ঢাকা     রোববার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ৭ ১৪৩১

শবে বরাতের বিদআত ও কুসংস্কার

মাওলানা মুনীরুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:২০, ১৮ মার্চ ২০২২   আপডেট: ১২:৫০, ১৮ মার্চ ২০২২
শবে বরাতের বিদআত ও কুসংস্কার

শবে বরাত বা লাইলাতুল বারাআত মহিমান্বিত রাত। শব বা ‘লাইলাতুল’ অর্থ রাত আর ‘বারাআত’ অর্থ মুক্তি। আরবি বারাআতকেই সহজ করে ‘বরাত’ বলা হয়।

শবে বরাতে নিহিত রয়েছে মুমিন-মুসলমানের মুক্তি ও কল্যাণের বিভিন্ন উপকরণ, তাই এই রাতকে ‘লাইলাতুল বারাআত’ বা ‘মুক্তির রাত’ বলা হয়েছে। এই রাতে নফল ইবাদতের আলাদা গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে। হাদিস শরিফে এই রাতের অনেক ফজিলতের কথা রয়েছে। একে হাদিসের পরিভাষায় ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ বা শাবানের অর্ধ মাসের রাত বলা হয়েছে। 

হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাজে দাঁড়ালেন এবং এতো দীর্ঘ সিজদা করলেন যে, আমার ধারণা হলো তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি তখন তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি ধরে নাড়া দিলাম। তখন তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ে উঠল। তিনি সিজদা থেকে উঠে নামাজ শেষ করে আমাকে বললেন, আয়েশা! তোমার কি এ আশঙ্কা হয়েছে যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল তোমার হক নষ্ট করবেন?
আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! তা নয়, আপনার দীর্ঘ সিজদা দেখে আমার আশঙ্কা হয়েছিল, আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কিনা।
তখন আল্লাহর রাসুল আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি জানো এটা কোন রাত?
আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই ভালো জানেন।
আল্লাহর রাসুল বললেন, এটা হলো অর্ধ শাবানের রাত। আল্লাহ তায়ালা অর্ধ শাবানে তাঁর বান্দাদের প্রতি বিশেষ নজর দেন এবং ক্ষমাপ্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন, অনুগ্রহপ্রার্থীদের প্রতি অনুগ্রহ করেন। আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই।’
(বায়হাকি : ৩য় খ-, ৩৮২ পৃষ্ঠা)

এই হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হলো, এ রাতে দীর্ঘ নফল নামাজ পড়া উত্তম, যাতে সিজদাও দীর্ঘ হবে। এছাড়াও এই রাতে একা একা কুরআন তেলাওয়াত, জিকির-আজকার ইত্যাদি আমল করা যায়। সম্মিলিত কোনো আমলকে এই রাতে আবশ্যকীয় মনে করা বিদআত। এই রাতের আমলসমূহ বিশুদ্ধ মতানুসারে সম্মিলিত নয়; নিরিবিলি ইবাদতের রাত-শবে বরাত। পুরুষদের জন্য তো ফরজ নামাজ অবশ্যই মসজিদে আদায় করতে হবে। তারপর পুরুষ ও মহিলারা সাধ্যানুযায়ী নিজ নিজ ঘরে একাকী নফল ইবাদত-বন্দেগি করবেন। নফল আমলের জন্য দলে দলে মসজিদে এসে সমবেত হওয়ার কোনো গ্রহণযোগ্য প্রমাণ হাদিসে নেই। আর সাহাবায়ে কেরামের যুগেও এর রেওয়াজ ছিল না। (ইকতিযাউস সিরাতুল মুস্তাকিম : ২য় খ-, ৬৩১ পৃষ্ঠা)। 

তবে কোনো ঘোষণা ছাড়া এমনিতেই কিছু লোক যদি মসজিদে এসে যান, তাহলে প্রত্যেকে নিজ নিজ আমলে মশগুল থাকবেন। একে অন্যের আমলে ব্যাঘাত সৃষ্টির কারণ হওয়া যাবে না। আর খেয়াল রাখতে হবে, এ রাতে জাগ্রত থাকতে গিয়ে ফজরের নামাজ যেন ছুটে না যায়। শবে বরাতের সারারাতের আমলও ফজরের ফরজ নামাজের সমতুল্য হবে না।

শবে বরাতকে অস্বীকার করার যেমন সুযোগ নেই, তেমনই এতে বাড়াবাড়িও করা যাবে না। বিদআত ও কুসংস্কার থেকে বেঁচে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর তরিকায় আমল করেই কেবল এই রাতের ফজিলতের অধিকারী হওয়া যাবে। কারণ দীনের ব্যাপারে সব ধরনের বিদআতই হারাম ও গোমরাহি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা দীনের মাঝে নতুন বিষয় আবিষ্কার করা থেকে বিরত থাকবে। কারণ, প্রত্যেক নতুন বিষয়ই বিদআত। আর প্রতিটি বিদআতের পরিণাম গোমরাহি বা ভ্রষ্টতা।’ তিনি আরো বলেছেন, যে ব্যক্তি আমাদের দীনের মধ্যে এমন নতুন বিষয় তৈরি করবে, যা তার অন্তর্গত নয়, তা প্রত্যাখ্যাত হবে।’ অনেকে এই রাতে বিভিন্ন বিদআত ও কুসংস্কারে জড়িয়ে পড়েন। নি¤েœ এমন কিছু বিদআত ও কুসংস্কারের উদাহরণ তুলে ধরা হলো।

আলোকসজ্জা করা

শবে বরাত উপলক্ষে রাস্তা-ঘাট, ঘর-বাড়ি, মসজিদ-মাদরাসাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আলোকসজ্জা করা হয়। এসব কাজে একদিকে লাখ লাখ টাকা অপচয় করা হয়, অন্যদিকে এগুলো অগ্নিপূজকদের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। আল্লামা ইবনে নুজাইম হানাফি বলেন, ‘শবে বরাতে বিভিন্ন গলি ও বাজারে রঙ-বেরঙের আলোকসজ্জা করা বিদআত, এমনকি মসজিদে আলোকসজ্জা করাও বিদআত।’ এই কুপ্রথাটির প্রচলন বারামিকা জাতি থেকে শুরু হয়েছে। যারা মূলত অগ্নিপূজক জাতি ছিল। মুসলমান হওয়ার পরও তারা কুসংস্কারটি সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করতে পারেনি। তাদের পুরনো অভ্যাস থেকে মুসলমানদের মধ্যেও প্রথাটি এসেছে। 
হযরত শাহ আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলবি রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ‘যেসব জঘন্যতম বিদআত ভারতবর্ষের অধিকাংশ এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে তন্মধ্যে রয়েছে [শবে বরাত প্রভৃতি উপলক্ষে] আলোকসজ্জা তথা বাসা-বাড়ি, দেয়াল-অট্টালিকা বৈচিত্র্যময় লাইট দ্বারা সজ্জিত করা, এর মাধ্যমে পরস্পর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়া, আগুন নিয়ে আনন্দ খেলার লক্ষ্যে দলবদ্ধ হওয়া। যেগুলোর কোনো ভিত্তি বিশুদ্ধ কিতাবাদিতে নেই। এ ব্যাপারে কোনো দুর্বল হাদিস কিংবা একটি জাল হাদিসও পাওয়া যায় না। ভারতবর্ষ ছাড়া অপরাপর [মুসলিম] এলাকাতেও এর প্রচলন নেই। হতে পারে এসব কিছু হিন্দু ব্রাহ্মণদের প্রথা থেকে ধারকৃত।’

আতশবাজি করা

কেউ কেউ শবে বরাত উপলক্ষে হাজার হাজার টাকা ব্যয় করে আতশবাজির ব্যবস্থা করেন। অথচ ইসলামে এর কোনো ভিত্তি নেই। এটি নিতান্তই কুসংস্কার। এতে অনেক সমস্যা বিদ্যমান। আতশবাজিতে অনেক অর্থ-সম্পদের অপচয় হয়। আর অপচয় সম্পর্কে কুরআন-হাদিসে কঠোরভাবে ঘোষণা হয়েছে যে, ‘অপচয়কারী শয়তানের ভাই’। এর কারণে সময়ও নষ্ট হয়। যে সময়টুকু আতশবাজির পেছনে ব্যয় হয় সে সময়টুকু ইবাদতে কাটালে আল্লাহ তায়ালার রেজামন্দি অর্জনে সহায়ক হতো। আর সময়ের অপব্যয় করা গুনাহর শামিল। এর কারণে অনেক সময় অপর মুসলমান ভাই কষ্টও পান। বিশেষ করে পাড়া-প্রতিবেশীরা আতশবাজির বিস্ফোরণের আওয়াজে শান্তিতে থাকতে পারে না। অথচ এক মুসলমান অপর মুসলমানকে কষ্ট দেওয়া হারাম। সর্বোপরি এ রাতে কিছু লোক নিরিবিলি পরিবেশে আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করতে চান। আতশবাজির কারণে তাদের ইবাদতে মারাত্মক বিঘ্ন ঘটে।

হালুয়া-রুটি খাওয়া

শবে বরাত উপলক্ষে ঘরে ঘরে হালুয়া-রুটি খাওয়ার হিড়িক পড়ে যায়। সেদিন গরিব মানুষও টাকা ঋণ করে হলেও এক বেলা গোশত কিনে খায়। তারা মনে করে, সেদিন যদি ভালো খাবার খাওয়া যায় তাহলে সারা বছর ভালো খাবার খাওয়া যাবে। আর হালুয়া-রুটি খাওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উহুদ যুদ্ধে দাঁত ভাঙার পর শক্ত খাবার খেতে পারেননি। তাই তাঁর প্রতি সমবেদনা জানানোর জন্য এদিন ঘটা করে হালুয়া-রুটি খাওয়া হয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দান্দান মোবারক শহীদ হওয়ার সঙ্গে হালুয়া-রুটি খাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। এরপর তিনি কি নরম খাবার শুধু একদিন খেয়েছিলেন? তাহলে এ কেমন ভালোবাসা? আপনি শাবান মাসের পনের তারিখে কিছু হালুয়া-রুটি খেলেন আবার কিছুক্ষণ পর গরুর গোশত তো ঠিকই আয়েশ করে চিবিয়ে চিবিয়ে খেতে থাকেন।

প্রাণীর আদলে রুটি মিষ্টান্ন 

কোনো কোনো এলাকায় শবে বরাত উপলক্ষে বিভিন্ন ধরনের মিষ্টান্ন পদার্থ দ্বারা বিভিন্ন প্রকার প্রাণীর আকৃতিতে পাউরুটি, কেক, সন্দেশ ইত্যাদি বানাতে দেখা যায়। যেমন কুমির, ভোদর, গুইসাপ, মাছ ইত্যাদি। এগুলোকে শবে বরাতের বিশেষ খাবার বলে গণ্য করা হয় এবং খুব চড়া মূল্যে বিক্রি হয়। এসব কাজ সম্পূর্ণ নাজায়েয। কোনো প্রাণীর প্রতিকৃতি তৈরি করা হারাম ও কবিরা গুনাহ। হাদিস শরিফে এ ব্যাপারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা এসেছে এবং প্রতিকৃতি প্রস্তুতকারীর জন্য আখেরাতে কঠিন শাস্তির কথা ঘোষণা করা হয়েছে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, প্রতিকৃতি প্রস্তুতকারীরা আল্লাহ তায়ালার কাছে সবচেয়ে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হবে। শবে বরাত উপলক্ষে এ ধরনের খাবারের আয়োজন করাকে সওয়াবের কাজ মনে করা সুস্পষ্ট বিদআত ও কুসংস্কার। আর এ ধরনের প্রাণীআকৃতির খাবারের বেচাকেনাও জায়েয নয়।
(বুখারি ২/৮৮০-৮৮১; শরহে মুসলিম নববী ১৪/৮১)

মৃতদের আত্মা দুনিয়ায় পুনঃআগমন

শবে বরাত উপলক্ষে কোনো কোনো এলাকার নারীরা ঘর-বাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে আতর সুগন্ধি লাগিয়ে পরিপাটি করে রাখে। বিশেষ করে বিধবা নারীরা এমনটি করেন। এমনকি তারা কিছু খাবার এক টুকরো কাপড়ে বেঁধে ঘরে ঝুলিয়ে রাখে। তাদের বিশ্বাস হলো, তাদের মৃত স্বামী-স্বজনদের আত্মা এ রাতে ছাড়া পেয়ে নিজ নিজ পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে আসে। এমন বিশ্বাস মূর্খতা ছাড়া কিছু নয়। মানুষ মারা গেলে তাদের আত্মা আবার দুনিয়াতে ফিরে আসা মুসলমানদের আকিদা নয়।

নির্দিষ্ট নিয়মে নফল নামাজ পড়া

কোনো কোনো এলাকায় এ রাতে এক অদ্ভুত পদ্ধতিতে একশ রাকাত নামাজ আদায় করা হয়। যাকে বলা হয় সালাতুল আলফিয়া। এই নামাজে প্রতি রাকাতে সুরা ফাতেহার পর দশবার সুরা ইখলাস পাঠ করে। একশ রাকাত নামাজে মোট এক হাজার বার সুরা ইখলাস পাঠ করতে হয়। ইসলামে নামাজ পড়ার এ ধরনের নিয়ম সম্পূর্ণ নতুন আবিষ্কৃত বিদআত। এ ব্যাপারে সব যুগের সব আলেম একমত। কারণ, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং খোলাফায়ে রাশেদিন কখনো তা পড়েননি। তাছাড়া ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালেক, ইমাম শাফেয়ি, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, সুফিয়ান সাওরি, আওযায়ি, লাইস প্রমুখ যুগশ্রেষ্ঠ ইমামের কেউ এ ধরনের বিশেষ নামাজ পড়ার কথা বলেননি। এ সম্পর্কে বর্ণিত হাদিসটি মুফাসসিরদের মতে বানোয়াট ও জাল। তাই আমরা এই পুণ্যময় রাতটি বিদআত ও কুসংস্কার মুক্তভাবে এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দিকনির্দেশনা অনুযায়ী ইবাদত-বন্দেগিতে কাটানোর চেষ্টা করব।

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম
 

/তারা/ 


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়