ইউক্রেন সঙ্কট: রাশিয়ার আক্রমণের কারণ সম্পর্কে যা জানা দরকার
অদিতি ফাল্গুনী || রাইজিংবিডি.কম
পূর্ব ইউক্রেনে পাহারারত একজন ইউক্রেনীয় সৈন্য। ছবি: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস
গত বৃহস্পতিবার জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে কূটনীতিকরা যখন রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনের প্রতি যুদ্ধ থেকে বিরত থাকার জন্য আহ্বান জানাচ্ছিলেন এবং ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতির খানিকটা নিরাবেগ, নৈর্ব্যক্তিক ঢঙে শান্তির জন্য আবেদন এবং রুশ জনতার প্রতি ইউক্রেনের সঙ্গে তাদের দীর্ঘ ঐতিহাসিক বন্ধনের কথা মনে করিয়ে দিয়ে শান্তির আবেদন জানাচ্ছেন, ঠিক তার এক ঘণ্টার ভেতরেই রুশ রাষ্ট্রপতি ইউক্রেনে আক্রমণ শুরু করার অনুমোদন দিলেন।
এই আক্রমণে শুধু ইউক্রেনের চার কোটি চার লক্ষ মানুষের জীবন এক সমাপ্তি চিহ্নের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে এমন নয়। বরং সামনের দিনগুলোতে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বহু দূরবর্তী আরো অসংখ্য মানুষও যুদ্ধের ঝঞ্ঝাব্যত্যায় আহত হবেন সেকথা বুঝতে খুব একটা মাথা না-খাটালেও চলে। ইউক্রেনের ভবিতব্যের সঙ্গে তাই বাদবাকি ইউরোপ, বৈশ্বিক অর্থনীতির স্বাস্থ্য এবং এমনকি বিশ্ব দরবারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানও জড়িত।
প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যতম রাষ্ট্র ইউক্রেনের বিরুদ্ধে মস্কোর অবস্থান তাই পূর্ব ইউরোপের; বিশেষত সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ছিল এমন নতুন, স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর নিরাপত্তা-ভীতি বাড়াতে বাধ্য। পুতিনের এই সামরিক উদ্যোগ ১৯৮৯-উত্তর নয়া আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা এবং এই ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করার মার্কিন সক্ষমতা বিষয়েও উদ্বেগ বাড়াবে। পৃথিবীজুড়ে জ্বালানী তেল ও গ্যাসের মূল্যও এই ঘটনায় বাড়বে।
কেন রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ ইউক্রেন নিয়ে এতটা ভাবছে?
মূলত রাশিয়া এবং পশ্চিম উভয়ের কাছেই ইউক্রেন হচ্ছে পরস্পরের ভেতর নানা বিষয়ে দর কষাকষি বা মুলামুলির জন্য একটি সম্ভাব্য, মজাদার ভূখণ্ড। রাশিয়া ইউক্রেনকে তার স্বাভাবিক প্রভাব বলয়ের অন্তর্ভুক্ত বলেই মনে করে। ইউক্রেনের অধিকাংশ এলাকা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ছিল এবং অনেক ইউক্রেনীয়ের মাতৃভাষা রুশ। দেশটি নিজেই ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে পৃথক হয়ে স্বাধীন হবার আগ পর্যন্ত রাশিয়ার অংশ ছিল।
২০১৪ সালে এক গণ-অভ্যুত্থানে ইউক্রেনের রুশ সমর্থক রাষ্ট্রপতির বদলে দ্ব্যর্থহীনভাবে পশ্চিমমুখী রাষ্ট্রপতি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে রাশিয়া উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। ইতোমধ্যেই সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রাক্তন প্রদেশগুলো যারা সমাজতন্ত্রের পতনের পর স্বাধীন হয়েছিল এবং ইউরোপে যাদের বেশ কিছু মিত্র রাষ্ট্র ছিল, তারা ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ন্যাটোতে যোগ দেয়। রুশ প্রভাব বলয় থেকে ইউক্রেনের এই দূরে সরে যাওয়া পূর্ব ইউরোপে রুশ প্রতিপত্তির কফিনে শেষ পেরেক হয়ে ওঠার আশঙ্কা দেখা দেয়। ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে রাশিয়া বাদে ইউরোপের বাকি অংশে এবং রাশিয়াকে তাদের মোড়লগিরি টিকিয়ে রাখতে ইউক্রেন যেন গলায় ঘণ্টা বাঁধা সর্দার মেষ।
আনুষ্ঠানিকভাবে ইউক্রেন অবশ্য এখনো ইউরোপীয় ইউনিয়ন অথবা ন্যাটোর অংশ নয়। তবে ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইউক্রেন যথেষ্ট পরিমাণে আর্থিক ও সামরিক সাহায্য পেয়ে থাকে। রাশিয়ার আক্রমণ এটাই ইঙ্গিত করছে যে- ইউক্রেনে অভিযানের মাধ্যমে সে মূলত প্রাক্তন অন্যান্য সোভিয়েত অঙ্গরাজ্যগুলোকে (এস্তোনিয়া-লাতভিয়া-লিথুনিয়া) পশ্চিমা মৈত্রীশক্তির অংশ হবার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে পারে। এভাবেই মস্কো নিজেকে পুনরায় ক্ষমতায়িত বোধ করছে।
রাশিয়া-ইউক্রেনের এই যুদ্ধ গোটা বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে মার্কিন আধিপত্যকে পুনরায় হুমকির মুখোমুখি করতে পারে। অতীতের শীতল যুদ্ধ জয়ের পর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার উপর বড় মাপের প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়। তবে গত দশকগুলোয় সেই প্রভাব কিছুটা হলেও ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে এবং রুশ আগ্রাসন এই প্রক্রিয়াকে তরান্বিত করতে পারে।
ট্রাম্প প্রশাসন বিদ্যমান থাকাকালীন ইউক্রেন প্রায়ই সংবাদ শিরোনাম হতো কেন?
২০২০ সালে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিশংসনের পেছনে ইউক্রেন মূল নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল। এই অভিশংসন প্রক্রিয়া শুরু হবার কয়েক মাস আগেই, রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প ইউক্রেনে ৩৯১ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ সামরিক সাহায্য পৌঁছতে দেননি। এবং এ ঘটনার পরপরই ট্রাম্প নব-নির্বাচিত ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রপতি ভলোদিমির জেলেনস্কিকে বলেন জোসেফ আর বাইডেন জুনিয়রকে কেন্দ্র করে দুর্নীতির কলঙ্কজনক অভিযোগগুলো তদন্ত করতে। সেসময় বাইডেনই ছিলেন ডেমোক্র্যাট দল থেকে ট্রাম্পের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ।
ফলস্বরূপ, এক বিদেশী রাষ্ট্রে বা ইউক্রেনের প্রতিনিধিকে মার্কিন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় নাক গলাতে ডাকার জন্য, বেআইনী কার্যক্রমে অংশ নেবার দায়ে ও ব্যক্তিগত সুযোগ লাভের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রীয় নীতি বদলানোর দায়ে ট্রাম্প অভিযুক্ত হন। অভিশংসনের ভোট পাস হলেও সিনেটে ট্রাম্পকে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগসমূহ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
এছাড়াও ট্রাম্পের পূর্ববর্তী প্রচারণা ব্যবস্থাপক পল ম্যানাফোর্টকে জড়িয়ে একটি কেলেঙ্কারির কেন্দ্রবিন্দুতেও ছিল ইউক্রেন। ২০১৮ সালে পল ম্যানাফোর্ট ৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঘুষ গ্রহণের খবর চেপে যাবার দায়ে কারারুদ্ধ হন। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ তিনি গ্রহণ করেন ইউক্রেনের অভিজাত শ্রেণি এবং সরকারী কর্মকর্তাদের কাছ থেকে। ২০১৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যূত তবে রুশপন্থী ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রপতি ভিক্টও ইয়ানুকোভিচের রাজনৈতিক সৌভাগ্যকে তরান্বিত করার উদ্দেশ্যে তিনি এই বিশাল অঙ্কের টাকা তার ‘পরামর্শকের দক্ষিণা‘ হিসেবে গ্রহণ করেন। ইয়ানুকোভিচ রাশিয়া চলে যাবার আগে ম্যানাফোর্ট তার পরামর্শক হিসেবে ২০০৬-২০১৪ সাল নাগাদ কাজ করেন। ট্রাম্পের হয়ে কাজ শুরু করার আগে ম্যানাফোর্ট ইয়াকুনোভিচের হয়েই কাজ করতেন।
রাশিয়া কি ইতোমধ্যেই ইউক্রেনের কিছু অংশে আগ্রাসন চালায়নি?
হ্যাঁ, ২০১৪ সালে অভ্যুত্থানের পর রুশ সেনাদলগুলো তাদের নিয়মিত বাহিনীর পদকবিহীন উর্দি পরে ক্রিমিয়ায় ব্ল্যাক সী-র উপরে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি উপ-দ্বীপে অভিযান চালায় বা হামলা করে। এই ঘটনা বাকি পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ ‘বেআইনী‘ হিসেবে অভিহিত করলেও উক্ত এলাকায় রাশিয়া একটি গণভোটের আয়োজন করে এবং বিস্ময়করভাবে এই এলাকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ রাশিয়াতে যোগদানের পক্ষে ভোট দেয়।
২০১৪ সালেই পরবর্তী সময়ে, রুশ-পক্ষীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীরা রুশ বাহিনী ও সামরিক সরঞ্জামের সাহায্যে পূর্ব ইউক্রেনের অংশগুলো দখল করে এবং দু‘টো ‘রুবল প্রজাতন্ত্র‘ গঠন করে। দোনেতস্ক ও লুহানস্ক এলাকায় এই দু‘টো প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশ এই দুই রাষ্ট্রকে মেনে নেয়নি।
বিগত সপ্তাহে পুতিন এই দুই রুশভাষী ভূ-খণ্ডের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেন এবং তারপরই রুশ সেনাবাহিনী পাঠিয়ে দেন এলাকা দু‘টোতে, যা মূলত সীমান্তরেখা বরাবর আক্রমণের প্রথম পদক্ষেপ। অনেক ইউক্রেনীয়ের কাছে রাশিয়ার সর্বশেষ হস্তক্ষেপ মূলত গত আট বছর ধরে চলা এক যুদ্ধের সর্বশেষ পর্ব।
কেন ইউক্রেন এত অসহায়?
পশ্চিম থেকে অর্থ ও অস্ত্র পেলেও ইউক্রেন বাস্তবে ‘ন্যাটো’র কোনো সদস্য নয় এবং এজনই সে প্রত্যক্ষভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের কাছ থেকে সরাসরি বা প্রত্যক্ষ সামরিক সহায়তার উপর নির্ভরশীল হতে পারে না। গত কয়েক বছরের কয়েক লক্ষ ডলারের সমপরিমাণ পশ্চিমী সাহায্য পেলেও ইউক্রেনের রাশিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী হতে আরো বহু বছর লাগবে। রাশিয়ার মিত্র, বশংবদ এবং খোদ রাশিয়ার দ্বারাই ইউক্রেন চারপাশ থেকে বেষ্টিত বা আবৃত।
এই চটজলদি সামরিক অভিযানে রুশ সেনাবাহিনী শুধু ইউক্রেনের পূর্ব সীমান্তে জড়ো হওয়া নয়, তারা বেলারুশ সীমান্ত যা কিনা ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ থেকে পঞ্চাশ মাইল উত্তরে অবস্থিত, সেখানেও জড়ো হয়েছে। এছাড়াও রুশ সৈন্যরা ট্রান্সনিস্ট্রিয়া বা মলডোভা থেকে খানিকটা দূরের একটি ছোট্ট ও অখ্যাত, অচেনা এলাকায় ঠাঁই গেড়েছে। রুশ সৈন্যদের এই অবস্থানই মূলত নানা লক্ষ্যাভিমুখ থেকে এই এলাকায় আক্রমণ পরিচালনার জন্য কুশলী মঞ্চ নির্মাণ করে দেয়।
এই আক্রমণের অর্থনৈতিক ফলাফল কি হতে পারে?
পৃথিবীর প্রধান কিছু শস্য সরবরাহের কাজ রাশিয়া ও ইউক্রেনের সীমান্ত বরাবর বয়ে যাওয়া ব্ল্যাক সী‘র উপর নির্ভরশীল। রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয়েই পৃথিবীর দুই প্রধান গম উৎপাদনকারী রাষ্ট্র। সামরিক অভিযান শস্য উৎপাদন ও বণ্টনের কাজে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে যা পৃথিবীজুড়েই ভোক্তাদের জন্য খাবারের দাম বাড়াবে।
রাশিয়া একাই গোটা ইউরোপের এক-তৃতীয়াংশ গ্যাস সরবরাহ করে, যার অনেকটাই ইউক্রেনের মাধ্যমে জাহাজে ওঠে। এই ‘সরবরাহ শৃঙ্খলে‘র দুই প্রান্তের কোনো প্রান্তে এতটুকু বিচ্যূতি অন্য ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোকে অন্যত্র তাদের জ্বালানী চাহিদার জন্য দৃষ্টি দিতে বাধ্য করবে। ফলে পৃথিবীজুড়েই তেলের দাম বেড়ে যেতে পারে।
এই আক্রমণের আগে, রাষ্ট্রপতি বাইডেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন এবং এছাড়াও তিনি পশ্চিমা অর্থকরী প্রতিষ্ঠানের দু‘টো বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাজকর্ম রাশিয়ায় বন্ধ করে দেন এবং দেনার বাজারে রাশিয়ার অভিগম্যতাও কমিয়ে দেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নও এর আগে রাষ্ট্রপতি পুতিনের নিজস্ব, অর্ন্তগত বৃত্তে কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে চেয়েছে।
নিবন্ধটি গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’ প্রকাশ করেছে। লিখেছেন প্যাট্রিক কিংসলে। ভাষান্তর করেছেন অদিতি ফাল্গুনী
/তারা/