নববর্ষ: গ্রাম থেকে নগরে
ছয় ঋতুর এক বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্যের দেশ বাংলাদেশ। প্রকৃতির এমন লীলাময় দেশ আর কোথাও নেই। একেকটি ঋতু একেকটি বৈশিষ্ট্য নিয়ে উপস্থিত হয় বাংলার এই বৃহত্তর জনপদে। বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন রকম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তাদের জীবন কাটে। এরা একদিকে জীবিকার জন্য লড়াই করে, অন্যদিকে বছরের কয়েকটি নির্দিষ্ট দিনে মেতে ওঠে নানান উৎসবে। এই ঋতুভিত্তিক উৎসবগুলোর মধ্যে তারা খোঁজে নির্মল আনন্দ।
ড. অজয় রায় বলেছেন, ‘সভ্যতার অতি প্রত্যুষকাল থেকেই নাগরিক জীবনের প্রয়োজনে বিশেষ করে, কৃষির কারণে মাস-ঋতু-বৎসর প্রভৃতির হিসাব রাখার সুবিধার্থে ভারতীয়দেরও বর্ষপঞ্জি প্রণয়নে হাত দিতে হয়েছে। এছাড়া বৈদিক ধর্মানুষ্ঠান, যাগযজ্ঞ, পূজা-পার্বণ ইত্যাদির জন্য বর্ষপঞ্জি প্রণয়ন করার তাগিদ অনুভূত হয়েছিল’।১ এই তাগিদ থেকেই পরবর্তীতে বর্ষপঞ্জি ও বঙ্গাব্দের সূচনা করার কাজ হয়। সবারই জানা—বঙ্গাব্দের প্রথম ঋতু গ্রীষ্ম। দুই মাসে এক ঋতুর বাংলাদেশের প্রথম মাস বৈশাখ। এই বৈশাখের প্রথম দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখেই জীবিকাজীবীসহ আপামর জনগণ পালন করে নববর্ষ। এ দেশের মানুষের সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক উৎসব এই ‘নববর্ষ’। এটি আমাদের সর্বজনীন প্রাণঘন একটি উৎসব।
অধ্যাপক যতীন সরকার বলেছেন, ‘বাঙালি সমাজের মানুষ বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ে অন্তর্ভুক্ত থাকলেও বাঙালিত্বকে তারা অধিষ্ঠিত রেখেছে সমস্ত প্রকার ধর্ম সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে, সম্প্রদায় নিরপেক্ষ প্রকৃতি চেতনা ও পরিপার্শ্ব ভাবনা থেকে উৎসারিত হয়েছে তাদের সকল উৎসব। তাদের প্রকৃতি চেতনার পরিপার্শ্ব ভাবনা বিশেষভাবে রূপ পেয়েছে ঋতু পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে। কারণ, ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে সংযুক্ত তাদের জীবন ও জীবিকা। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে তাল রেখে তাদের জীবনাচরণেও পরিবর্তন ঘটাতে হয়। পরিবর্তন ঘটার দিনটিই হয় তাদের ঋতু উৎসবে। এই ঋতু উৎসবের সূচনারূপেই ঘটা করে পালিত হয় নববর্ষ বা বর্ষবরণের উৎসব’।২
একই কথা ব্যক্ত করে সৈয়দ আলী আহসান বলেছেন, ‘এ দিনটি ধর্মাশ্রিত কোনো দিন নয়, এটা হচ্ছে সামাজিকতার প্রভায় উদ্ভাসিত। কৃষি-ভিত্তিক জীবনে ফসল তোলার কাজে যারা নিয়োজিত এ দিন তাদের জীবনে বিশেষ দিন। এক সময় এদেশে হিন্দু জমিদার ছিল মুসলমান জমিদারও ছিল। তবে মুসলমানদের চেয়ে হিন্দু জমিদার ছিল বেশি। তারা ঘটা করে বাংলা নববর্ষ পালন করত। মনে রাখতে হবে যে, বাংলা নববর্ষের সঙ্গে হিন্দু ধর্ম অথবা হিন্দু সামাজিক ব্যবস্থাপনার বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই’।৩
মুহম্মদ এনামুল হক বলেছেন, ‘বাংলা নববর্ষ এদেশের একটা প্রাচীনতম ঐতিহ্য। পয়লা-বৈশাখের উৎসবের মধ্য দিয়ে এদেশের নরনারী এই ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছে। সংগীত, নৃত্য, আমোদ-প্রমোদ, পানাহার প্রভৃতি পৃথিবীর যে কোনো প্রাচীন ও নবীন উৎসবের একটা অতি সাধারণ অঙ্গ। প্রাচীনকালের আর্তব উৎসব থেকে আধুনিক যুগে এসে এগুলো ভোল পালটিয়েছে বটে, তবে তাদের মৌলিক-সত্তা কখনো হারায়নি। তার প্রমাণ পাচ্ছি বাংলা প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক যুগের কাব্যে, গানে, গাথায় ও বারমাসিতে। এ-গুলোতে বৈশাখে ‘নববর্ষের’ আগমনে আমাদের দেশের মানুষের চিত্তে যে চেতনার পরিচয় পাই, তাতে ঋতু পরিবর্তনের আমোঘ-প্রভাব সূচিত হয়। তাই বলতে হয়, বাংলা-নববর্ষ আর্তব-উৎসব এবং কৃষ্যৎসবও বটে। এর সাথে ধর্মের কোনো সংস্রব নেই বললেই চলে’।৪
কবে থেকে বাংলা নববর্ষ উৎসব শুরু হয়েছে, এটি সঠিক করে বলা মুশকিল। প্রাথমিকভাবে ৫৯৩-৯৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে বাংলা অব্দ বা বঙ্গাব্দের সূচনাকে স্বীকার করা হয়। পণ্ডিত সিলভ্যাঁ লেভি ৫৯৫ খ্রিস্টাব্দের দিকে বাঙ্গালা অব্দের শুরুর সঙ্গে ‘সন’ কথাটির ব্যুৎপত্তি তিব্বতি নৃপতি রি-স্রঙ-সন অথবা তদীয় পুত্র সঙসনগাম-পোর নামের আধারে অনুমান করেন। পিতার রাজ্যাভিষেক কিংবা পুত্রের জন্ম উপলক্ষ্যে এই অব্দের আরম্ভকাল বিবেচনা করা হয়ে থাকে। তবে উভয়ের নামের একাংশের সঙ্গে বঙ্গাব্দের সঙ্গে ব্যবহৃত ‘সন’ এর সাযুজ্য বিদ্যমান। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আরবী ‘সন’ অর্থাৎ বৎসরের সঙ্গে বঙ্গাব্দে ব্যবহৃত ‘সন’ এর ঐক্যসূত্র আছে বলেও ধারণা করা হয়। তবে পণ্ডিতদের অনুসন্ধানে জানা যায়, গৌড় বঙ্গের রাজা শশাঙ্কের আমলেই বঙ্গাব্দের সূচনা হয়েছিল। কিন্তু এতে মতান্তর লক্ষ্য করা যায়। কারণ মহামতী আকবরের রাজত্বের পূর্বে বাংলা সন বা বঙ্গাব্দের প্রচলন সম্পর্কিত নিশ্চিত কোনো প্রমাণ নেই। আকবর রাজ্যবর্ষকে সৌরবর্ষ হিসেবে গণনা খুব সম্ভব রাজ্যশাসন রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে। সে কারণে এই বাংলা সনের শুরু এবং বৈশাখের সঙ্গে বাংলার কৃষ্যভূমির সম্পর্ককেও অনিবার্য জ্ঞান করি। এই নববর্ষ উৎসবের সূচনা নিয়ে অনেকে তথ্য-সমৃদ্ধ লেখা লিখেছেন।
ফোকলোরবিদ শামসুজ্জামান খান বলেছেন, ‘আমাদের ধারণা আকবরের কেন্দ্রীয়ভাবে প্রবর্তিত ইলাহি সনকে ভিত্তি ধরে আঞ্চলিক ফসলি সন হিসেবে বঙ্গাব্দের সূচনা করেন নবাব মুর্শিদকুলি খান। মুঘল সম্রাটদের পক্ষ থেকে খাজনা আদায়ের জন্য তাদের ওপর যে প্রবল চাপ সৃষ্টি করা হয় তার ফলে নগদ পয়সাহীন বাঙালি কৃষকেরা ফসলের মওসুমেই শুধু তা বিক্রি করে খাজনা শোধ করতে পারত। সে উপলক্ষ্যে মুর্শিদাবাদের নবাবরা অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিক থেকে পুণ্যাহ প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলা সন ও নববর্ষ উসবের সূচনা করেন বলে আমাদের ধারণা এবং এই সময়েই ব্যবসায়ীদের হালখাতা উৎসবও চালু হয়। নবাবদের পুণ্যাহ এবং ব্যবসায়ীদের হালখাতা উৎসবের মধ্য দিয়েই বাংলা সন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মুনসি সলিমুল্লাহর ফার্সি ভাষায় লিখিত ‘তারিখ-ই-বাঙ্গালাহ্’ (১৭৬৩) নামের গ্রন্থ এ সংক্রান্ত কিছু আভাস পাওয়া যায়’।৫
প্রাচীনকাল থেকেই একই চরিত্রে পালিত হলেও, বর্তমানে এর কিছু নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। এখন বাংলা নববর্ষের যে গৌরবময় ও জাঁকজমক উৎসব আয়োজন রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে হচ্ছে, এটি মূলত বাংলা অঞ্চলের কৃষিভিত্তিক সমাজের ফসল। এই সমাজের মানুষেরা আদিকাল থেকেই নববর্ষের অনুষ্ঠান করে আসছেন। তাদের মাঠের ফসল ওঠা, নতুন ধানের পিঠা-পুলি তৈরি ও আহার, যাকে নবান্নের উৎসব হিসেবে এখনও দেখা যায়। সারা বছরই বিভিন্ন পালা-পার্বণ কৃষক পরিবারগুলো করে থাকে। তেমনি বৈশাখী মেলারও কালের প্রবাহে প্রচলন ঘটেছে। বর্তমানে পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ উদযাপন বাঙালির জীবনে সবচেয়ে বড় ঘটনা হয়ে দেখা দিয়েছে।
বাঙালির এই মহাউৎসবের দিনটিকে তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকরা পালন করতে দেয়নি। তাদের মতে এটি হিন্দুয়ানী বা ইসলাম পরিপন্থি উৎসব। সেকারণে পহেলা বৈশাখ পালনে তারা নানা সময় বাঁধা দিয়েছে। কিন্তু তাতে তারা সফল হয়নি। আসলে এই ভৌগলিক অঞ্চল বা নদী-বিধৌত এই বাংলা অঞ্চলের সহজ-সরল বাঙালির নিজস্ব কৃষ্টি-সংস্কৃতিকে লালন করেছে যুগে যুগে, যে কারণে পাকিস্তানি স্বৈরচার ও সাম্প্রদায়িক শক্তি পহেলা বৈশাখসহ বাঙালির নানা উৎসবকে বন্ধ করে দিতে পারেনি বরং তারা এ বিষয়ে পরাজিতই হয়েছে। পাশাপাশি বাঙালি বীরের জাতি, প্রতিবাদী, লড়াকু এবং গৌরবময় ইতিহাসের অংশীদার, তাই তারা আত্মপরিচয়কে তুলে ধরতে কখনো প্রতিবাদী, কখনো লড়াকু, কখনো রক্তদানেও পিছুপা হয়নি। একারণে পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে পহেলা বৈশাখসহ বাঙালির অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির উপর যখনই আঘাত এসেছে, তখনই তারা প্রতিবাদ করেছে। রমনার বটমূলে যখন পহেলা বৈশাখ অর্থাৎ নববর্ষ উদযাপনের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়, তখন থেকে নানা পায়তারা চলেছে এটিকে বন্ধ করে দিতে, কিন্তু একই চেতনায় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করে বাঙালি উদীপ্ত হয়ে উঠে এবং রুখে দিয়ে ধীরে ধীরে চারাগাছ থেকে মহীরুহ করে তুলেছে নববর্ষের অনুষ্ঠানকে।
এখন পহেলা বৈশাখ সরকারি ছুটির দিন। নববর্ষ উদযাপনে ঐ দিন লক্ষ লক্ষ মানুষ বেরিয়ে আসে। রমনার বটমূলসহ সারাদেশ আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ‘ছায়ানট’র উদ্যোগে ভোর থেকে রমনার বটমূলে শুরু হয় সঙ্গীতানুষ্ঠান চলে দুপুর পর্যন্ত। ঋষিজসহ আরো অনেক সঙ্গীত-প্রতিষ্ঠান পুরো শাহবাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাজুড়ে গান ও কবিতা পাঠের আয়োজন করে। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি এ উপলক্ষ্যে তিন এবং সাত দিনের বৈশাখী মেলার আয়োজন করে। ঐ দিন ঢাকার অনেক স্থানের ফুটপাথগুলোতে বসে বিভিন্ন পসরার বেচা-কেনা চলে। চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে বের হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। অশুভকে দূর করে মঙ্গল ও সুন্দরের কামনায় চারুকলা অনুষদের ছাত্র-শিক্ষকেদের আয়োজনে প্রতি বছর বিভিন্ন মটিভের অনুকৃতি বা মুখোশ তৈরির মাধ্যমে একটি প্রতিপাদ্য বিষয়কে কেন্দ্র করে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা হয়—এতে সকল শ্রেণির মানুষ অংশগ্রহণ করে। উল্লেখ্য, বাঙালির এই বর্ণিল মঙ্গল শোভাযাত্রা ২০১৬ সালে ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
এই উৎসবের মূল উদ্দেশ্য হলো গ্রাম বাংলার কৃষকদের এই প্রাণের উৎসবকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা। তাই নববর্ষের প্রথম দিন আজ বাঙালির মহা-উৎসবের দিন, মহামিলনের দিন। সারা পৃথিবীতেই প্রত্যেক ভাষা ও জাতিগোষ্ঠী তাদের নিজস্বতায় পালন করে নতুন বছরের প্রথম দিনটিকে। বাঙালিরাও তাদের জাতীয় জীবনে যে কয়টি গুরুত্বপূর্ণ দিবস উদযাপন করে পহেলা বৈশাখ অর্থাৎ বাংলা নববর্ষ তার অন্যতম একটি।
ড. আতোয়ার রহমান বলেছেন ‘বাংলাদেশে এখন নববর্ষ এক বড় এবং বেসরকারিভাবে জাতীয় উৎসব। গ্রাম-বাংলায় তার অনুষ্ঠান যদিও অনেকাংশেই হালখাতায় সীমিত, শহরে এ-উৎসব বিপুল উৎসাহ আর আনন্দভোগের। সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কোনো তরুমূলে মাঙ্গলিক বা আবাহনমূলক গানের আসর, বাংলা একাডেমির মতো আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মাঝে মাঝে তার সঙ্গে আনন্দমেলা জাতীয় সমাবেশের আয়োজন, পাড়ায় পাড়ায় নৃত্যগীতের সভা, এই সবই উৎসবটির প্রধান ব্যাপার। উদযাপনে উৎসাহী নয়, এমন সংস্থা, সমিতি বা প্রতিষ্ঠান আজ বিরল’।৬
নববর্ষের এই যে ছড়িয়ে যাওয়া বা বিস্তৃতি তাতে এর চরিত্র দৃঢ়ই হয়েছে। গ্রামের সাধারণ মানুষের মাধ্যমে যে উৎসবের শুরু, তা এখন দেশ ছাড়িয়ে দেশে দেশে বিস্তার লাভ করেছে। শুধু অভিবাসী বাঙালিরাই নয়, অসংখ্য বিদেশি ইংরেজি নববর্ষের পাশাপাশি বাংলা নববর্ষকেও আনন্দে উদযাপন করছে। এখন প্রশ্ন নগরে এসে নববর্ষের চরিত্র কী বদলে গেল? কিছুটা বদলেছে, কারণ নগর ও মহানগরে মধ্যবিত্তের গ্রামতাড়িত মানুষেরা এই দিন পোশাক-আশাকে, খাবার-দাবারে, গান-বাজনায় একটি আনন্দ সময় পার করে। এর সঙ্গে বাণিজ্যিক স্বার্থ জড়িত হয়েছে, এসেছে করপোরেটদের আস্ফালন। তারা এটি নিয়ে গ্রামের বৈশাখের চেহারার অনেক পরিবর্তন ঘটিয়েছে।
কবি মিনার মনসুর তাঁর এক লেখায় বলেছেন: ‘বৈশাখকে ঘিরে নাগরিক এই আড়ম্বর আপাত দৃষ্টিতে যতই মেকি হোক, এটা তার সেই পুরনো ক্ষতে কিছুটা প্রতিষেধকের কাজও করে। তাকে দুদণ্ড শান্তি দেয়। সর্বোপরি, চলনে-বলনে যার যত ফুটানিই থাকুক, একথা তো অনস্বীকার্য যে সুরম্য ফ্ল্যাটবাসী থেকে হতশ্রী বস্তিবাসী নির্বিশেষে প্রায় সবাই তো এই নগরে ‘পরবাসী’। শিকড়চ্যুত এই মানুষগুলো ক্ষণিকের জন্যে হলেও শিকড়ের সংযোগ অনুভব করে বৈশাখের এই নগরাগমনে। এর বাইরে বৈশাখকে ঘিরে অন্য কোনো বৃহৎ বা মহৎ ভাবনা নিয়ে তার কোনো মাথা ব্যথা নেই। সে মূলত নিজেকে নিয়েই ব্যতিব্যস্ত। বৈশাখের বাণিজ্যিকীকরণ ও নগরায়ণে অন্য পক্ষটি শুধু যে উদ্বিগ্ন তা-ই নয়, তারা মহা ক্ষুব্ধও বটে। এই অংশটি সমাজে সংখ্যালঘু হলেও তাদের এই উদ্বেগ ও ক্ষোভের কারণগুলো কিন্তু মোটেও সামান্য নয়। বৈশাখকে তারা তাদের জাতিগত অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করেন। তার পেছনে যুক্তির জোরালো সমর্থনও আছে। এ কথা তো মিথ্যা নয় যে বাঙালিত্বের যে অভেদ্য চেতনা আমাদের স্বাধীনতার মূলমন্ত্র হিসেবে কাজ করেছে, তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি স্তম্ভ হলো এই পহেলা বৈশাখ।’৭
সুতরাং যদি বলি গ্রাম আর শহরের নববর্ষের উদযাপনে ব্যবধান থাকলেও এর চেতনা বা মর্মবাণী একই অর্থাৎ আবহমান বাংলার কৃষকের মাধ্যমে সৃষ্ট পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ বাঙালির সমৃদ্ধ সংস্কৃতিরই পরিচয়। এটি যত বেশি আয়োজনের মাধ্যমে পালিত হবে, তত বেশি অপর পক্ষের মস্তিষ্কের রক্ত ক্ষরণ হবে। তবে বাংলার তরুণ প্রজন্মকে তারা গ্রামেই থাকুক বা শহরেই থাকুক, তাদের কাছে নববর্ষের চেতনা ছড়িয়ে দিতে হবে।
তথ্যসূত্র:
১। অজয় রায়, প্রাচীন ভারতীয় বর্ষপঞ্জি: একটি সমীক্ষা, শামসুজ্জামান খান সম্পাদিত; বাংলা সন ও পঞ্জিকার ইতিহাস-চর্চা এবং বৈজ্ঞানিক সংস্কার—প্রকাশকাল-১৯৯৩, বাংলা একাডেমি, ঢাকা
২। যতীন সরকার, আমাদের অসাম্প্রদায়িক উৎসব, প্রবন্ধ—প্রকাশকাল; ১৫ এপ্রিল ২০২১
৩। সৈয়দ আলী আহসান, নববর্ষ আমাদের জন্য; শামসুজ্জামান খান সম্পাদিত বাংলা সন ও পঞ্জিকার ইতিহাস-চর্চা এবং বৈজ্ঞানিক সংস্কার—প্রকাশকাল—১৯৯৩, বাংলা একাডেমি, ঢাকা
৪। মুহম্মদ এনামুল হক, বাংলা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ, শামসুজ্জামান খান সম্পাদিত; বাংলা সন ও পঞ্জিকার ইতিহাস-চর্চা এবং বৈজ্ঞানিক সংস্কার—প্রকাশকাল-১৯৯৩, বাংলা একাডেমি, ঢাকা
৫। শামসুজ্জামান খান, বাংলা সন ও পঞ্জিকার ইতিহাস-চর্চা এবং বৈজ্ঞানিক সংস্কার; গ্রন্থ: শামসুজ্জামান খান সম্পাদিত বাংলা সন ও পঞ্জিকার ইতিহাস-চর্চা এবং বৈজ্ঞানিক সংস্কার—প্রকাশকাল—১৯৯৩, বাংলা একাডেমি, ঢাকা
৬। আতোয়ার রহমান, উৎসব—প্রকাশকাল-১৯৮৫, বাংলা একাডেমী, ঢাকা
৭। মিনার মনসুর: নববর্ষের নগরায়ণ-পঠিত প্রবন্ধ, ১৩ এপ্রিল ২০২২, ঢাকা
/তারা/