ইউক্রেন সংকট দীর্ঘায়িত হলে কী করবে বাংলাদেশ?
পরিস্থিতি নিবিড় পর্যবেক্ষণে মনে হচ্ছে, ইউক্রেনের যুদ্ধ শিগগির শেষ করতে কোনো পক্ষেরই সদিচ্ছা নেই; যারা (যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রশক্তি) মূলত নিজেদের স্বার্থে দেশটিকে যুদ্ধে নামিয়েছে। পশ্চিমা মিত্রশক্তির ওপর রাশিয়ার দীর্ঘদিনের ক্ষোভ রয়েছে।
ইউএসএসসার (USSR) ভেঙে টুকরো, তুখরু করার ইন্ধন, মুজাহেদীন-তালেবান সৃষ্টি করে আফগানিস্তান থেকে রাশিয়াকে হাত গোটাতে বাধ্য করা। অবশেষে রাশিয়ার আঙিনায় ন্যাটোকে সম্প্রসারিত করার অপপ্রয়াস- এসবই মূল কারণ।
পারমাণবিক শক্তিধর, বিপুল জ্বালানি সম্পদ, কৃষিপণ্য এবং কারিগরি দক্ষতার অধিকারী রাশিয়া সুযোগ বুঝে আঘাত হানবে এটি অনুমেয় ছিল। এই মুহূর্তে যুদ্ধক্লান্ত যুক্তরাষ্ট্র বা মিত্রশক্তির সেনাবাহিনী কিছুতেই রাশিয়ার মতো শক্তিধর দেশের সঙ্গে যুদ্ধ করার মতো অবস্থায় নেই। হয়তো যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট অর্থনৈতিক সঙ্কটের বিষয়ে মিত্রশক্তিকে উপদেষ্টারা সঠিক উপদেশ দেয়নি।
অন্যদিকে, ইউক্রেন নিজেদের দীর্ঘকালীন স্বার্থের হিসাব-নিকাশ না করেই পশ্চিমা শক্তির উস্কানিতে ফাঁদে পা দিয়েছে। ইতোমধ্যেই প্রায় অর্ধকোটি ইউক্রেনে নাগরিক বাস্তুহারা হয়েছেন। রাশিয়া হয়তো বিপুল সম্পদ আর চীন, ভারত, ইরান ইত্যাদি দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বিকল্পভাবে চালু রেখে পরিস্থিতি সামাল দেবে।
এছাড়া অনেকটা ইচ্ছা করেই রাশিয়া সর্বশক্তি প্রয়োগ করে স্বল্প সময়ে ইউক্রেন দখল করছে না। যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধ করবে না। আর যুক্তরাষ্ট্র সমানে না থাকলে রাশিয়ার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার সামর্থ্য ন্যাটোর নেই। এমনকি, বর্তমান অবস্থায় রাশিয়ার জ্বালানি আর খাদ্যশস্য সরবরাহ ছাড়া পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলোর অর্থনীতি ভেঙে পড়বে।
পশ্চিম ইউরোপের মতো সচ্ছল দেশগুলোর যখন এই অবস্থা, তখন কী করবে বাংলাদেশ?
করোনা অভিঘাতে বাংলাদেশে জ্বালানি সংকট দানা বেঁধে উঠেছিলো। হয়তো দেশের কৃষি উৎপাদন উৎসাহব্যঞ্জক হওয়ায় খাদ্য সংকট সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু ইউক্রেন সংকটের পর থেকে বাজারে নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য বাড়ছে ঘোড়ায় চড়ে।
জ্বালানি বাজারে ‘আগুন সংকট’ ঘনীভূত করছে। বাংলাদেশ তরল জ্বালানি (ক্রুড অয়েল, পেট্রোলিয়াম, এলপিজি, এলএনজি) পুরোটাই আমদানি করে বিশ্ব বাজার থেকে। সঠিক কৌশলের অভাবে নিজেদের চাহিদার পরিমাণে গ্যাস অ্যান্ড কয়লা উৎপাদন করছে না। জ্বালানি বাজারের ‘আগুন’ তাই জ্বালানি নিরাপত্তা সংকটাপন্ন করে তুলেছে। আমলা নির্ভর জ্বালানি সেক্টর তাই মারাত্মক হুমকির মুখে। টিকে থাকার জন্য প্রয়োজন বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি অথবা জ্বালানি, বিদ্যুৎ মূল্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৃদ্ধি।
অন্যান্য খাতের চাহিদা থাকায় শুধু জ্বালানি, বিদ্যুৎ খাতে এখন বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দেওয়ার সামর্থ্য নেই। অন্যদিকে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখেছে মূল্য বৃদ্ধির ঝুঁকি নেবে বলে মনে হয় না সরকার। তাই গ্যাস, জ্বালানি ক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণ অপচয় এবং চুরি সীমিত করা, জ্বালানি আমদানিতে শুল্ক-কর কমানো, জ্বালানি ব্যবহারে কৃচ্ছতা নিশ্চিত করা দরকার। দ্বিপাক্ষিক দাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর নিকট থেকে ঋণ গ্রহণ করার বিষয়টিও বিবেচিত হতে পারে।
মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদী ব্যবস্থা হিসেবে বাংলাদেশকে নিজ ইচ্ছায় কয়লা সম্পদ উত্তোলন করতেই হবে। গ্যাস উত্তোলন কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার দ্রুত সম্প্রসারণ করতে হবে। এসব কাজ সুস্থভাবে সম্পাদনের জন্য একান্ত আমলা নির্ভরতা থেকে সরকারকে বেরিয়ে আসতেই হবে।
ইউক্রেন সংকট দীর্ঘায়িত হলে বিশ্ব দুই মেরুতে বিভক্ত হয়ে যাবে। মেরুকরণ হবে। ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় বাংলাদেশ নিরপেক্ষ ভূমিকা বজায় রাখতে পারবে না। সেটিই হবে প্রধান চ্যালেঞ্জ।
লেখক: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী জ্বালানি বিশেষজ্ঞ
ঢাকা/এনএইচ