শতভাগ বিদ্যুতায়নের অনন্য কৃতিত্ব
১৩২০টি পায়রা উড়িয়ে ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার সুপার ক্রিটিকাল টেকনোলজি ব্যাবহারকারী আমদানিকৃত পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আন্তরিক অভিনন্দন।
দক্ষিণ বাংলার অবহেলিত অঞ্চল পটুয়াখালীর পায়রায় তৃতীয় বন্দর নির্মাণের দর্শন বাস্তবায়নের পথে এটি প্রথম সাফল্য। প্রধানমন্ত্রী একই সঙ্গে শতভাগ জনগোষ্ঠীকে বিদ্যুৎ সরবরাহের আওতায় আনার ঘোষণা দিয়েছেন। বিশ্বের বহু দেশের কথা না হয় নাই বা বলি, ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশও শতকরা শতভাগ জনগোষ্ঠীকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় নিয়ে আসতে পারেনি। বলাবাহুল্য এই অর্জনের জন্য প্রধানমন্ত্রী (যিনি একই সঙ্গে জ্বালানি মন্ত্রী) সাহসী ভূমিকা রেখেছেন। সেই সঙ্গে কিছু ব্যতিক্রম এবং উপমধর্মী প্রকল্প বাস্তবায়ন কৌশল গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ চীন যৌথ প্রকল্প কোম্পানিকে (বিসিপিসিএল) সাধুবাদ দিতে হয়। এই প্রথম বাংলাদেশে কোন মেগা প্রকল্প নির্দিষ্ট সময়ে এবং খরচ না বাড়িয়ে সম্পাদিত হয়েছে।
বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুটি ইউনিট পর্যায়ক্রমে ২০২০ সালে বাণিজ্যিক উৎপাদনে আসে। কিন্তু কেন্দ্রের বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সঞ্চালনের জন্য নির্মাণাধীন পায়রা-গোপালগঞ্জ-ঢাকা ৪৪০ কেভি বিদ্যুৎ সঞ্চালনের কাজ এখনো চলমান থাকায় পূর্ণ ক্ষমতায় বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ২০০২ ডিসেম্বরের আগে পরিচালনার সুযোগ নেই। তবে পায়রা থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় বিকল্প সঞ্চালনে খুলনা পর্যন্ত সঞ্চালন পাইপলাইন স্থাপন করে দুটি ইউনিট আংশিক ক্ষমতায় চালানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। যথাসময়ে সঞ্চালন লাইন নির্মিত না হওয়ায় প্রতিদিন বিপিডিবিকে/পিজিসিএলকে বিপুল পরিমাণ আর্থিক ভর্তুকি দিতে হচ্ছে।
নানা কারণে দেশের প্রমাণিত গ্যাস মজুত কমতে থাকায় ২০১০ সালে অনুমোদিত এবং গৃহীত পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান (পিএসএমপি ২০১০) বিদ্যুৎ উৎপাদন জ্বালানি মিশ্রণে ৫০% কয়লাভিত্তিক করার সংস্থান ছিল। সরকার অনুমোদন করেছিল ২৯% বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে দেশীয় কয়লা ক্ষেত্র থেকে উৎপাদিত কয়লা দিয়ে। কিন্তু এক ধরনের কায়েমী স্বার্থবাদী, সুযোগসন্ধানী সিন্ডিকেটের অশুভ প্রভাবে তা হয়নি।
জ্বালানি সংকট ঘনীভূত হওয়ার প্রেক্ষাপটে ২০১৬ পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান (পিএসএমপি) পুনঃবিন্যাস করা হয়। নতুন পরিকল্পনায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানি মিশ্রণে কয়লার অবদান রাখা হয় ২০৪১ বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার (৬০,০০০ মেগাওয়াট ) ৩৫ শতাংশ আমদানিকৃত কয়লা দিয়ে।
উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশে কোনো গভীর সমুদ্র বন্দর নেই এবং প্রাকৃতিক কারণেই বাংলাদেশের তিনটি সমুদ্র বন্দর (প্রকৃতপক্ষে নদী বন্দর) সমূহের গভীরতা কয়লাবাহী মধ্যম ক্ষমতার জলযানের জন্য উপযুক্ত নয়। অথচ সরকার কয়লা পরিবহনের ব্যবস্থা নিশ্চিত না করেই একের পর এক আমদানিকৃত কয়লা নির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করতে থাকে। ইতিমধ্যে বিশ্বজুড়ে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিজনিত কারণে ফসিল ফুয়েল ব্যবহার জনিত পরিবেশ দূষণ দায়ী হিসাবে চিহ্নিত করে বিশ্ব জনমত জোরালো হওয়ায় দাতা প্রতিষ্ঠানগুলো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে সরে আসে। বাংলাদেশ তড়িঘড়ি করে ১৭ প্রস্তাবিত কেন্দ্রের ৭টি বাতিল করে। এগুলোর অধিকাংশ দীর্ঘদিনেও প্রকল্পসমূহের জন্য অর্থের যোগান করতে পারেনি। এছাড়া বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রকল্প এলাকায় কয়লা পরিবহন বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এখন পায়রা প্ল্যান ছাড়া ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বহুল আলোচিত রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং মাতারবাড়ি ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ শেষ পর্যায়ে। একমাত্র মাতারবাড়িতে নির্মাণাধীন কয়লা পোর্ট ছাড়া অন্যান্য কোনো স্থানে আমদানিকৃত কয়লা পরিবহনের সহজ সমাধান আমি দেখতে পাচ্ছি না। সরকার পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলার পরিকল্পনা বাতিল করেছে।
প্রসঙ্গে ফিরি। পায়রা প্রকল্পটির সাফল্য থেকে অনেক কিছুই শিক্ষনীয়। যারা মনে করেন কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলেই পরিবেশ দূষণ হয় তাদের অনুরোধ করবো, পায়রায় নিজ চোখে দেখে আসার। পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণের সব ব্যবস্থা গৃহীত আছে এখানে। দূষণ মাত্রা সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা বিদ্যমান। প্রকল্পটির জন্য ভূমি অধিগ্রহণ এবং ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের জন্য পুনর্বাসনের আধুনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামীণ মানুষের উন্নত জীবনযাপনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। একই ধরনের উপমাধর্মী প্রকল্প বাস্তবায়ন কৌশল শুধু বাংলাদেশের অন্যান্য প্রকল্প নয়, বিশ্বের অধিকাংশ দেশের জন্য অনুকরণীয়।
শতভাগ মানুষের জন্য বিদ্যুৎ সুবিধা সৃষ্টি হলো। এখন এসডিজি-৭ অঙ্গীকার অনুযায়ী সবার জন্য মানসম্পন্ন, আধুনিক, নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সুলভ মূল্যে সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। সামনে এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ। ২০৪১ নাগাদ উন্নত দেশের পর্যায়ে পৌঁছানোর জাতীয় লক্ষমাত্রা অর্জনের জন্য জাতীয় ঐক্য অপরিহার্য।
লেখক: অস্ট্রেলীয় প্রবাসী জ্বালানি বিশেষজ্ঞ
/এসবি/এমএম/