাভাইরাসের চেয়ে আরও শক্তিশালী ভ্যারিয়ান্ট পৃথিবীতে আসবে, তাতে এক তৃতীয়াংশ লোক মারা যাবে। কি ভয়ঙ্কর কথা! তাহলে মানুষ যাবে কোথায়? এভাবেই হয়তো-বা পৃথিবীর মানুষ ধ্বংস হবে।
বিজ্ঞান আমাদের অনেক কিছু কল্পনা করতে শেখায়। কারণ বিজ্ঞানীদের প্রধান কাজ হাইপোথিসিস করা। তারপর আবিষ্কার করা এবং ফাইনালি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করা। হয়তো এখন অন্য ক্ষমতাধর রাষ্ট্র যারা আছে তারাও গোপনে গবেষণা চালাবেন অন্য কোনো ভয়ঙ্কর ভাইরাসের খোঁজে। যে ভাইরাস মুহূর্তে কয়েক লাখ মানুষ মেরে ফেলতে পারে। বোঝা যাচ্ছে পারমাণবিক ক্ষেপনাস্ত্রের যুগ শেষ। ভাইরাস এখন মানুষের হাতিয়ার বিশ্ব মোড়ল হওয়ার জন্য। এই লক্ষ্য সামনে রেখে কোনো কোনো রাষ্ট্র ভাইরোলজিস্টদের গবেষণা খাতে বরাদ্দ বাড়াবে।
যে জৈব-প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞানীরা মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করছে, ওষুধের বা টিকার ব্যবস্থা করছে আর সেই জৈব-প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে কিছু অমানবিক বিজ্ঞানী তৈরি করবে জৈব মারণাস্ত্র। বিজ্ঞানের অপব্যবহার, প্রযুক্তির অপব্যবহার... এভাবেই মানব সভ্যতা একদিন হুমকীর সম্মুখীন হবে। তবে এর সমাধান কোথায়? আমরা এমন ভাবতে পাববো না যে, করোনাভাইরাস চলে গেলে ভবিষ্যতে আর কোনো মারণঘাতি ভাইরাস আসবে না। তাহলে সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়?
এই আধুনিক সভ্যতায় যুদ্ধবাজ মানুষেরা করোনার মতো ভাইরাস নিয়ে বিশ্ব শাসনের দিবা স্বপ্ন দেখছে। ভাইরাস কতটা মারাত্মক হতে পারে আমরা জেনেছি। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান মৃত্যুর মিছিল ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। আসুন ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া নিয়ে এই মরণ খেলা বাদ দেই। মানুষ গিনিপিগ নয়। করোনাভাইরাসের দানবীয় রূপের পেছনে মানুষের যে নোংরা রাজনীতি লুকিয়ে আছে, তা কখনও মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না। ভাইরাস তাদের জগতে থাকুক। ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া এগুলো প্রকৃতিতে থাকবেই। সেগুলোকে তাদের মতোই থাকতে দিন। অহেতুক টেনে এনে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করা আমাদের জন্য সুখকর হবে না। ভুলে গেলে চলবে না-নগরে আগুন লাগলে দেবালয় রক্ষা পায় না।
লেখক: বিজ্ঞান গবেষক ও গল্পকার
/তারা/