ঢাকা     শনিবার   ২১ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ৬ ১৪৩১

ভাষা ও প্রগতির আন্দোলনে পিয়ারু সরদারের অবদান

শাহরিয়ার কবির || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:২৬, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২   আপডেট: ১০:১৮, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
ভাষা ও প্রগতির আন্দোলনে পিয়ারু সরদারের অবদান

১৯৪৭ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগের দাবি অনুযায়ী ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকরা ধর্মীয় দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষকে দ্বিখণ্ডিত করে পাকিস্তান নামক একটি কৃত্রিম সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র সৃষ্টি করে এদেশ থেকে বিদায় নিয়েছিল। পূর্ব বাংলার মুসলিম সমাজ ছিল জিন্নাহর পাকিস্তান আন্দোলনের ঘোরতর সমর্থক। তাদের সমর্থন না পেলে জিন্নাহর পক্ষে পাকিস্তান সৃষ্টি করা কঠিন হতো।

১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর নবাব খাজা সলিমউল্লাহর নেতৃত্বে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের জন্ম হয়েছিল ঢাকায়। ঢাকার মুসলিম সমাজ তুলনামূলকভাবে রক্ষণশীল। মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার আগেও ঢাকায় অনেক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বেশি আক্রান্ত হয়েছে হিন্দুরা।

১৯৪৮ সালে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণের দাবিতে ছাত্রদের নেতৃত্বে যে ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয় তা ছিল প্রধানত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক। ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের আইনসভায় বাংলার প্রতিনিধি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত যখন বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণের দাবি জানান তখন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী শুধু বিরোধিতা করেন নি, এ দাবির ভেতর পাকিস্তানের শত্রুদের অর্থাৎ ভারতের চক্রান্ত আবিষ্কার করেন। 

আরো পড়ুন:

১৯৪৮-এ সূচিত ভাষা আন্দোলন পাকিস্তানের অখণ্ডতা কিংবা ইসলামবিরোধী ছিল না। উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করবার প্রস্তাব করেছিলেন আইনসভায় কংগ্রেস সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। ১৯৪৮-এর ২৫ ফেব্রুয়ারি গভর্নর জেনারেল ও আইনসভার সভাপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের উপস্থিতিতে তিনি বলেছিলেন, পাকিস্তানের ৬ কোটি ৯০ লক্ষ জনসংখ্যার ভেতর ৪ কোটি ৪০ লক্ষ বাংলা ভাষায় কথা বলে।

এরপর ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বলেছেন উর্দু রাষ্ট্রভাষা হওয়ায় বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে কী ধরনের সমস্যা পোহাতে হচ্ছে। তিনি পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অনুভূতি ও মর্যাদার কথা বলেছেন। পাকিস্তানের আইনসভার কার্যবিবরণীতে উর্দু ও ইংরেজি লেখার বিধান থাকলেও বাংলার কোনো স্থান ছিল না। বাংলাকে তিনি আইনসভার কার্যবিবরণী লেখার অন্যতম ভাষা হিসেবে গ্রহণেরও প্রস্তাব করেছিলেন।

ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের এই প্রস্তাব সমর্থন করে প্রেমহরি বর্মণ, ভূপেন্দ্র কুমার দত্ত ও শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বক্তব্য প্রদান করেছিলেন। প্রস্তাবের বিরুদ্ধে বলেছেন পশ্চিম পাকিস্তানের গজনফর আলী খান, সরদার আবদুর রব নিশতার, মাহমুদ হাশিম গাযদার, পূর্ব বাংলার তমিজউদ্দিন খান, খাজা নাজিমউদ্দিন এবং প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। প্রকৃতপক্ষে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া ছিল অত্যন্ত কঠোর। তিনি এবং তার দলের সদস্যরা মন্তব্য করেছেন- ১) পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছে ভারতের ১০ কোটি মুসলমানের জন্য, যাদের ভাষা উর্দু, ২) ধীরেন দত্তের প্রস্তাব মুসলমানদের ঐক্যের শক্তি কেড়ে নেবে, ৩) পাকিস্তানে দুই অংশের ঐক্যে ফাটল সৃষ্টি করবে,  ৪) যেহেতু পাকিস্তান একটি মুসলিম রাষ্ট্র সেহেতু মুসলিম জাতির বোধগম্য ভাষাই রাষ্ট্রভাষা হতে হবে এবং ৫) বাংলাকে ভাগ করে পাকিস্তানের অংশ করবার ক্ষেত্রে একমাত্র বিবেচনা ছিল ইসলাম ধর্ম, ভাষা বা সংস্কৃতি নয় ইত্যাদি।

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের জবাবে শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, আইনসভার নেতা যখন বলেন পাকিস্তান একটি মুসলিম রাষ্ট্র তখন আমি বেদনাবোধ করি। আমি যতদূর জানি পাকিস্তান একটি গণরাষ্ট্র এবং এখানে মুসলিম ও অমুসলিমদের অধিকার সমান। আজ যদি মাননীয় সংসদ নেতার বক্তব্য গ্রহণ করা হয় তাহলে অমুসলিম সদস্যদের জন্য এটি একটি গুরুতর বিবেচ্য বিষয় হবে- তারা আদৌ এই রাষ্ট্রের সংবিধান প্রণয়নে অংশগ্রহণ করতে পারবেন কি না। পাকিস্তান মুসলিম রাষ্ট্র হলে শুধু মুসলমানরাই এ দেশের সংবিধান প্রণয়নের অধিকার রাখে। সংসদ নেতা বিষয়টি পরিষ্কার করলে এই রাষ্ট্রে আমাদের অবস্থান সম্পর্কে আমরা পরবর্তী করণীয় স্থির করতে পারব।

ঢাকার প্রথম শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ। ছবি: ড. আব্দুল হাফিজ। ইনসেটে পিয়ারু সর্দারের ছবি

ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী ভারতের ষড়যন্ত্র ও বিচ্ছিন্নতার গন্ধ আবিষ্কার করেছিলেন। ধীরেন দত্ত ও তার সহযোগীরা গণতন্ত্র এবং অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনের স্বার্থে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এই প্রস্তাব গ্রহণ না করায় ক্ষতি হয়েছে পাকিস্তানের। জন্মলাভের মাত্র ২৪ বছরের ভেতর পাকিস্তান দ্বিখণ্ডি হয়েছে।

আইনসভার অধিবেশন শেষে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ঢাকা ফিরে এলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিমানবন্দরে তাকে বিপুলভাবে অভ্যর্থনা জানায়। সূচনাপর্বে পুরনো ঢাকায় রক্ষণশীল মুসলিম সমাজ নবাববাড়ি ও মুসলিম লীগের প্রভাবে ভাষা আন্দোলন সমর্থন করেনি। তবে আন্দোলনের ব্যাপ্তি লাভের পর ধীরে ধীরে এর প্রতি ঢাকার আদি বাসিন্দাদের সমর্থন কীভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে বদরুদ্দিন উমরের ‘পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’তে তার বিবরণ রয়েছে।

ঢাকার নবাবরা তাদের শাসনকার্যের সুবিধার জন্য ঢাকায় পঞ্চায়েত প্রথা চালু করেছিলেন। ঢাকার ২২টি পঞ্চায়েত প্রধানদের উপাধি ছিল সরদার। নবাবরা মহল্লার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে পাগড়ি পরিয়ে সরদারি খেলাত প্রদান করতেন। সরদাররা সকলে নবাবদের এবং তাদের দল মুসলিম লীগের অনুগত হবেন এটাই স্বাভাবিক। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস রচয়িতাদের বয়ান থেকে আমরা জানতে পাই- এই সরদারদের ভেতর মতি সরদার ও পিয়ারু সরদার মুসলিম লীগ সরকারের দমনপীড়ন নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে ভাষা আন্দোলনের সমর্থনে এগিয়ে এসেছিলেন।

পুরানো ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোড, হোসেনি দালান, বখশি বাজার, উর্দু রোড মহল্লার পঞ্চায়েত প্রধান ছিলেন পিয়ারু সরদার। ভাষা আন্দোলনে তার অবদানের অক্ষয় কীর্তি হচ্ছে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদদের স্মরণে প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করা। তারই দেওয়া নির্মাণ সামগ্রী দিয়ে ছাত্ররা কীভাবে ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে এই শহীদ মিনার নির্মাণ করেন তার বিবরণ পাওয়া যাবে আন্দোলনের নেতাদের বয়ান থেকে। শুধু শহীদ মিনার নির্মাণ নয়, আন্দোলনের তরুণ নেতাদের তিনি নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে। কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের দফতরের জন্য তিনি হোসেনি দালানের পাশে ঘর বরাদ্দ করেছিলেন, যার জন্য কখনও ভাড়া দাবি করেন নি।

ভাষা সৈনিক নিবেদিতা নাগের একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার আমি গ্রহণ করেছিলাম ২০০১ সালে। ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি নাজমা বেগম নামে ঢাকার আদি বাসিন্দাদের শেল্টারে ছিলেন অনেক দিন। তিনি পিয়ারু সরদারের পাশাপাশি ভাষা আন্দোলনের প্রতি ঢাকার শ্রমজীবী মানুষের সমর্থনের কথা বলেছেন। তাঁর বয়ানকৃত ১৯৪৮ সালের একটি ঘটনা উল্লেখ করছি। এক সন্ধ্যায় তিনি এক শেল্টার থেকে আরেক শেল্টারে যাচ্ছেন রিকশায় করে। রিকশাচালক ঢাকার আদি বাসিন্দা, তার পূর্বপরিচিত। রিকশা চালাতে চালাতে রিকশাচালক ঢাকার আঞ্চলিক ভাষায় তার কাছে জানতে চাইলেন, ‘দিদি, এইগুলি কী হুনবার লাগছি?’
নিবেদিতাদি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হুনতাছ?’
রিকশাচালক বললেন, ‘হ্যারা আমগো আতপ চাইল খিলাইয়া প্যাটে লাথি মারচে। অহন হুনি জবান বি কাইরা লিবার চায়?’
সেই সময় রেশনে আতপ চাল দেওয়া হতো যা ঢাকার আদি বাসিন্দাদের কাছে ছিল অখাদ্য। যে সরকার ভাতের জোগান দিতে পারে না, তারা আবার মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চাইছে- এই ছিল রিকশাচালকের ক্ষোভের কারণ।

নবাব ও অভিজাত সম্প্রদায়ের মুসলিম লীগ- মুসলমানদের জন্য আলাদা দেশ পাকিস্তানের নামে যে মোহ সৃষ্টি করেছিল সেটি ভাঙতে মুসলিম লীগের সদর দূর্গের বাসিন্দাদের বেশি সময় লাগে নি। ১৯৪৮-১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ছিল এ অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রথম সফল গণআন্দোলন। এই আন্দোলনে পুরনো ঢাকার অভিজাত পিয়ারু সরদারের যেমন বিশাল অবদান রয়েছে, ঢাকার শ্রমজীবী মানুষের অবদানও কম নয়। 

আমাদের সমাজ ও রাজনীতিতে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা যেভাবে আবার মাথাচাড়া দিচ্ছে- তরুণ প্রজন্মকে এর অশুভ প্রভাব থেকে দূরে রাখতে হলে অসাম্প্রদায়িক মানবিকতার চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে। পিয়ারু সরদারের মতো হৃদয়বান মানুষরা কীভাবে রক্ষণশীলতা, সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতার দেয়াল ভেঙে বেরিয়ে এসেছিলেন তা জানা আজকের তরুণ সমাজের জন্য খুবই জরুরি। 

আশা করব ভাষা আন্দোলনসহ এদেশের সমাজ প্রগতির আন্দোলনে পিয়ারু সরদারের মহান অবদানের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে তার নামে রাজধানী ঢাকার একটি সড়কের নামকরণ হবে।

জয়তু পিয়ারু সরদার।

/তারা/ 


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়